উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
লাল জার্সির ব্যর্থতা
ইফতেখার নিলয়
৩ নভেম্বর ২০২১
বেদনার রং নাকি নীল হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য বেদনার রং দিনে দিনে যে লাল প্রমাণিত হয়ে যেতে শুরু করেছে! ব্যাপারটা এখন এমন হয়েছে যে, লাল জার্সি পরে খেলতে নামলেই বাংলাদেশ হারবে। খেলতে নামার আগেই হার নিশ্চিত! দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে নতজানু পরাজয়ের পর লাল জার্সিতে বাংলাদেশের ব্যর্থতার গল্পটাই উঠে এলো এক পাঠকের লেখায়।
হারতে হারতে ক্লান্ত হয়ে গেলে হঠাৎ দুয়েকটা জয়ের দেখা তো চাই-ই চাই। খেলোয়াড়-দর্শক সবাই ক্লান্ত। সেই ক্লান্তি আরও বেড়েছে টস হারে, সেখান থেকেই হার শুরু প্রোটিয়াদের বিপক্ষে। যদিও, বাংলাদেশের পরাজয় তো নিশ্চিত হয়ে গেছে টসের আগেই।
নাহ! কোনো ষড়যন্ত্র করে হারানো হয়নি। লাল জার্সি গায়ে নেমেই নিজেদের ভাগ্যেরও লাল বাতি জ্বালিয়েছে বাংলাদেশ। লাল জার্সি পরে খেলতে নামছে বাংলাদেশ, এতেই তো নিশ্চিত হয়ে গেছে পরাজয়৷ এই জার্সিতে কবেই বা জিতেছে বাংলাদেশ?
জার্সির রং আর মাঠের করুণ পারফরম্যান্স! এই দুইয়ের অপূর্ব মিতালিতেই তো আরেকটি পরাজয়ের গল্প। এতদিন যে জার্সিতে বাংলাদেশকে হারানোয় পাকিস্তান অদ্বিতীয় ছিল, সে তালিকায় এখন ভাগ বসিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। নিজেদের আধিপত্যে আরেকজনের দখলদারিত্ব দেখে মন খারাপ হতেই পারে পাকিস্তানের।
দুই দলের জার্সি একই রঙের হলে যেকোনো এক দলকে অন্য রঙের জার্সি গায়ে দিয়ে মাঠে নামতে হয়৷ এখন অনেকেই হয়তো আফসোসে পুড়ছেন, ২০১৯ বিশ্বকাপে প্রোটিয়ারা হলুদ জার্সি না পরলেই তো বাংলাদেশকে লাল গায়ে দিতে হতো। লাল জার্সি গায়ে জয়ের খাতাও আর শূন্য থাকত না৷ তবে লাল জার্সি যেমন 'কুফা', তাতে তখন বাংলাদেশ জিতত কি না, কে জানে!
আফসোস আসলে প্রোটিয়াদেরই বেশি হওয়ার কথা, বাংলাদেশ লাল জার্সি গায়ে জড়ালে তাদের হারতে হতো না এই ভেবে। তাহলে বিশ্বকাপেও তারা টিকে থাকত। বাংলাদেশের কাছে পরাজয়ের কারণেই তো দক্ষিণ আফ্রিকা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এবার তা বুঝেই নিজেরা জার্সি না বদলে বাংলাদেশকে বাধ্য করেছে কিনা কে জানে! হলেও হতে পারে, আজকাল প্রতিপক্ষের কত শত দুর্বলতার খোঁজই তো রাখা হয়!
যাই হোক... এগুলো সব পরাজয়ের গ্লানি মন থেকে মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা। অনেকের হয়তো কুসংস্কার বলে নাকও সিটকানো শেষ এতক্ষণে। সব ছেড়ে বাস্তবে ফেরা যাক। এই জার্সিতে পরাজয়-যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইডেন গার্ডেনে পাকিস্তানের কাছে ৫৫ রানে হেরে। তার ধারাবাহিকতা এসে পৌঁছেছে শারজায়।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচের কথা আলোচনা করলে বাকি সব ম্যাচের মতোই নিজেদের ব্যর্থতায় হারতে হয়েছে, সে বিষয়টিই শিরোনাম আকারে সামনে চলে আসবে। টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামার পর থেকেই তো হারার আগেই হেরে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।
টি-টোয়েন্টিতে সচরাচর স্লিপে ফিল্ডার দেখা যায় না। বাংলাদেশকে আজ দুই স্লিপ দিয়ে আক্রমণ করেছে প্রোটিয়ারা। মুশফিক, রিয়াদ আর আফিফের আউট দেখলেই বোধগম্য হয় তিনজনই মুহূর্তেই পরাজিত হয়েছেন। যত দ্রুত মাঠে এসেছেন তার চেয়েও দ্রুতগতিতে আউট হয়ে সাজঘরে ফিরেছেন। ফলে, বিশ্বকাপকে বিদায় জানানোর পাশাপাশি কাটানো যায়নি এই জার্সির কুফা। বরঞ্চ বেড়েছে কুফার স্থায়িত্ব।
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইডেন গার্ডেনে আফ্রিদির ব্যাটে-বলে যে ঝড় উঠেছিল, তা ভুলে যাওয়ার নয়। পাকিস্তানের ২০২ রানের জবাবে সাকিবের অপরাজিত ৪০ বলের মন্থর গতির ৫০ রানের ইনিংস সেদিন হারের ব্যবধান সেই অর্থে কমাতে পারেনি। তাই পরাজয়টা ৫৫ রানের। টি-টোয়েন্টিতে পরাজয়ের এই ব্যবধানটা বিরাট। মনে রাখার মতো আছে কেবল আরাফাত সানির বলে হাফিজের স্লগ সুইপে কাউ কর্নারে ছয় হতে যাওয়া বল লুফে নিয়ে বাউন্ডারিতে ঝুঁকে পড়ার আগেই শূন্যে ভাসিয়ে মাঠে ফিরে আবারও তালুবন্দি করা সৌম্যের ক্যাচ।
এই জার্সিতে পরের পরাজয়টাও একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে এক বছর পর। আসলে এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে লাল জার্সির বাংলাদেশের বিপক্ষে জয়ী দল ছিল শুধুই পাকিস্তান। তাই আবারও পাকিস্তানের বিপক্ষে পরাজয়ের কথাই উঠে আসছে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির প্রস্তুতি ম্যাচে তামিমের ১০২ ও ইমরুল কায়েসের ৬১ রানে ভর করে পাকিস্তানের সামনে ৩৪২ রানের লক্ষ্য দাঁড় করিয়ে ২৪৯ রানে ৮ উইকেট ফেলে দিয়েও ২ উইকেটে হারতে হয়েছিল। প্রস্তুতি ম্যাচের জয় পরাজয়কে আমলে নেওয়া হয় না। তাই সেভাবে আলোচনায় নেই সেই ম্যাচ।
দুই বছর পর সময়টা এবার ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ভেন্যুও ঘুরেফিরে সেই ইংল্যান্ড। গ্রুপ পর্বে দুই দলের শেষ ম্যাচ। তার আগেই ভারতের বিপক্ষে হেরে নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের বিদায়। পাকিস্তানের যতটুকু আশা বেঁচে আছে, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে জিততে হবে অনেক বড় ব্যবধানে। বাংলাদেশ বলা যায় পাকিস্তানকে বড় ব্যবধানে জেতানোর সব চেষ্টাই করেছে, নইলে কি আর লাল জার্সি গায়ে দিয়ে মাঠে নামে ?
অথচ, দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর আগেই পাকিস্তানের বিদায় নিশ্চিত হওয়ায় ম্যাচ পরিণত হয়ে যায় নিয়ম রক্ষায়। কেননা, পাকিস্তানকে জিততে হতো তিন শ রানেরও বেশি ব্যবধানে। সেখানে পাকিস্তান বাংলাদেশকে টার্গেটই দেয় ৩১৬। এরপরও পাকিস্তান ছেড়ে কথা বলে নি। বাংলাদেশকে হারিয়েছে ৯৪ রানে। আগেই বিশ্বকাপে বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় শরীরী ভাষাটাও সেদিন যাচ্ছেতাই ছিল বাংলাদেশের। ক্ষীণ আশা থাকলেও সমীকরণ ছিল অসম্ভব কঠিন, তবুও জয় ছাড়া মাঠ না ছাড়ার প্রত্যয় লক্ষ্য করা গিয়েছিল পাকিস্তানের কাছে।
সেদিনের সেই ম্যাচ জেতা গেলে বিশ্বকাপের সেমিতে খেলা না গেলেও স্মরণীয় এক ম্যাচ হয়ে থাকত বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে। কেননা, নয় বছর পর বাংলাদেশ ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে খেলতে নেমেছিল। পাকিস্তানের বিপক্ষে জিততে পারলে এই লাল জার্সিতেই অভিষেক ঘটতে পারত লর্ডসে নিজেদের প্রথম জয়ের। কিন্তু তা আর হলো কই! ৯৪ রানের হতাশাজনক পরাজয়ে বহু প্রতীক্ষার সেই বিশ্বকাপ শেষ হয় এক বুক হতাশা নিয়ে। লালও যে বেদনার রঙ হতে পারে, তা বুঝিয়েছে বাংলাদেশ দল।
লাল জার্সির আরেক গল্প আছে... সেই গল্পের জন্য আবারও ফিরে যেতে হবে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে৷ তবে সুপার টেনে নয়, সুপার টেনের আগে প্রাথমিক পর্বে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে এই জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছিল টাইগাররা। বৃষ্টিতে ২০ ওভারের ম্যাচে ১২ ওভারে নেমে এলে ৮ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে ৯৪ রান পর্যন্ত করার পর আবারও বৃষ্টি নামে ধর্মশালায়।
এরপর সেই ম্যাচের আর এক বলও মাঠে গড়ায়নি। পয়েন্ট ভাগাভাগিতে সমাপ্তি ঘটে ম্যাচের। পুরো ম্যাচ মাঠে গড়ালে সেদিন হয়তো এই জার্সিতে জয় পাওয়ার একটা ভালো সম্ভাবনা ছিল। কারণ, সেদিন ছাড়া লাল জার্সিতে আর কখনোই নির্ভার হয়ে খেলতে দেখা যায়নি বাংলাদেশ দলকে। পুরো ম্যাচ মাঠে গড়ালে লাল জার্সির প্রথম দিনেই জয়টা জুটে যেত। লাল জার্সির প্রথম দিনেই বৃষ্টি নেমে যে বেদনার এক অধ্যায় শুরুর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল, তা বুঝতে এই বিশ্বকাপ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো।
লাল জার্সি গায়ে ম্যাচের সংখ্যা বেশি না হলেও, সবগুলোই পরাজয়ে শেষ হওয়ায় লাল যেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের বেদনার রঙে রূপ নিয়েছে। তারপরে চিরন্তন সত্য হলো— জয় নির্ভর করে মাঠের পারফরম্যান্সের ওপর। জার্সি বা অন্য কিছুকে পরাজয়ের কারণ ধরাটা শুধুই মজার জন্য মজা।