সাকিব আল হাসানের সাক্ষাৎকার: পর্ব ১
‘আমি কত স্যাক্রিফাইস করছি, মানুষ এটা দেখে না’
উৎপল শুভ্র
১৯ ডিসেম্বর ২০২১
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। ক্রিকেটটা কি আগের মতোই তাঁর অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে আছে, নাকি শুধু খেলার জন্যই খেলেন? এনডোর্সমেন্টের বাজার ধরে রাখার ব্যাপার না থাকলে কি আদৌ খেলতেন ক্রিকেট? বায়োপিক দিয়ে শুরু তিন পর্বের ইন্টারভিউয়ের প্রথম পর্বে এই অপ্রিয় প্রশ্নগুলোও এসেছে। সাকিব সম্ভবত প্রথমবারের মতো মেলে ধরেছেন তাঁর কষ্টের ডালা। স্ত্রী-সন্তানকে সাত সমুদ্র তের নদী ওপারে রেখে মাসের পর মাস একা থাকার কষ্ট, যখন ফ্যামিলির কাছে ফিরে যাওয়ার পর তাঁর মেয়ে তাঁকে `মামা` বলে ডাকে।
উৎপল শুভ্র: মিরপুরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচ দেখতে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে আপনার বায়োপিক বানাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ভারতীয় চিত্র পরিচালক সৃজিত মুখার্জি। আপনিও তো শুনেছেন মনে হয়...
সাকিব আল হাসান: হ্যাঁ, শুনেছি। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, মিডিয়া অ্যাট্রাকশন পাওয়ার জন্যই উনি এটা বলেছেন।
শুভ্র: এমন কেন মনে হলো...তিনি তো আপনার ঘটনাবহুল জীবন-ক্যারিয়ার এসবেরও উল্লেখ করেছেন। এসবে সিনেমা বানানোর মতো উপাদান দেখেই না এমন বলেছেন।
সাকিব: তিনি তো আমাদের দেশেরই আরও চার-পাঁচজনের নাম বলেছেন। আমার মনে হয়েছে, যার নাম মাথায় এসেছে, বলে দিয়েছেন।
শুভ্র: সৃজিত মুখার্জির কোনো মুভি দেখেছেন?
সাকিব: তা বলতে পারব না। দেখতে পারি, তবে ডিরেক্টরের নাম দেখে তো আর মুভি দেখি না।
শুভ্র: ২২শে শ্রাবণ দেখেছেন? সৃজিত মুখার্জির ছবিগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয়।
সাকিব: ২২শে শ্রাবণ মনে হয় দেখেছি।
শুভ্র: ক্রিকেটারদের বায়োপিক দেখেছেন কোনোটা? ধোনির, আজহারের বা অন্য কারো?
সাকিব: ধোনিরটা দেখেছি।
শুভ্র: কেমন লেগেছে?
সাকিব: ভালোই। কারণ এটা কমার্শিয়ালি বানানো হয়েছে। আর এটাই ঠিক আছে। যেমন শচীনেরটা বানানো হয়েছে, আ বিলিয়নস্ ড্রিম না কী যেন, ওইটা আমাদের জন্য ভালো। কিন্তু কমার্শিয়াল দিক থেকে ওই মুভি ভালো বলে মনে হয় না। ভারতে অনেক বড় মার্কেট হওয়ায় হয়তো এটাতেও বিজনেস হয়েছে। তবে আমাদের দেশে বায়োপিক বানালে কমার্শিয়ালই বানানো লাগবে।
শুভ্র: আপনার বায়োপিক বানালে তো তা এমনিতেই কমার্শিয়াল হয়ে যাবে। আপনার জীবনে তো কমার্শিয়াল উপাদানের অভাব নাই! প্রেম, ভালোবাসা, কন্ট্রোভার্সি সবকিছুই আছে।
সাকিব: হ্যাঁ, আমার জীবনে সবকিছুই আছে। বেশ কয়েকটা সেক্টর নিয়ে মুভি বানাতে পারে যে কেউ। কমপক্ষে চার-পাঁচটা সেক্টর আছে।
শুভ্র: যেমন?
সাকিব: আপনাকে বলে লাভ কী! যে টাকা দিবে লেখার জন্য, তাকে বলব।
শুভ্র: আর টাকা...কত টাকা লাগে আপনার? এখনই যা আছে, তা দিয়েই তো কয়েক প্রজন্ম বসে খেতে পারবে...
সাকিব: দোয়া করবেন, আলহামদুলিল্লাহ, এভাবে যেন থাকতে পারি (হাসি)।
শুভ্র: টাকার প্রসঙ্গে একটা কথা মনে হলো। ২০১৩ সালে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে হোটেলে দেওয়া একটা ইন্টারভিউয়ে আপনি আমাকে বলেছিলেন, আপনি টাকা ইনকাম করা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, কারণ টাকা যদি একটা নির্দিষ্ট অ্যামাউন্টে যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ নিয়ে আর চিন্তা না করে একদম প্রাণ খুলে ক্রিকেট খেলতে পারবেন।
সাকিব: কিন্তু ওটা হয়নি তো এখনো।
শুভ্র: আপনি যদি আপনার চাহিদার বার দিন দিন উপরে ওঠাতে থাকেন, তাহলে তো কোনোদিনই হবে না।
সাকিব: আমি যদি চাহিদার বার দিনে দিনে উপরে না উঠাই, আমার পারফরম্যান্স কি ভালো থাকবে? আমার পারফরম্যান্স যদি কমে যায়, তাহলে আর্থিক দিক থেকে বারটাও নিচে নেমে যাবে না?
শুভ্র: ঠিক আছে, টাকার প্রসঙ্গ বাদ। আপনার বায়োপিক যদি হয়ই, আপনার চরিত্রে কাকে দেখতে চান?
সাকিব: আমার মনে হয় আমিই ভালো করতে পারব।
শুভ্র: মানে আপনার চরিত্রে আপনিই অভিনয় করতে চান?
সাকিব: হ্যাঁ, অপশন থাকলে কেন নয়!
শুভ্র: তা তো করতেই পারেন। কমার্শিয়াল করে আপনার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে! অভিনয়ও তো খারাপ করেন না! ওই যে স্প্রাইটের বিজ্ঞাপনটায় গাড়িতে পাশে এসে কার্টুন চরিত্রটা বসে, আপনার যে এক্সপ্রেশন...দুর্দান্ত!
সাকিব: (হাসি) স্প্রাইট না, সেভেন আপ।
শুভ্র: সর্বনাশ! আমি তো পুরো রাইভাল কোম্পানির মডেল বানিয়ে দিয়েছি আপনাকে। বায়োপিকে ফিরি। আপনার চরিত্রে আপনিই অভিনয় করলে শিশির হবে কে?
সাকিব: শি-শি-র...হ্যাঁ, শিশিরও তো লাগবে। পারমিশন দিলে অন্য কাউকে নিয়ে করলাম, আর না দিলে ওরেই নিলাম (হাসি)।
শুভ্র: আপনাকে বলা হয়নি, বেশ কিছুদিন আগে আমাকে একজন অ্যাপ্রোচ করেছিল আপনার বায়োপিকের স্ক্রিপ্ট লেখার জন্য। পরে কি ওটা এগিয়েছিল?
সাকিব: হ্যাঁ, এমওইউ (মেমোরান্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং) সাইন করাও হয়ে গিয়েছিল। গল্পটা কী হবে, সেটাও। এরপরই তো কোভিড শুরু হয়ে গেল। গল্প বলার পরে আর তেমন আগায়নি। এখন ওটা কী পরিস্থিতিতে আছে, তা-ও জানি না।
শুভ্র: আপনার নামে বায়োপিক বানাতে হলে আপনার অনুমতি নেওয়া কি জরুরি?
সাকিব: হ্যাঁ! সেটা তো জরুরিই।
শুভ্র: যদি নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হয়, ধরুন ক্রিকেটার নায়কের নাম রাকিব আল হাসান...তাহলে?
সাকিব: সেটা করলেও যদি বোঝা যায়, কেস করে দেব আর কি!
শুভ্র: তাহলে তো এমন কিছু না করাই ভালো। আচ্ছা, একটু আগে যে মিটিংয়ে যাওয়ার আগে বললেন, এটার ওপর নির্ভর করছে কেমন ইন্টারভিউ দেবেন, তা কার সঙ্গে কিসের মিটিং? ফ্যামিলি রিজনসের জন্য ছুটি নিয়ে বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং করছেন বলে বোর্ড প্রেসিডেন্ট ডেকেছিলেন নাকি?
সাকিব: না না, আমার যে কত রকম মিটিং থাকে। মানুষ তো কী না কী ভাবে। আর আমি যে কী করি, তা শুধু আমিই জানি।
শুভ্র: তা ঠিক। আপনি যে কী করেন, সেটা তো একটু রহস্যজনকই।
সাকিব: এটা সবার কাছেই রহস্য। এজন্যই তো আমার লাইফ নিয়ে মানুষের ইন্টারেস্ট বেশি! স্পেশালি মাঠের ভেতরের থেকে মাঠের বাইরের লাইফ নিয়ে।
শুভ্র: আপনি কি সচেতনভাবে রহস্যটা আরেকটু বাড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেন?
সাকিব: না, না, আমি ইচ্ছে করে করি না। প্ল্যান করে রহস্য করার আমার কোনো শখ নেই। আমি চাই শান্তিতে থাকতে, ফোকাসে না আসতে, দূরে থাকতে।
শুভ্র: তা-ই নাকি? আপনি চান ফোকাসে না থাকতে, অথচ সব সময়ই আপনি ফোকাসে...
সাকিব: চাই না বলেই হয়তো ফোকাসে। যারা ফোকাসে থাকতে চায়, তারা আবার ফোকাসে আসতে পারে না।
শুভ্র: আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো...এই যে দেশের প্রতিটা মানুষ আপনাকে চেনে, আপনার প্রতিটা কথাই নিউজ, প্রতিটা কথা নিয়ে পজিটিভ-নেগেটিভ আলোচনা হয়, অনেক মানুষ আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। এই জীবনটা তো আমি কল্পনাও করতে পারি না, শচীন টেন্ডুলকার হয়তো পারবেন। এই লাইফটা আসলে কেমন?
সাকিব: মজার, ইন্টারেস্টিং, আনন্দদায়ক। আমি প্রতিটা মূহূর্ত উপভোগ করি।
শুভ্র: কখনো কি এমন ভেবে ভয় লাগে, হঠাৎ দেখলেন, আপনাকে নিয়ে মানুষের আর কোনো আগ্রহ নাই!
সাকিব: না। কারণ আমি জানি, এমন সবসময় থাকবে না। আই অ্যাম ওকে উইথ ইট। শচীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক, এমন একজনের কাছে আমি শুনেছি, আগে এক লোক শচীনকে সারাক্ষণ ফোন দিত, আর শচীন তাঁর মনমতো টাইমে কল ব্যাক করত। আর এখন ওই লোক তাঁর মনমতো টাইমে ফোন ব্যাক করে। তো শচীনের ক্ষেত্রে যদি এটা হতে পারে, আমার ক্ষেত্রে তো এটা খুবই নরমাল। আমি এটা অ্যাকসেপ্ট করেই এগিয়েছি। কাজেই এমন না যে, আমি ভাবব খেলা ছাড়ার পর কী হবে। আর সুবিধা হয়েছে কি, সাসপেন্ড হয়েছি দুইবার। যা আমাকে আরও ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, কী হতে পারে। আমি তাই আর ওটা নিয়ে বদারড্ না।
শুভ্র: ২০১৪ সালে প্রথমবার সাসপেন্ড হওয়ার পর এই পরিবর্তনটা নিশ্চয়ই আপনার জন্য ধাক্কা হয়ে এসেছিল?
সাকিব: হ্যাঁ! তা ঠিক। তবে আমার মনে হয় এটা আমি ভালোভাবেই হ্যান্ডল করেছি।
শুভ্র: সাকিব, এবার ক্রিকেটে আসি। কয়েক দিন আগে আমি আমার ইউটিউব চ্যানেলে একটা ভিডিও করেছি, যেটার মূল কথা হলো, ক্রিকেটটা এখন আর আপনার প্রায়োরিটি লিস্টের এক নম্বরে নেই। একটা কারণ তো অবশ্যই এটা যে, আপনার কমিটমেন্ট এখন নানা দিকে ছড়িয়ে গেছে। আপনি এখনো ক্রিকেট খেলেন, এর কারণ আপনি বাকি যা করেন, সব ক্রিকেট থেকেই উৎসারিত। তবে ক্রিকেট নিয়ে আপনি বড় কোনো স্বপ্ন আর দেখেন না। এটা কি আমি ঠিক বললাম?
সাকিব: আপনি কী মিন করেছেন, আমি বুঝতে পেরেছি। ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে বাকি সবকিছু, এটা সত্যি। এমন না যে, ক্রিকেটটা এনজয় করি না। এনজয় করি, পারফর্মও করতে চাই...আবার আপনার ওই পয়েন্টটাও ঠিক আছে। ক্রিকেটই টপ প্রায়োরিটি কি না, বলতে পারব না! তবে যখন খেলার ভেতরে ঢুকি, যদি চ্যালেঞ্জ আসে, সেটা ওভারকাম করার একটা তাড়না কিন্তু থাকেই।
রিসেন্ট একটা উদাহরণই যদি দিই, (পাকিস্তানের বিপক্ষে) সর্বশেষ টেস্টের কথাই ধরুন, আমি ফুল ফিট না, ইনজুরির সমস্যা নেই, তবে ফিজিক্যালি তো হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফিট ছিলাম না। ওজন বেড়ে গেছে, ওইভাবে ট্রেনিং করা হয়নি...তিন/চারদিনই যা একটু ট্রেনিং করেছি। তবে যখন খেলতে নামছি, আমি তো জানি কেউ আর কাউন্ট করবে না যে, আমি ফিট কি আনফিট! মাঠে নামছি, মানুষ চাইবে আমি পারফর্ম করি। ওই চ্যালেঞ্জটা আমার ছিল এবং আমি তাতে জেতার চেষ্টাও করেছি। এমন না যে, আমি খেলতে চাই না, তবে লাইফ তো চেঞ্জ হবেই, সারা জীবন তো মানুষ এক জায়গায় আটকেও থাকতে পারে না।
শুভ্র: আচ্ছা, প্রশ্নটা সরাসরিই করি। এমন যদি হয়, আপনার এনডোর্সমেন্ট বা বিজ্ঞাপন বাজারের এখন যে রমরমা অবস্থা, ক্রিকেট না খেললেও যদি তা থাকত, তাহলে আপনি কি আর ক্রিকেট খেলতেন?
সাকিব: হ্যাঁ, খেলতাম, হান্ড্রেড পার্সেন্ট খেলতাম। আর যদি আমার ফ্যামিলি এখানে থাকত, তাহলে আমার এ ব্রেকগুলোও হয়তো লাগত না। খুব ভালোভাবে তিন ফরম্যাটে সময় দিয়ে খেলতে পারতাম। আমার কাছে মনে হয়, আমার খেলাটাও আরও ইমপ্রুভ হতো, যেটা এখন হচ্ছে না। আমি যেখানে ছিলাম, ওখানেই আছি। আমার আরও কয়েক স্টেপ উপরে যাবার সম্ভাবনা আছে, যেটা আমি পারছি না, যেহেতু আমি যথেষ্ট টাইম দিতে পারছি না ক্রিকেটে। এত ট্রাভেলিংয়ের কারণে, ফ্যামিলিকে টাইম দেওয়ার কারণে।
শুভ্র: এই প্রশ্নটাই আমি করতাম এরপর। বায়োবাবলে ক্রিকেটারদের জীবন এমনিতেই কঠিন। আর আপনার তো আরও বেশি। বাকিরা সবাই খেলা শেষ হওয়ার পরই পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছে, কিন্তু আপনার ফ্যামিলি আমেরিকায় থাকে বলে এমনও হয়, সাত দিনের গ্যাপ পেলে চার দিন রাস্তায়ই চলে যায়...
সাকিব: হ্যাঁ, এমনই তো হয় আসলে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এমন জায়গায় আমাকে ফ্লাই করতে হয়, যেখানে যাওয়ার পর জেট-ল্যাগ কাটাতে চার দিন লাগে, আর আসার পর লাগে সাত দিন। সাত আর চার এগারো আর চার দিন ট্রাভেল...তার মানে একেকবারেই পনের দিন চলে যাচ্ছে জার্নিতে। এটা একটা মানুষের লাইফের জন্য অনেক বেশি ডিফিকাল্ট। তারপর তিনটা বাচ্চা যখন আছে আপনার, আপনি তাদের মিস করতে বাধ্য। মানুষ তো শুধু ভাবে আমি খেলতে চাই কি চাই না, কিংবা এরকম না হলে ওরকম হতো! কিন্তু আপনি এটা চিন্তা করেন তো আমি কত স্যাক্রিফাইস করছি। এটা মানুষ দেখে না। কাউকে বলেন তো আমার মতো ফ্যামিলি ছাড়া এমন একা একা থাকতে-খেলতে; দেখি কয়জন সারভাইব করতে পারে। আপনি আমাকে আর একটা প্লেয়ার দেখান তো এমন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ফ্যামিলি ছাড়া খেলছে। বাংলাদেশ তো বাদই দিলাম, আপনি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটেই আর একটা এমন প্লেয়ার দেখান না!
শুভ্র: আসলেই নাই। কিন্তু এটা সমাধানের কি কোনো সুযোগ ছিল না? আমি জানি, আপনার বাচ্চারা কোথায় বড় হবে, আপনার বউ কোথায় কমফোর্টেবল ফিল করে এসব খুব গুরুত্বপূর্ণ...তারপরও বলছি, ওদেরকে ঢাকায় রেখে কি প্রবলেমটা সলভ্ করা যেত না?
সাকিব: আমার কাছে ফ্যামিলি সব চাইতে ইম্পর্ট্যান্ট। তার পরে বাকি সবকিছু। একটা সময় তো ওরা ঢাকাতেই ছিল। কিন্তু এখন ওখানে যাওয়ার পর যখন আমি দেখি, আমার মেয়ে স্কুলে হাসিমুখে যাচ্ছে-আসছে, কত এনজয় করছে ওর লাইফ...এটা তো আমি আমার জন্য চেঞ্জ করতে পারি না। আমি নিজে ভালো থাকার জন্য স্বার্থপরের মতো ওর লাইফটা তো খারাপ করতে পারব না। আমার কষ্ট হচ্ছে, সেটার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে আমার নিজের জন্য ওর লাইফটা চেঞ্জ করার অধিকার তো আমার নাই।
শুভ্র: তার মানে আপনার ফ্যামিলি বাংলাদেশের চেয়ে আমেরিকায় কমফোর্টেবল ফিল করে?
সাকিব: হ্যাঁ। আমি স্কুলের উদাহরণটা বারবার দিচ্ছি, কারণ আমি তো দেখেছি এখানে স্কুলে যাওয়ার আগে ও (বড় মেয়ে অ্যালাইনা) ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন কাঁদত। ওখানে এক ডাক দেওয়ার আগেই নিজে উঠে চোখ বন্ধ করে নিজে ব্রাশ করে স্কুলের জন্য রেডি হয়ে যায়। এর থেকে ভালো কিছু আমার জন্য আর কী আছে? আর প্রতিদিন স্কুল থেকে আসার সময় যে খুশিমনে আসে, এগুলো তো আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া। এটা আমি নষ্ট করতে চাই না। তাছাড়া ওর নিজেরও এখন বোঝার বয়স হয়েছে ও কী চায়, না চায়! এখন এখানে আসলেও ওর ভালো লাগতে পারে। ও তো এখন একটা বয়স থেকে আরেকটা বয়সে যাচ্ছে। এই সময় বাচ্চাদের অনেক কিছু চেঞ্জ হয়। বাংলাদেশে এলে ও এখানে পছন্দও করতে পারে। কিন্তু আমি তো নিশ্চিত নই।
আমার কথা যদি বলি, আমি মাগুরাতে যখন বড় হয়েছি, একই ফ্রেন্ড সার্কেলের সাথে বড় হয়ে আসছি। ওর জন্য এই সার্কেলটা পাওয়া কঠিন এখানে। ও যেখানে আছে, ওর একটা নিজস্ব সার্কেল হয়েছে, সবাই সবাইকে চেনে। আমি তো এখনও চাই, ওদেরকে এখানে নিয়ে আসতে। কিন্তু সবকিছু তো মেলে না।
শুভ্র: প্রশ্নটা একটু নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে, তারপরও করছি। এই যে এতদিন পরে গিয়ে আবার অনেক দিনের জন্য চলে আসেন, বাচ্চারা কীভাবে রিয়্যাক্ট করে?
সাকিব: বাকি দুইজন তো খুব ছোট, তবে অ্যালাইনার জন্য খুব কঠিন। ওর জন্য বেশি ঝামেলাটা হয়। ছোট দুইজন অনেক দিন থেকেই দেখছে আমি অন অ্যান্ড অফ, অন অ্যান্ড অফ। যেমন আমি যাওয়ার পর আমার মেজো মেয়ে আমাকে ডাকছে ‘মামা’ ‘মামা’ করে। আপনি চিন্তা করেন, বাপকে যদি মামা-মামা বলে ডাকে তো কেমন লাগে! ও দেখেছে ওর বাপ টিভিতে, ভেবেছে ওর বাপ টিভিতেই আছে। যে আসছে, সে আরেকটা মামা। আসার তিন দিন আগে থেকে বাবা-বাবা ডাকা শুরু হয়েছে, কিন্তু আমি চলে আসলাম। আবার যখন যাব; তখন চাচা, মামা, খালুও ডাকতে পারে। মানুষ ওগুলো অত বুঝবে না, যতক্ষণ না সে আমার জায়গায় আসবে। এ কারণে কে কী বলল, এটা নিয়ে আমি ভাবি না।
সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব
সাক্ষাৎকারের তৃতীয় পর্ব