কিউই দুঃখরজনী আরও দীর্ঘ করে হলুদ উৎসব

উৎপল শুভ্র

১৫ নভেম্বর ২০২১

কিউই দুঃখরজনী আরও দীর্ঘ করে হলুদ উৎসব

আলিঙ্গনে বন্দি ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের দুই নায়ক মিচেল মার্শ ও ডেভিড ওয়ার্নার

শুধু এই একটা ট্রফিই ছিল না ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কেবিনেটে। একদিন না একদিন এই রহস্য ঘুচতই। তাই বলে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই? মনে হয় না কেউ ভেবেছিলেন। নিউজিল্যান্ডকে আরেকটি ফাইনাল হারার যন্ত্রণা উপহার দিয়ে উন্মাতাল উৎসবে মেতে ওঠা অস্ট্রেলিয়ার যে ঘোর দুঃসময় কেটেছে এই বিশ্বকাপের আগে।

৪৮ বলে ৮৫। কেন উইলিয়ামসন।

৪-০-৬০-০। মিচেল স্টার্ক।

ফাইনালের ভাগ্য এখানেই লেখা হয়ে গেছে বলে ভেবেছিলেন, এমন মানুষের সংখ্যা মনে হয় কম না। 

একটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ইনিংস (মারলন স্যামুয়েলসের একটা ৮৫ আছে, সেটা আবার অপরাজিত)। অন্যটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সবচেয়ে খরুচে বোলিং।

এই দুটির সম্মিলিত প্রভাবে দুই ইনিংসের বিরতির সময় স্কোরবোর্ডে দেখাচ্ছে ৪ উইকেটে ১৭২। প্রথমে বা পরে ব্যাটিং নির্বিশেষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে সর্বোচ্চ দলীয় ইনিংস। ম্যাচটা ফাইনাল বলে এই ১৭২-এর সঙ্গে আরও অদৃশ্য ১০-১৫ রান যোগ করে নেওয়া উচিত। ফাইনালের বাড়তি একটা চাপ আছে না?

সাত বল বাকি থাকতে ৮ উইকেট হাতে রেখেই অস্ট্রেলিয়ানরা যখন মেতে উঠেছে উন্মাতাল উৎসবে; ফাইনালের সর্বোচ্চ স্কোর, ফাইনালের অদৃশ্য চাপ...এ কথাগুলোকে কী অর্থহীনই না মনে হচ্ছে তখন! ম্যাচের শেষটাও হলো খুব প্রতীকী। এই বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে একেবারেই নিজের ছায়া হয়ে থাকা গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের যে শটটায় ফাইনালের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি, টি-টোয়েন্টির বিজ্ঞাপন হিসেবে এর চেয়ে আদর্শ আর কিই-বা হতে পারে!

উইলিয়ামসন আর স্টার্কের এই ছবিটাতে ফাইনালের প্রথম অর্ধেকের গল্প

প্রথম ১০ ওভারে ধুঁকতে ধুঁকতে ৫৭ থেকে পরের ১০ ওভারে ১১৫ রানের রকেটে চড়ে যেখানে পৌঁছে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড, তাতে মনে হতেই পারত, এই বিশ্বকাপের অলিখিত নিয়মটার বোধ হয় আজ ছুটি। কী সেই নিয়ম? টসে জিতে প্রথম ফিল্ডিং নাও, তাহলেই কাজ হয়ে গেল। যে রানই চেজ করতে হোক না কেন, নিশ্চিন্তে তা করে ফেলা যাবে। কে জানত, শেষ পর্যন্ত ফাইনালও টুর্নামেন্ট ধরে চলে আসা নিয়মটাই অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করবে। 

দুটি সেমিফাইনালও তা করেছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য নাটকীয়তায় শেষ হওয়া দুই সেমিফাইনালে একবারের জন্যও মনে হয়নি, শুধু ব্যাটিং করেছে বলেই জিতে গেছে নিউজিল্যান্ড আর ইংল্যান্ড। একটু এদিক-ওদিক হলেই ম্যাচের রেজাল্ট অন্যরকম হতে পারত। ৩৯তম ওভারে ঝট করে ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তো বরং প্রথমে ব্যাটিং করা দলকেই মনে হচ্ছিল সম্ভাব্য বিজয়ী। 

যে ট্রফির জন্য অস্ট্রেলিয়ার এমন ব্যাকুল অপেক্ষা, তা জয়ের আনন্দ তো এমনই হওয়ার কথা

কাকতালীয়ভাবে ফাইনালের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তিও ৩৯তম ওভারেই। তবে এর অনেক আগেই তো গা থেকে তা ঝেড়ে ফেলেছে সব অনিশ্চয়তা। বলতে গেলে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস দুই তৃতীয়াংশ পথ পেরোতে না পেরোতেই মীমাংসা হয়ে গেছে ট্রফির।

এতদিন যে ট্রফিটাই শুধু ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কেবিনেটে ছিল না। এক সময় চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও অস্ট্রেলিয়ার কাছে এমন মরীচিকা হয়ে ছিল। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে অপ্রতিদ্বন্দ্বী দলটা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ফেবারিট হিসেবে শুরু করেও ঠিকই তা না জেতার কোনো না কোনো একটা পথ করে নিত। অথচ শুধু নামেই না পার্থক্য, বিশ্বকাপের মতো ওই টুর্নামেন্টটাও তো ৫০ ওভারেরই।

সেই রহস্য যে একদিন না একদিন ঘুচবেই, এ নিয়ে অবশ্য সন্দেহ ছিল না কারোরই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও যে একদিন না একদিন অস্ট্রেলিয়া জিতবেই, এটা নিয়েও না। কিন্তু তাই বলে এবার? টি-টোয়েন্টির আগের ছয়টি বিশ্ব আসরের প্রায় প্রতিটিতেই ফেবারিটদের তালিকায় থাকা অস্ট্রেলিয়া এবার তো এসেছিল শুধুই সংখ্যা পূরণ করতে। অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে এমন কিছু বলা হচ্ছে, এ থেকেই তো বুঝে নেওয়া যায় অবস্থা কতটা খারাপ ছিল।

খারাপেরও তো ধরন থাকে। এই বিশ্বকাপের আগে টানা পাঁচটা টি-টোয়েন্টি সিরিজে হতমান হয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ানদের। সর্বশেষ তো বাংলাদেশের বিপক্ষেই। মিরপুরের মহা আলোচিত উইকেট, দলে ওয়ার্নার-ফিঞ্চ-ম্যাক্সওয়েলদের অনুপস্থিতি মনে রেখেও যে সিরিজে ৪-১-এ পরাজয় অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে বড় এক লজ্জা হিসেবেই লেখা আছে। টি-টোয়েন্টিতে নিজেদের সর্বনিম্ন স্কোরে আউট হওয়াটাও যে আছে ওই সিরিজের ‘ভুলে যেতে পারলে ভালো’ তালিকায়। অস্ট্রেলিয়ার টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে এমন তমসাময় রাত আগে কখনো আসেনি। এ কারণেই বিশ্বকাপ শুরুর কদিন আগে অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ যখন বলেছিলেন ‘বিশ্বকাপ জেতার মতো দল আমাদের আছে’, কেউ তা সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন বলে মনে হয় না। বরং প্রায় সবার কাছেই সেটির একটাই অর্থ দাঁড়িয়েছিল। অধিনায়ককে তো এমন বলতেই হয়।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম হলুদ উৎসব

দুবাইয়ের আলো ঝলমলে রাতে বিশ্বকাপ ট্রফিটা হাতে নিয়ে অ্যারন ফিঞ্চ চাইলে কথাটা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে পারতেন। স্বাভাবিকভাবেই তার কোনো প্রয়োজন দেখেননি। সবাই তো দেখছেই, এটা একটা কারণ। কেন যেন মনে হয়, আরেকটা কারণও আছে। ফিঞ্চ কথাটা বলেছিলেন বটে; তবে কত পার্সেন্ট বিশ্বাস থেকে আর কত পার্সেন্ট আবেগ, এ নিয়ে তাঁর নিজের মনেও একটা কাটাকুটি খেলা চলতেই পারে।

ফাইনালের আগে দুই অধিনায়ক প্রায় একই পথের যাত্রী। দুজনই নির্ভেজাল ব্যাটসম্যান এবং দুজনের ব্যাটেই কোনো রান নেই। ফাইনালেও যে ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন ফিঞ্চ। আর উইলিয়ামসন? টুর্নামেন্টে এর আগে সর্বোচ্চ অপরাজিত ৪০। ছয় ইনিংসে রান মোট ১৩১, সেটিও ৯৪ স্ট্রাইক রেটে। ফাইনালে সেই উইলিয়ামসনের ব্যাট থেকেই কিনা ১৭৭ স্ট্রাইক রেটের এক ইনিংস। ৪৮ বলে ৮৫ রান বললে যা বোঝায়, মোটেই তেমন মার মার কাট কাট মেজাজের ইনিংস নয়। উইলিয়ামসনীয় লালিত্য আর মাধুর্য্য যাতে ঠিকই অক্ষুন্ন। হ্যাজলউড ক্যাচ ফেলে দেওয়ায় মিচেল স্টার্কের বলে নতুন জীবন পেয়েছেন। এক ওভারে চারটি চার আর একটি ছক্কায় ২২ রান তুলে সেই স্টার্কের জীবনই দুর্বিষহ করে তুলেছেন একটু পরই। ৩২ বলে ফিফটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে দ্রুততম। খুবই স্বল্পায়ু এক রেকর্ড। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই যে মিচেল মার্শ রেকর্ডটি আরও এক বল কমিয়ে দিয়েছেন।

সাদা বলের বিশ্বকাপ মানেই এমন একটা ছবি!

উইলিয়ামসনকে যা করার একাই করতে হয়েছে। মিচেল মার্শ যেখানে পাশে পেয়েছেন ডেভিড ওয়ার্নারকে। দুইয়ে মিলে আরও দীর্ঘ নিউজিল্যান্ডের দুঃখরজনী। এক সময় নিউজিল্যান্ডকে বলা হতো 'সেমিফাইনালের দল'। ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে সেই তকমা ঝেড়ে ফেলা গেছে। তবে উন্নতি বলতে ওটুকুই। 'সেমিফাইনালের দল' এখন 'লুজিং ফাইনালিস্টদের দল'। ৫০ ওভারের টানা দুটি বিশ্বকাপের পর ২০ ওভারের বিশ্বকাপও যেটির সাক্ষী হয়ে থাকল।

ওই দৃশ্যটাও এখন বিশ্বকাপ শেষের নিয়মিত চিত্র। হতাশ, বিষন্ন কেন উইলিয়ামসনের উদাস মুখ। 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×