ভুলে ভরা গল্প
উৎপলশুভ্রডটকম
৫ নভেম্বর ২০২১
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ শেষ। ব্যাটিং-বোলিং মিলেই ব্যর্থ এক বিশ্বকাপ। তবে বাংলাদেশের ব্যাটিং পারফরম্যান্সেই যেন বেশি ফুটে উঠছে সেই প্রতিচ্ছবি। ব্যাটসম্যানদের ব্যক্তিগত রান, গড় আর স্ট্রাইক রেট দেখলেই যা বুঝতে পারবেন আপনিও।
বাংলাদেশের এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শেষটা হলো অস্ট্রেলিয়ার নেওয়া নির্মম প্রতিশোধের মধ্য দিয়ে। মিরপুরের দেনা গতকাল দুবাইয়ে শুধল তারা। সব মিলে এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দলগত, ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিংয়ে যা পারফরম্যান্স, তা সত্যিকার অর্থে বলার মতো কিছু না। বলতে গেলে তা দুঃস্বপ্নের মতো। কখনো কখনো দল লাগাতার ব্যর্থ হলেও তার মধ্যে থাকে কিছু ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের ঝলক। বাংলাদেশ দলে সাকিব আল হাসানের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স বাদ দিলে সেই ঝলকটা ছিল অনুপস্থিত।
ব্যাটিংয়ে নিদারুণ দীনতা। বোলিংয়ে অনিয়ন্ত্রিত। ফিল্ডিং ভুলে ভরা। ক্যাচ-ট্যাচ ফেলে যা তা অবস্থা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটা বাংলাদেশ যে বের করতে পারল না, তার মূল কারণ সহজ ক্যাচ ফেলে দেওয়া। আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে শেষ ওভারে ১৩ রানের হিসেব যে মেলানো গেল না, তার পেছনে পাওয়ার হিটিংয়ে বড় দুর্বলতাই শুধু নয়, স্কিলের প্রয়োগের অভাবও ছিল স্পষ্ট। আবার এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সমালোচনায় বিদ্ধ হওয়ার শুরু যে ম্যাচে, সেই স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের দল হয়ে খেলতে না পারার ব্যর্থতা ছিল মূর্ত।
এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটিং-বোলিংয়ের পরিসংখ্যানে তাকালে আপনার প্রথমেই মনে হবে আসলে এটা তো বাংলাদেশের নিয়মিত পারফরম্যান্সের প্রতিচ্ছবি নয়। বেশিরভাগের ক্যারিয়ার গড়ের সাথে বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের মিল নেই। দলের সেরা খেলোয়াড়রা ৮টি করে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু অলরাউন্ড পারফরম্যান্স ধরলে সবার চেয়ে এগিয়ে ইনজুরির কারণে শেষ দুটি ম্যাচ খেলতে না পারা সাকিব। আর সবচেয়ে আশাহত করা নামটি হলো তরুণ আফিফ হোসেন ধ্রুব। অস্তগামী সূর্য যখন খরতাপ বিলিয়ে গেল, তখন উদয়াচলের রবির ছিল কিরণের অভাব।
সাকিব ৪০ প্লাস দুটি ইনিংস খেলেছেন প্রথম রাউন্ডে। পরের রাউন্ডে তাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। শেষের দুই ম্যাচে উইকেট পাননি। কিন্তু বাংলাদেশের জেতা দুই ম্যাচেরই সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন। সাকিবের মোট রান ১৩১। গড় ২১.৮৩। স্ট্রাইক রেট ১০৯.১৬। উইকেট ১১টি। গড় ১১.১৮। ইকোনমি ৫.৫৯। আর আফিফের ব্যাটিং নিতান্ত প্রতিভার অপচয়ের মতো। ক্রমে অবনতি হয়েছে তাঁর। ইনিংসগুলো যথাক্রমে ১৮, ১, ২১, ৭, ৫, অপরাজিত ২, ০ ও ০। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সম্মিলিত ব্যাটিংই হতাশার। ২২ বছরের আফিফ হতাশার চূড়ান্ত করেছেন, এই যা!
আফিফের মতো ৮টি করে ম্যাচ খেলেছেন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস ও মাহেদি হাসানও। ব্যাটসম্যানদের গড় দেখে যেমন হতাশ হবেন, তার চেয়ে বেশি হতাশ হবেন এদের স্ট্রাইক রেট দেখে। ৮ ম্যাচ খেলাদের চেয়ে অবশ্য ৭ ম্যাচ খেলা ওপেনার মোহাম্মদ নাঈম আছেন এগিয়ে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান তাঁর। ২৪.৮৫ গড় আর ১১০.৮২ স্ট্রাইক রেটে ১৭৪। আট ম্যাচ খেলার পরও বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ফিফটি মাত্র ৪টি। তার দুটি নাঈমের। ওমানের বিপক্ষে ৬৪ রানের পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৬২। তবে অন্য ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁরও আসরের শেষ দিকে এসে অবনতি হয়েছে।
সবাই মিলে ব্যর্থ না হলে এবং এটা আইসিসি ইভেন্ট না হলে ক্যাপ্টেন মাহমুদউল্লাহর পারফরম্যান্সকে মোটামুটি ভদ্রস্থ বলা যেত। গড় ও স্ট্রাইক রেটে তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে। দলের দ্বিতীয় সর্বোচ রান সংগ্রাহক। পিএনজির বিপক্ষে একমাত্র ফিফটিটার পাশে অন্য ইনিংসগুলো অবশ্য এমন বলার মতো কিছু নয়। ২৮.১৬ গড় ও ১২০.৭১ স্ট্রাইক রেটে মাহমুদউল্লাহর রান ১৬৯। দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম ব্যর্থতার এক প্রদর্শনীই মেলে ধরেছেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৫৭ ছাড়া মনে রাখার মতো কিছুই নেই।শেষ তিন ম্যাচে রান মাত্র ৯। মোট রান ১৪৪। ক্যারিয়ার গড়ের (১৯.৭৯) চেয়ে অবশ্য সামান্য বেশি গড় (২০.৫৭) আর ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেটের (১১৫.৩৫) চেয়ে সামান্য কম স্ট্রাইক রেট (১১৩.৩৮) এখানে।
যাঁদের কথা বলা হলো, তাঁদের ব্যাপার যেমন তেমন, লিটন দাস ও সৌম্য সরকার পরের সিরিজে দলে জায়গা পেলে অবাক হতে হবে। বোলিং না থাকলে মাহেদি হাসানের এবং কিপিং না থাকলে নুরুল হাসানের ব্যাপারেও একই বলা যেত। এই চারের অবস্থা বড়ই করুণ। সুযোগের পর সুযোগ পেয়ে স্রেফ তা অপচয় করেছেন লিটন। এই আসরে তাঁর ইনিংসগুলো যথাক্রমে ৫, ৬, ২৯, ১৬, ৯, ৪৪, ২৪, ০। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৪৪ রানের ইনিংস বাদ দিলে তাঁকে নিয়ে বলার কিছু নেই। ৪টি ম্যাচে সুযোগ পেয়েও সৌম্যর (গড় ৬.৭৫) রান মোটে ২৭। নুরুল ৫ ম্যাচের ৪ ইনিংসে করেছেন ২১ রান। মাহেদির ঘরোয়া ব্যাটিংয়ের উল্টোটা ঘটছে আন্তর্জাতিকে। ৫৩ রান করেছেন সাকুল্যে। দল বিপদে পড়লে ভরসা হয়ে উঠতে পারেননি। বরং তিনি ও সোহান দলকে আরো বিপদে ঠেলে দিয়ে এসেছেন। দুটি ম্যাচে সুযোগ পেয়ে শামীম হোসেনও বড় কিছু করতে পারেননি।
আসলে কিছু করতে পারেনি পুরো দলই। রানের খেলা টি-টোয়েন্টিতে ব্যাটসম্যানরা সবাই দল বেঁধে ব্যর্থ হলে আর কিছু করার আশা থাকে কোথায়! এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের গল্পটা তাই শুধুই ভুলে ভরা!