অভিনন্দন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, অভিনন্দন শ্রীলঙ্কা!
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
স্যার রিচার্ড হ্যাডলির মতো দু`একজন টুর্নামেন্টের `ডার্ক হর্স` বলেছিলেন বটে, তার পরও শ্রীলঙ্কার ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয় অনেকটাই রূপকথা। অর্জুনা রানাতুঙ্গার দল চমকে দিতে শুরু করেছিল বিশ্বকাপের শুরু থেকেই। সেই চমকের শেষ অঙ্কটা মঞ্চস্থ হয়েছিল লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ে। যে জয়ের একটু পরই শুরু ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মনে করিয়ে দিয়েছিল আগের দিনের উপকথার পুষ্পবৃষ্টির কথা।
প্রথম প্রকাশ: ১৮ মার্চ ১৯৯৬। ভোরের কাগজ।
আকাশও যেন অপেক্ষা করছিল এই মুহূর্তটার জন্য। ম্যাকগ্রার বল স্টিয়ার করে থার্ডম্যানে পাঠিয়ে অর্জুনা রানাতুঙ্গা স্টাম্প তুলে নেওয়ায় ব্যস্ত। অন্য প্রান্তে যে ছোটখাট মানুষটি ব্যাট করছিলেন অধিনায়কের সঙ্গে, সেই অরবিন্দ ডি সিলভাও একটি স্টাম্প তুলে নিতে না নিতেই পুরো শ্রীলঙ্কা দল ছুটে গেল মাঠে।
আকাশ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জলও ঝরতে শুরু করল তখনই। আগের দিনের উপকথায় পুষ্পবৃষ্টির কথা পাওয়া যায়। খুব ভালো, মঙ্গলকর কিছু ঘটলে প্রকৃতি তার প্রসন্নতার কথা জানায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে। সেই পুষ্পবৃষ্টিই যেন বর্ষিত হলো শ্রীলঙ্কান বীরদের ওপর। বছরের পর বছর গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত একটা দেশের বিশ্বজয়ের রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটতে দেখে প্রকৃতিও আবেগ সামলে রাখতে পারেনি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের ভিজিয়ে দিয়েছে আশীর্বাদের ধারায়।
টসে জিতে অর্জুনা রানাতুঙ্গা যখন প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সম্ভবত সবারই মনে হয়েছিল,লোকটা তো আচ্ছা গোঁয়ার। ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা নিতে রাজি নয়।
১৭ মার্চ রাতেও তামিল বিদ্রোহীরা হয়তো গুলি ছুড়েছে, তবে তা কোনো মানুষের দিকে নয়। উৎসবের আনন্দের হাজারো উপকরণের একটি হয়ে আকাশের দিকে উড়ে গেছে বুলেটের সারি। অন্তত এই একটি রাতে তামিল আর সিংহলি এক হয়ে শ্রীলঙ্কান হয়ে গেছে সবাই। শুধুই একটি খেলা, কিন্তু তার কী অসীম ক্ষমতা! শোচনীয়তম পরাজয় কথাটা এমনিতেই লেখা হয়নি, এর আগে পাঁচটি বিশ্বকাপ ফাইনালের কোনোটিই এমন বিশাল ব্যবধান নির্দেশ করেনি। বড় ইতিহাসের মধ্যে ছোট ছোট ইতিহাসও থাকে।
বিশ্বকাপ ফাইনালে প্রথম পরে ব্যাট করে জয় পাওয়ার মাধ্যমে সেরকমই একটা ছোট ইতিহাসও গড়েছে শ্রীলঙ্কা। টসে জিতে অর্জুনা রানাতুঙ্গা যখন প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সম্ভবত সবারই মনে হয়েছিল,লোকটা তো আচ্ছা গোঁয়ার। ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা নিতে রাজি নয়। মাঠে নেমে আসা দর্শকের ঢলে রাত সোয়া ১০টায় লাহোর যখন কলম্বো হয়ে গেল, বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরা রানাতুঙ্গা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, পৃথিবীতে সবাই ইতিহাসের বৃত্তে বন্দি থাকতে আসে না। কেউ কেউ ইতিহাস নতুন করে লেখে।
অর্জুনা রানাতুঙ্গা তা লিখেছেন। উইনিং স্ট্রোকটি তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে; যা হওয়া উচিত, সব সময় তা এমন ঘটে না। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের এই নতুন যুগের সূচনার সময় উইকেটে তাঁর সঙ্গীও যেমন। সমস্যায় জর্জরিত এই দলের ভার রানাতুঙ্গার সমান দায়িত্ব নিয়েই দীর্ঘদিন বয়ে এসেছেন অরবিন্দ ডি সিলভা।
রানাতুঙ্গা-ডি সিলভা যুগলের মধ্যেই শ্রীলঙ্কা তার স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি দেখেছে বারবার। এই ফাইনাল নিয়ে আগামী দিনে অনেক ক্রিকেট-কাব্যই রচিত হবে। হ্যামলেটের প্রিন্সের মতো যেটির মধ্যমণি হয়ে থাকবেন অরবিন্দ ডি সিলভা। ১২৪ বলে ১০৭ রানের হার না মানা ইনিংস। প্রথম দুই বিশ্বকাপের পর ফাইনালে প্রথম সেঞ্চুরি। যথেষ্ট ধারালো নয় বলে যে অফ স্পিন নিয়মিত করেন না, তাতেই বধ করেছেন তিন ক্যাঙ্গারুকে। তাঁর তালুবন্দি হয়ে বিষন্নতার মিছিলে শামিল হয়েছেন আরও দুজন। ইডেন গার্ডেনে ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালে চোখ ধাঁধানো এক ইনিংস খেলে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন।
ফাইনালে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের জন্য গোটা বিশেক পুরস্কার থাকলেও সব কটিই পেতেন মৃদুভাষী এই ক্রিকেটার। ৮৩-তে ভারতের মহিন্দর অমরনাথের পর এই প্রথম সেমিফাইনাল ও ফাইনালে দুটিতেই কেউ ম্যান অব দ্য ম্যাচ। সব বিশ্বকাপেই একটা আলাদা গল্প থাকে। ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ ওয়েস্ট ইন্ডিজের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার গল্প। ১৯৮৩-তে ভারত বিস্ময় উপহার দেওয়ার পর ১৯৮৭ বিশ্বকাপেও ফিরে এসেছে একই বিস্ময়, এবার যেটির রূপকার অস্ট্রেলিয়া। ১৯৯২ বিশ্বকাপেও বিস্ময় ছিল, যেটিকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল ইমরান খানের পাকিস্তানের রূপকথার মতো ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। এবার শ্রীলঙ্কার বিশ্বজয়কে কি বলা যায়? ফ্লাডলাইটের আলোতে বৃষ্টির কণাগুলো যখন তেরছা হয়ে পড়ছে মাঠে, উৎসবে মেতে ওঠা শ্রীলঙ্কানদের দিকে দেখতে দেখতে জ্বালা করে উঠল চোখ।
ভারত, পাকিস্তান আগেই হয়েছে। এবার উপমহাদেশের আরেক দেশ শ্রীলঙ্কাও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আইসিসির সহযোগী সদস্যদের প্রথম তিনেও থাকতে না পারা কোনো দেশের কারও জন্য অপরাধের পর্যায়ে পড়ে জেনেও অতৃপ্তির হাহাকারে ভরে উঠল মন। থাক, এখন এসব আক্ষেপের কথা থাক। বরং সবাই মিলে বরণ করে নেওয়া যাক নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে।
অভিনন্দন শ্রীলঙ্কা!