উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
ভারতকে `সুবিধা` দিতে গিয়ে যেভাবে বুমেরাং আইসিসির সূচি
আজহারুল ইসলাম
২ নভেম্বর ২০২১
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সূচি করার সময় ভারতকে কি বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়েছিল? দিলে কী কারণে...সেটাই কিভাবে বুমেরাং হয়ে টুর্নামেন্টের এক সপ্তাহের মধ্যেই ভারতের বিদায় প্রায় নিশ্চিত করে দিল, তারই বিশ্লেষণ এই লেখায়।
ভারতের কথা মাথায় রেখেই কি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সূচি করা হয়েছিল? এমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক। অনেক দিন ধরেই আইসিসি 'পেটে খেলে পিঠে সয়' টাইপের একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা হলো আইসিসির সিংহভাগ রাজস্বের যোগানদাতা ভারতীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্বকাপের মতো আকর্ষণীয় আসরগুলোতে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ প্রচারণার সুবিধা তারা চাইতেই পারে। তাদের প্রচারণার স্বার্থে আইসিসি তাই নানাভাবে ভারতীয় দল ও ভারতীয় দর্শকের সুবিধা অনুযায়ী সূচি তৈরি করে।
এখানে কয়েকটা জিনিস বিবেচনায় নিতে হয়। যেমন, ভারত যাতে সর্বোচ্চ সময় পর্যন্ত টুর্নামেন্টে টিকে থাকে, ভারতীয় খেলোয়াড়েরা যাতে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বিশ্রাম পায় এবং টিভিতে ভারতীয় দর্শকদের সুবিধা অনুযায়ী ভারতের খেলা রাখা হয়। এর বাইরে ভারতীয় দলকে তুলনামূলক কম ভ্রমণ করতে হওয়াসহ আরও নানারকম সুবিধা বেশ খোলাখুলিই দিয়ে থাকে আইসিসি। অর্থাৎ ভারত যাতে ভাল খেলতে পারে, সে জন্য মাঠে নামার আগেই মাঠের বাইরের বিষয়গুলো ঝামেলামুক্ত রাখে আইসিসি। মাঠের খেলাতেও কি ভারত সুবিধা পায়? খালি চোখে অবশ্য সেটা বলা সম্ভব নয়। যদিও এর আগে মাঠের বিভিন্ন ঘটনা, অর্থ্যাৎ একেবারে খাঁটি ক্রিকেটীয় বিষয় নিয়েও ভারতের দাবির মুখে আইসিসিকে নতি স্বীকার করতে দেখা গিয়েছে।
ধান ভাঙতে এমন শিবের গীত গাইবার কারণ হলো, আইসিসি স্বীকার করুক আর না করুক, চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সূচি তৈরির সময়ও ভারতের স্বার্থের কথা তাদের মাথায় ছিল। এক্ষেত্রে অবশ্য আইসিসি একতরফা শুধু ভারতকে সুবিধা না দিয়ে কিছুটা ‘নিরপেক্ষতা’দেখানোর জন্য গ্রুপের বাকি দুই বড় দল পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডকেও কাছাকাছি সুবিধা দিতে চেয়েছে। ব্যাপারটা এমন যে, গ্রুপ পর্বে ভারত, পাকিস্তান এবং নিউজিল্যান্ড নিজেদের মধ্যে বড় ম্যাচগুলো টুর্নামেন্টের শুরুতেই খেলে ফেলবে। অর্থাৎ ভারত বনাম পাকিস্তান, ভারত বনাম নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তান বনাম নিউজিল্যান্ড খেলা শুরুতেই হয়ে যাবে। এই তিন দলের শেষ তিন ম্যাচ থাকবে গ্রুপের তুলনামূলক দূর্বল তিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে (আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড এবং নামিবিয়া)। গ্রুপ পর্বের সর্বশেষ ম্যাচে ভারত খেলবে নামিবিয়ার বিপক্ষে, পাকিস্তান স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। বড় দলগুলো যেন নেট রান রেটের হিসাব মাথায় রেখে ছোট দলগুলোর বিপক্ষে পরিকল্পনা সাজাতে পারে, এটাই ছিল আইসিসির পক্ষ থেকে দেওয়া 'সুবিধা'।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, অন্য গ্রুপের জন্য কিন্তু আইসিসি একই পদ্ধতি অনুসরণ করেনি। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচগুলো নিয়মিত সূচিতেই হয়েছে। এখানে আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় হলো, গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ ৮ নভেম্বর হলেও প্রথম রাউন্ড থেকে এক নম্বর গ্রুপে যোগ দেয়া তুলনামূলক দূর্বল দল দুটির খেলা নভেম্বরের ৪ তারিখের মধ্যেই শেষ। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক, কারণ গ্রুপ পর্বের শেষের দিকে বাঁচা-মরা ম্যাচে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দর্শকরা প্রত্যাশা করে। যেমন এক নম্বর গ্রুপের শেষ দুটি ম্যাচ হচ্ছে ইংল্যান্ড বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়া বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অথচ প্রথম রাউন্ড থেকে ভারত-পাকিস্তানের গ্রুপে আসা দলগুলোর ম্যাচ আছে গ্রুপ পর্বের শেষ দুই দিনই। এই গ্রুপের শেষ দুটি ম্যাচ হচ্ছে ভারত বনাম নামিবিয়া এবং পাকিস্তান বনাম স্কটল্যান্ড। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে এক নম্বর গ্রুপের সূচি স্বাভাবিক নিয়মে দর্শক আগ্রহ মাথায় রেখে করা হলেও দুই নম্বর গ্রুপের সূচি নির্ধারণে ভূমিকা ছিল ভিন্ন কিছুর!
এখন আসা যাক, কিভাবে মার খেয়ে গেল আইসিসি, এই প্রসঙ্গে। এখানে আইসিসির মার খেয়ে যাওয়া বলতে টুর্নামেন্ট নিয়ে ভারতীয় দর্শকদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এবং আইসিসির বাণিজ্যিক লোকসানের কথা বলা হচ্ছে। আইসিসি হয়তো ধারণা করেছিল, গ্রুপ পর্বের শেষের দিকে ভারত দুর্বল প্রতিপক্ষ পেলে সুবিধামতো ফল বের করে আনতে পারবে। কিন্তু এই পরিকল্পনা যে ব্যাকফায়ার করতে পারে, সেটা হয়তো আইসিসি ধারণায় রাখেনি। গ্রুপের বড় দলগুলো প্রথমেই নিজেদের মুখোমুখি হওয়ায় ছোট দলের বিপক্ষে ম্যাচগুলো এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। অবশ্যই ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা, টি-টোয়েন্টিতে সেটা আরও বেশি। কিন্তু টানা দুই বড় ম্যাচ হেরে শেষের তিন ম্যাচ বিশাল ব্যবধানে জিতলেও ভারতের ভাগ্য আর নিজেদের হাতে নেই। যে দলটার অন্তত ৫টা ম্যাচ দর্শক ও বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকবে বলে মনে করা হয়েছিল, উচ্চাভিলাষী সূচির কারণে মাত্র দুই ম্যাচ পর সেই সূচিটাই এখন আইসিসির গলার কাঁটা হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে যদি নভেম্বরের ৭ তারিখে নিউজিল্যান্ড আফগানিস্তানকে পরাজিত করে (ধরে নেয়া যাক কিউইরা স্কটল্যান্ড আর নামিবিয়াকে হারাচ্ছে এবং পাকিস্তান বাকি ৩ ম্যাচের অন্তত ১টা জিতছে), তাহলে ৮ তারিখে ভারত বনাম নামিবিয়া ম্যাচটা হয়ে যাচ্ছে একেবারেই অনর্থক।
তবে এখানে একটা জিনিস পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। শুধু ভারতকে একতরফা সুবিধা দিলে সমালোচনা হবে...এই বিবেচনায় আইসিসি কিন্তু প্রায় একইরকম সুবিধা পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডকেও দিয়েছে। আজকে যে সূচির মারপ্যাঁচে পড়ে ভারত প্রায় বিদায়ের পথে, সেই একই সূচির কারণে পাকিস্তান বা নিউজিল্যান্ডও বাড়ির পথে থাকতে পারত। কিন্তু ভারতের কথা হচ্ছে বারবার, কারণ ভারতকে ধরে রাখার জন্যই ছিল এত পরিকল্পনা। ভারতের দর্শকদের জন্যই টুর্নামেন্টে ভারতের বড় ম্যাচ দুটি রাখা হয়েছিল দুই রোববার। দীর্ঘ ইংল্যান্ড সফর এবং আইপিএলের ধকলের পর ভারতের খেলোয়াড়রা যাতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায়, সেজন্য ভারতের প্রথম দুই ম্যাচের মাঝে বিরতি ছিল ছয় দিন। যুক্তির বিপরীতে যুক্তি দিয়ে বলা যেতে পারে, পাকিস্তানও তো শেষের দুই ম্যাচের আগে চার এবং পাঁচ দিন করে বিশ্রাম পাচ্ছে। কিন্তু নামিবিয়া বা স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে খেলার আগে পাকিস্তানের মতো দলের কি আসলেই চার/পাঁচ দিন করে বিরতি দরকার?
আইসিসি’র সমালোচনাটা তাই এখানেই আসছে। কোনো নির্দিষ্ট দলকে সুবিধা দিতে গিয়ে কাস্টমাইজড ফিক্সচার না করে যদি তারা এক নম্বর গ্রুপের মতো স্বাভাবিক পদ্ধতিতে দুই নম্বর গ্রুপের সূচিটাও করত, তাহলে হয়তো শুরুতেই ভারতকে বিদায়ের ডাক শুনতে হতো না। ভারত, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ডের মধ্যে ম্যাচগুলো টুর্নামেন্টের বিজনেস এন্ডে এসে আয়োজিত হলে ম্যাচগুলোর আবেদন যেমন আরও বেশি হতো, তেমনি ভারতীয় দর্শকদের জন্য টুর্নামেন্টটা শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যেই মরা বাড়িতে পরিণত হতো না।
পাশাপাশি আরেকটা তথ্য উল্লেখ না করলেই নয়, ভারত-পাকিস্তানের মতো কিন্তু বাংলাদেশও আইসিসির ইতিবাচক পরিকল্পনায় ছিল। প্রাক-টুর্নামেন্ট সূচি দেখলে আন্দাজ করা যায়, আইসিসি ধরে নিয়েছিল পাপুয়া নিউ গিনি, ওমান আর স্কটল্যান্ডকে টপকে বাংলাদেশ বাছাইপর্বে ‘বি’ গ্রুপের শীর্ষ দল হিসেবে সুপার টুয়েলভে উঠবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ দুটি হতো ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচটা হতো গ্রুপ পর্বে দুই দলেরই শেষ ম্যাচ, ফলে সেটারও একটা বাড়তি আকর্ষণ থাকত উপমহাদেশের দর্শকদের কাছে। আইসিসি যে বাংলাদেশকে ইতিবাচক বিবেচনায় রেখেছিল, তার আরেকটা উদাহরণ ম্যাচের সময়। টুর্নামেন্টে ভারত ও পাকিস্তানের সব ম্যাচ বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায়। এতে মধ্যপ্রাচ্যের গরম থেকে যেমন রেহাই পাওয়া যায়, তেমনি ভারতের প্রাইম টাইমের টিভির সময়টাও নেওয়া যায়। বাংলাদেশ বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলে গ্রুপের পাঁচ ম্যাচের চারটাই খেলত রাত ৮টায়। কিন্তু বাছাই পর্বে দ্বিতীয় হওয়ায় বাংলাদেশকে সুপার টুয়েলভের সব ম্যাচ খেলতে হচ্ছে স্থানীয় সময় দুপুর ২টার কাঠফাটা গরমে। আর বাংলাদেশের জন্য আইসিসির পুর্ব-পরিকল্পিত সূচিতে খেলছে স্কটল্যান্ড।
ভিন্ন আরেকটা আলোচনা হতে পারে, কেন আইসিসি ভারতের কথা এত মাথায় রাখে? ভারতের পেশিশক্তিটা কোথায়? উত্তরটা সবারই জানা, অর্থ-কড়ি। সাধাসিধে একটা হিসেব বলে, আইসিসি যত আয় করে তার প্রায় ৮০% অর্থের যোগানদাতা ভারতীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। আইসিসির মুনাফাটা ভাগ বাটোয়ারা করে নেয় সদস্য দেশগুলো। গড়পড়তা হিসেব বলছে, আইসিসি ১০০ টাকা মুনাফা করলে প্রায় ১৭ টাকা দেওয়া হয় ভারতকে; সাড়ে ৮ টাকা দেওয়া হয় ইংল্যান্ডকে; সাড়ে ৭ টাকা করে পায় অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ; জিম্বাবুয়ে পায় প্রায় সাড়ে ৫ টাকা; বাকি সাড়ে ১৬ টাকা অ্যাসোসিয়েট দেশগুলো ভাগাভাগি করে নেয়। দেখা যাচ্ছে আয়ে অবদানের সাথে লভ্যাংশের তুলনা করলে ভারতই বাণিজ্যলক্ষী। এই প্রসঙ্গটা তুলেই তো ভারত বছর কয়েক আগে ‘বিগ থ্রি’ নামক প্রস্তাব করেছিল, যেখানে আয় অনুযায়ী লভ্যাংশের বড় অংশটা দাবি করেছিল তারা। সেই প্রস্তাবটা কার্যকর না হলেও আয়ের সিংহভাগ যে ভারতের হাত ধরেই আসছে, সেটা তো আর অস্বীকার করা যায় না। সেকারণেই আইসিসি, তথা সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বের জন্যই ভারতের সাফল্যটা অতি প্রয়োজনীয়।
বিসিবি সভাপতি যখন দাবি করেন, বোর্ডের প্রায় ৯০০ কোটি টাকা গচ্ছিত আছে, সেই টাকার বেশির ভাগ কিন্তু আইসিসি থেকেই প্রাওয়া। আর ভারত আইসিসি’র ইভেন্টগুলোতে খেলে বলেই কিন্তু আইসিসির আয়ের পথটা এতো প্রশস্ত। কথায় বলে দুধ দেওয়া গরুর লাথিও সহ্য করা যায়। আইসিসি, তথা ক্রিকেট বিশ্বের হয়েছে সেই দশা। সবাই বোঝে ভারতকে বাড়তি সুবিধা দেয়া হচ্ছে, তারপরও সেটা মেনে নিতে বাধ্য হয়। কারণ যতই হোক বিনোদন কিংবা মনোরঞ্জন, অর্থাগমন না ঘটলে এই যুগে কেউ কারো নয়।