যে ছয় কারণে এখনই স্মরণীয় এই বিশ্বকাপ

উৎপলশুভ্রডটকম

৮ নভেম্বর ২০২১

যে ছয় কারণে এখনই স্মরণীয় এই বিশ্বকাপ

ছবি : গেটি ইমেজেস

সেমিফাইনালের চার দল চূড়ান্ত। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এখন চূড়ান্ত নাটকের অপেক্ষায়। তা নাটকীয় বলুন, বা ব্যতিক্রমী ঘটনা; তা এরই মধ্যে এই বিশ্বকাপে কম ঘটেনি। সেগুলোর একটা তালিকা করে ফেললে কেমন হয়, বলুন তো!

বিরাট কোহলির টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ারের এমন সমাপ্তি!

১.
এক ম্যাচ বাকি থাকতেই ভারতের বিদায়

আপাতত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ মানেই ভারতের সেমিফাইনালে উঠতে না পারার টাটকা স্মৃতি। টপ ফেবারিট হয়েও সুপার টুয়েলভ থেকেই ভারতের বিদায় এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার তালিকায় অবশ্যই থাকবে। এক নম্বরেই কি না, তা নিয়ে অবশ্য তর্ক হতেই পারে। তবে লেখার শুরুটা কেন ভারতকে দিয়েই হলো, সেটির কারণ তো অনুমেয়ই। সেমিফাইনালের আশা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আজ শেষ ম্যাচ খেলতে নামতে হচ্ছে ভারতকে। বিশ্বকাপের আগেই টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেওয়া বিরাট কোহলির দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করার কথা নয়, সেই শেষটা হবে নামিবিয়ার বিপক্ষে অর্থহীন এক ম্যাচে! 

টানা সপ্তম আইসিসি টুর্নামেন্ট থেকে ভারতের শূন্য হাতে বিদায়ের সঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক এক তথ্য হলো, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ফ্ল্যাগশিপ টুর্নামেন্ট আইপিএল শুরু হওয়ার পর কখনো বিশ্বকাপ জেতেনি ভারতের। যখন কেউ আশা করেনি, সেই তখন, ২০০৭ সালে প্রথম টুর্নামেন্টেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তারুণ্যে ঝলমলে ধোনির ভারত। এরপর থেকে শুধুই হতাশার গল্প। এবারেরটা হয়তো ছাড়িয়ে গেল আগের পাঁচবারের ব্যর্থতাকেও।  

শিরোপা জিততে না পারলেও এই বিশ্বকাপ ভুলবে না পাকিস্তান
২.
পাকিস্তানের ভারত-জুজু জয়

টুর্নামেন্টের নামের সঙ্গে বিশ্বকাপ থাকলে, তা যত ওভারেরই হোক না কেন, ভারতকে হারাতে পারবে না পাকিস্তান। বিশ্বকাপের বাইরে জিতবে, এমনকি প্রায় বিশ্বকাপের রূপ নেওয়া চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও। কিন্তু 'বিশ্বকাপ' এলেই পাকিস্তান পপাত ধরণীতল। ২৯ বছর ধরে বারবার একই ঘটনা ঘটতে ঘটতে তা পরিণত হয়েছিল ক্রিকেটের সবচেয়ে অব্যাখ্যনীয় রহস্যে। সেই রহস্য ঘুচে গেছে এবার। সেটিও কী অবিশ্বাস্য এক জয়ে! প্রথম ম্যাচেই পাকিস্তানের বিপক্ষে ১০ উইকেটে সেই পরাজয়ই ভারতের বিদায়বাণীর প্রথম চরণটি লিখে দিয়েছিল। এক সপ্তাহ পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও হারে যা এক রকম নিশ্চিত হয়ে যায়।আফগানিস্তান ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে পরের দুই ম্যাচে দাপুটে জয় নিয়ে কত রকম আলোচনা! সেমিফাইনালে উঠতে শেষ পর্যন্ত সেই আফগানিস্তানের দিকেই তাকিয়ে ছিল ভারত। শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, তা তো আপনার জানাই।

ভারত-পাকিস্তান ম্যাচটির মতোই দুই দলের এবার পুরো বিপরীত চেহারা। এবারের আগে কখনোই সব ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে ওঠার কীর্তি ছিল না পাকিস্তানের। এমনকি ২০০৯ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিশ্বকাপেও। 

৩.
ক্যাম্ফারের চার বলে চার উইকেট
 
শুধুমাত্র ভারত-পাকিস্তানের কারণেই এবারের বিশ্বকাপ আলাদা নয়। পেছনে ফিরে তাকালে প্রাথমিক পর্বে নেদারল্যান্ডস-আয়ারল্যান্ডের ম্যাচে আইরিশ বোলার কার্টিস ক্যাম্ফারের চার বলে চার উইকেট শিকারের স্মৃতিও ফিরে আসবে। বিশ্বকাপে এই কীর্তি এবারই প্রথম। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে চার বলে চার উইকেট নিয়ে 'ডাবল হ্যাটট্রিক' আছে শ্রীলঙ্কার লাসিথ মালিঙ্গা ও আফগানিস্তানের রশিদ খানেরও। টি-টোয়েন্টির সেরা বোলারদের সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও যে দুজনের নাম থাকে, তাঁদের পাশে নাম লেখানোটা কার্টিস ক্যাম্ফারের জন্য বাকি জীবন গল্প করার মতোই এক অর্জন।

এক বিশ্বকাপেই তিন হ্যাটট্রিক! বাঁ থেকে: কার্টিস ক্যাম্ফার, ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা ও কাগিসো রাবাদা৪.
এক আসরেই তিন হ্যাটট্রিক

ছয়টি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষেও একটা ক্ষেত্রে এক এবং অনন্য হয়ে ছিলেন ব্রেট লি। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসরেই হ্যাটট্রিক করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান এই ফাস্ট বোলার। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে একমাত্র হ্যাটট্রিক বলে সবারই তা ঠোঁটস্থ ছিল। এদেশের ক্রিকেট অনুসারীদের তা আরও বেশি থাকার একটা কারণ, সেই হ্যাটট্রিক ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষেই। এরপর একে একে হ্যাটট্রিকশূন্য পাঁচটি বিশ্বকাপ কেটেছে, আর এবার কিনা এক বিশ্বকাপই দেখে ফেলল তিন-তিনটি হ্যাটট্রিক! যেটিকে বলতে পারেন 'হ্যাটট্রিকের হ্যাট্রিক'।

প্রাথমিক পর্বে কার্টিস ক্যাম্ফারের পর মূল পর্বে হ্যাটট্রিক-কীর্তিতে তাঁর সঙ্গী হয়েছেন শ্রীলঙ্কার ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা ও দক্ষিণ আফ্রিকার কাগিসো রাবাদাও। ব্রেট লির দল ২০০৭ বিশ্বকাপের সেমিতে জায়গা করে নিলেও ফাইনালে যেতে পারেনি। আর এবার তো সেমিফাইনাল আসতে আসতে দেখা গেল, তিন হ্যাটট্রিক-ম্যানের কেউই সেখানে নেই। 

৫.
চার ম্যাচ জিতেও বাদ দক্ষিণ আফ্রিকা

ক্যাম্ফার ও হাসারাঙ্গার দল সেমিফাইনালে না-ই থাকতে পারে, সেখানে কেউ তাদের আশাও করেননি। ক্যাম্ফারের আয়ারল্যান্ড তো সুপার টুয়েলভেই উঠতে পারেনি। হ্যাটট্রিক করা তিন বোলারের মধ্যে সেমিফাইনালে উঠতে না পারার কষ্টটা তাই শুধু কাগিসো রাবাদারই। বিশ্বকাপের মতো বড় আসর আগে থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য অনন্ত এক হতাশার নাম হয়ে আছে। তবে দারুণ খেলেও কোনো না কোনোভাবে হেরে বিদায় নেওয়ার ঘটনাটা ঘটত মূলত নকআউট পর্বে। 'চোকার' হিসেবে অপবাদটাও যে কারণে ছায়াসঙ্গী হয়ে গেছে। এবারের ঘটনাটা ব্যতিক্রমী। সুপার টুয়েলভে পাঁচ ম্যাচের চারটিতে জিতেও দক্ষিণ আফ্রিকাকে সেমিফাইনালে দর্শক হয়ে থাকতে হচ্ছে নেট রান রেটের মারপ্যাঁচে। মূল পর্বে একটি ম্যাচও জিততে না পারা বাংলাদেশই শেষ পর্যন্ত নির্ধারক হয়ে গেছে এই গ্রুপের সেমিফাইনালিস্ট চূড়ান্ত করায়। অস্ট্রেলিয়া তো কাজের কাজটা বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচেই করে রেখেছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা পিছিয়েও পড়েছে সেখানেই।  

শেষটা রাঙানো হলো না ক্রিস গেইল আর ডোয়াইন ব্রাভোর

৬.
ক্যারিবীয় টি-টোয়েন্টি প্রজন্মের করুণ সমাপ্তি

টি-টোয়েন্টি খেলাটা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের চরিত্রের সঙ্গে খুব যায়। যেটির প্রমাণ একমাত্র দল হিসেবে দুটি বিশ্বকাপ জয়। প্রমাণ হিসেবে ছিলেন ক্রিস গেইল, ডোয়াইন ব্রাভো, কাইরন পোলার্ডরাও। বিশ্ব জুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে কাড়াকাড়ি তাঁদের নিয়ে। একেকজন টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালায় পরিণত হয়ে আবির্ভূত ক্রিকেটের নতুন পৃথিবীর প্রতিনিধি হিসেবেও। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে অনিয়মিত থাকলেও বিশ্বকাপে সবাই এসে মিলতেন এক সঙ্গে। এবারও মিলেছিলেন শেষটা রাঙিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। অথচ কী করুণ সমাপ্তিই না হলো সেই স্বপ্নের! বাংলাদেশের বিপক্ষে একমাত্র জয়, গ্রুপ ওয়ানে ছয় দলের মধ্যে পঞ্চম! অবসর নিয়ে ফেলেছেন ডোয়েইন ব্রাভো। বিশ্বকাপে নিজের শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন ক্রিস গেইলও। গেইলের পারফরম্যান্সকেই ধরতে পারেন এই বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতীকী চিত্র। 

ব্যতিক্রমী আরও কিছুর আগাম প্রস্তুতি
মনে রাখার মতো অনেক কিছুই বলা হলো। যার কিছু আবার ব্যতিক্রমীও। ব্যতিক্রমী আরও কিছুর জন্য আগাম প্রস্তুতিও নিয়ে রাখতে পারেন। সেটা অনেকভাবেই ঘটতে পারে। যেমন ধরুন, অস্ট্রেলিয়া জিতলে তা হবে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের সফলতম দলের ২০ ওভারের বিশ্বকাপে প্রথম শিরোপা। ইংল্যান্ড জিতলে সাদা বলে পরপর দুটি বিশ্বকাপ জয়ের অনন্য কীর্তি গড়া হয়ে যাবে। নিউজিল্যান্ড জিতলে একই বছরে কেন উইলিয়ামসনের হাতে উঠবে দ্বিতীয় আইসিসি ইভেন্টের ট্রফি। প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের স্মৃতিতে এখনো খুব বেশি ধুলা পড়েনি।

সেমিফাইনালের অন্য যে দল, সেই পাকিস্তান জিতলেও তো সেটির তাৎপর্য শুধুই এই বিশ্বকাপ জয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তির অংশীদার হয়ে যাবে তারা।

সেমিফাইনালের চার দলের যে কোনোটি শিরোপা জিতলেই যেহেতু বলার মতো বাড়তি কিছু না কিছু হচ্ছে, এই বিশ্বকাপের স্মরণীয় হয়ে থাকা নিয়ে তো আর কোনো সংশয়ই থাকার কথা নয়।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×