লিটনের ব্যাটিং মানে চোখের আরাম, মনের শান্তি
উৎপল শুভ্র
২৭ নভেম্বর ২০২১
ব্যাটিং জিনিসটা তো একটা কাষ্ঠদণ্ড দিয়ে সাড়ে পাঁচ আউন্স ওজনের গোলাকৃতি বলটাকে মারা বা ঠেকানোই…কিন্তু কারও কারও হাতে সেটিই উত্তীর্ণ হয় শিল্পের কাতারে। লিটনও পড়েন সেই দলে। লিটনের ব্যাটিং দেখা চোখের আরাম, মনের শান্তি।
টেস্ট ক্রিকেটে লিটন কুমার দাসের প্রথম ইনিংসটা ছিল ৪৪ রানের। ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে ওই টেস্টটার সর্বনাশ করে দিয়েছিল বৃষ্টি। প্রতিদিন সকালে এতটা রাস্তা ঠেলে ফতুল্লা গিয়ে অলস বসে থাকার বিরক্তিটা এখনো মনে করতে পারি। বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু খেলা হয়েছিল, তার প্রায় সবই ভুলে বসে আছি। মনে আছে শুধু লিটনের ওই ইনিংসটা আর জুবায়ের হোসেন লিখনের বোলিং। বিশেষ করে ওই গুগলিটা, আহা! বিরাট কোহলি যা একদমই বুঝতে না পেরে বোল্ড হয়েছিলেন।
এতদিন পর লিটনের প্রথম টেস্ট ইনিংস টেনে আনায় একটু অবাক হতেই পারেন, কিঞ্চিৎ বিরক্তও। তার ওপর আবার লিটন যেদিন পরম আরাধ্য প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন। কোথায় সেটি নিয়ে কথা বলব, তা না ছয় বছর আগের ৪৪ নিয়ে প্যাচাল! কারণ তো আছেই। সেঞ্চুরি তো একদমই টাটকা স্মৃতি। যেটির রেশ হয়তো আপনার মনে এখনো ছড়িয়ে আছে। কিন্তু ওই ৪৪-এর ওপরে তো সোয়া ছয় বছরের স্মৃতির ধুলো। দেখে থাকলেও যা ভুলে যাওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
ভুল বললাম। অস্বাভাবিকই। ওই ইনিংস দেখলে তা ভোলার কথা নয়। নইলে আমি তা এমন স্পষ্ট মনে করতে পারি কেন? জীবনের প্রথম টেস্ট ইনিংস খেলতে নেমে অমন জড়তাহীন ব্যাটিং এবং তা থেকে বিচ্ছুরিত অলস স্ট্রোক প্লের মায়া যে এখনো চোখে লেগে আছে।
ওই ইনিংসটা নিয়ে টিভি কমেন্ট্রিতে হার্শা ভোগলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শোনার পর তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। মাত্র ৪৪ রানই তো করেছেন লিটন, এ নিয়ে এত উচ্ছ্বাস কেন? কারণটা জানতাম না, তা নয়। তারপরও হার্শার মুখে তা শুনতে চেয়েছিলাম আর কি! কথা অনেকই হয়েছিল, যার একটা বিশেষভাবে মনে আছে, ‘দিস বয় ইজ স্পেশাল’।
সেই ‘স্পেশাল বয়’ অবশেষে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পেলেন। এর আগে দুবার সত্তরের ঘরে আটকে গেছেন, দুবার নব্বইয়ের ঘরে। এই সেঞ্চুরি তাই জট খোলার সেঞ্চুরি। আরও অনেক কিছুরই। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম দিন শেষে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি হয়ে কথা বলতে আসা ব্যাটিং কোচ অ্যাশওয়েল প্রিন্স সাংবাদিকেরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রসঙ্গ টেনে আনায় যারপরনাই বিরক্ত হলেন। দুটি যে দুই ফরম্যাট, একথা মনে করিয়ে দিলেন একাধিকবার। কে না তা জানে! তারপরও ৪ উইকেটে ৪৯ রানের ধ্বংসস্তুপ থেকে বাংলাদেশকে টেনে তোলা দুই ব্যাটসম্যানকে নিয়ে কথা বলতে গেলে যে অবধারিতভাবেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলে আসে।
ফরম্যাট আলাদা হতে পারে, কিন্তু মানুষ তো একজনই। এখানে দুজন এবং দুজনই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ব্যর্থতার বলি। একজনকে (পড়ুন লিটন) নাকি চিরতরেই টি-টোয়েন্টি দল থেকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। আরেকজনকে (পড়ুন মুশফিক) বাধ্যতামূলক বিশ্রাম। রঙিন পোশাক খুলে সাদা জার্সি পরলেই কি আর সেই দু:স্মৃতি মুছে ফেলা যায়! তাও যদি ব্যাপারটা শুধুই খেলায় সীমাবদ্ধ থাকত! লিটনের ক্ষেত্রে তা তো একদমই থাকেনি। ধর্ম নিয়ে, বিশ্বকাপের পর দুবাইয়ে ছুটি কাটানো নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে হারে ট্রল হয়েছে, তা অরুচিকর তো বটেই, কখনো কখনো নির্মমও। চাইলেই কি সেসব ভুলে যাওয়া যায়!
প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি এমনিতেই স্পেশাল, এই প্রেক্ষাপটের কারণে যা হয়ে উঠেছে আরও স্পেশাল। আর ইনিংসটা যে স্পেশাল, তা তো আর বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। ৪৯ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর নেমে এই সেঞ্চুরি, এটা অন্য কোনো ব্যাটসম্যান হলে বিশেষত্ব হিসেবে শুধু এটা উল্লেখ করলেই চলত। লিটনের ইনিংস যে বরাবরই এসব ছাপিয়ে অন্য লোকে উত্তীর্ণ। ব্যাটিংয়ের শেষ কথা তো রানই। তা রান তো অনেকেই করে। লিটনের মতো ব্যাটসম্যানরা যখন তা করেন, তখন তাতে রানের বাইরেও অনেক কিছু থাকে।
লিটনের ব্যাটিং দেখা চোখের আরাম, মনের শান্তি। ব্যাটিং জিনিসটা তো একটা কাষ্ঠদণ্ড দিয়ে সাড়ে পাঁচ আউন্স ওজনের গোলাকৃতি বলটাকে মারা বা ঠেকানোই…কিন্তু কারও কারও হাতে সেটিই উত্তীর্ণ হয় শিল্পের কাতারে। ফ্র্যাঙ্ক উলির ব্যাটিংয়ে ইংলিশ সামারকে খুঁজে পেতেন নেভিল কার্ডাস। উলিকে নিয়ে লেখা কার্ডাসের অমর কিছু লাইন তুলে দিতে ইচ্ছা করছে, ‘ক্রিকেট বিলংস্ এনটায়ারলি টু সামার এভরি টাইম দ্যাট উলি ব্যাটস্ অ্যান ইনিংস। হিজ ক্রিকেট ইজ কম্পাউন্ডেড অব সফট এয়ারস্ অ্যান্ড ফ্রেশ ফ্লেভার। দ্য ব্লুম অব দ্য ইয়ার ইজ অন ইট, মেকিং ফর সুইটনেস।’ নিজের মতো করে বুঝে নিন, বঙ্গানুবাদ করতে গিয়ে থমকে গেলাম, কারণ কার্ডাসের লেখার মূল সুর ধরে রেখে অনুবাদ করার সাধ্য আমার নেই। এই কথাগুলোই লিটন দাসের ব্যাটিং নিয়ে বললেও কার্ডাস আপত্তি করতেন বলে মনে হয় না।
ওই যে ‘সফট এয়ারস্’ আর ‘ফ্রেশ ফ্লেভার’ কথাগুলো...লিটন দাসের ব্যাটিংয়ের সঙ্গে কি তা অনায়াসে মেলানো যাচ্ছে না?