আসিফ আলী ও একটি মোটর বাইক
উৎপলশুভ্রডটকম
৩ নভেম্বর ২০২১
সামান্য একটা মোটরবাইকই তো! নাকি? না। আসিফ আলীর জীবনে ওই ইয়ামাহা মোটরবাইক একটা বাইকের চেয়েও ছিল অনেক বেশি। ক্রিকেট জীবনের প্রথম দিকের আয়ে কেনা সেই বাইকের কথা ভেবে এই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের নায়ক হয়ে যাওয়া আসিফ এখনো কষ্ট পান। কেন, কষ্ট কেন?
আসিফ আলীর মনে নানা দুঃখ আছে। সেই যে ২০১৯ বিশ্বকাপের সময় পাকিস্তান দলে থাকা যেমন আনন্দের ছিল, তার চেয়ে বহুগূণ বেদনার ছিল ক্যান্সারে ভূগে ওই সময়ে ১৯ মাস বয়সী মেয়ের মৃত্যু। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে টানা দুটি ম্যাচে ছক্কার ঝড়ে পাকিস্তানকে জেতানোর পর আসিফের অনেক পুরনো ব্যাপারও উঠে আসছে আলোচনায়। রীতিমতো পাকিস্তানের বিশ্বকাপ নায়ক বনে যাওয়া এই ব্যাটসম্যানের জীবনে আর কী কী দুঃখ আছে, তা নিয়েও চলছে আলোচনা।
তাই তো! আর কী দুঃখ আছে আসিফের মনে?
সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরেকটু জেনে নেওয়া যাক আসিফের কথা। তাঁর পথচলার গল্পটা মোটেও মাঠে হাঁকানো ছক্কার মতো উড়ন্ত ছিল না। নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পিএসএলে নজরকাড়া পারফরম্যান্স দিয়ে তিন বছর আগে দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর টানা ব্যর্থতায় ট্রলের বন্যায় ভেসেছেন। এখনকার সুসময়েও আসিফের স্মৃতি থেকে যা মুছে যায়নি নিশ্চিত।
যে নেটিজেনরা আসিফকে নিয়ে নানা ট্রলে মজে থাকতেন, তারাই এখন নেট দুনিয়া মুখর রাখছেন ‘আসিফ বন্দনায়। পরপর দুই ম্যাচে ফিনিশিং রোল প্লে করে ক্রিকেট ভক্তদের হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা পাওয়া আসিফের অজানা অনেক গল্পের সাথে উঠে এসেছে এক দুঃখের কাহিনিও।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে আসিফ প্রথম কোনো ঘরোয়া লিগ খেলার জন্য ডাক পেয়েছিলেন ফয়সলাবাদে। যদিও সেবার একাদশে জায়গা মেলেনি। দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করে তাঁর দল। প্রাইজমানির অংশ হিসেবে আসিফ পেয়েছিলেন ৫৫ হাজার রুপির একটা চেক। তখনো তাঁর আয়ের পরিমাণ পাঁচ হাজার রুপির ওপরে ওঠেনি। এর আগে এক সাথে এত টাকা কখনোই চোখে না দেখা আসিফ চেক হারিয়ে ফেলার ভয়ে সেটি পকেটে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েন রাতে।
সেই ৫৫ হাজার রুপির ৫০ হাজার খরচ করে কেনেন ইয়ামাহার ১২৫ সিসির ব্র্যান্ড নিউ একটা মোটরসাইকেল। ক্রিকেটের মতো মোটর বাইকের প্রতি আসিফের ছিল আলাদা এক আকর্ষণ ও ভালোবাসা। তাই শখকে প্রাধান্য দিয়ে ক্রিকেট থেকে নিজের প্রথম বড় আয়ের বেশির ভাগ অর্থই খরচ করেন মোটর বাইকের পেছনে। দিনকে দিন বেড়ে যায় ইয়ামাহার সেই মোটর বাইকের সাথে আসিফের সখ্য। গাড়িটার সঙ্গে যেন মায়ার বাঁধনে বাঁধা পড়ে যান তিনি।
দিনে দিনে বাইকটা পুরোনো হতে থাকে। বিগড়ে যেতে থাকে প্রায়ই। তারপরও বাইকটার প্রতি ভালোবাসা একটুও কমেনি আসিফের। একবার এক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে খেলতে দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে ছিলেন। টুর্নামেন্ট শেষে বাড়িতে ফিরে মোটর বাইক দেখতে না পেয়ে খুঁজতে শুরু করেন। খুঁজে আর পান না। শেষে বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, অনেকদিন পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় লোহার ডিলারের দোকানে মাত্র পাঁচ হাজার রুপিতে তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন মোটর বাইকটি।
তাঁকে না জানিয়ে এভাবে প্রিয় বাইকটাকে বিক্রি করে দেওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন আসিফ। মোটর বাইকটার সাথে জড়িত তাঁর কত স্মৃতি! আসিফের যখন কিছুই ছিল না, তখন তাঁর সঙ্গী ছিল ইয়ামাহার সেই মোটর বাইক।
খেলার আয়ে কেনা সেই বাইকে চড়েই ফয়সলাবাদের রাস্তায় স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছিল আসিফের। সেই স্বপ্নযাত্রা জাতীয় দলে এসে ঠেকলেও সেই বাইকটার কথা মনে করে এখনো কষ্ট পান আসিফ।
আসিফের এখনও স্পষ্ট মনে আছে—নিজের টাকায় কেনা সেই মোটর বাইক তার ভাই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। তখন একটা হই হুল্লোড় সৃষ্টি হয়েছিল পুরো এলাকায়। আশেপাশের শহরের বাসিন্দারাও আসিফদের বাড়িতে এসে ভিড় জমিয়েছিলেন মোটর বাইকটি দেখার জন্য।
অতীতকে জীবন থেকে পুরোপুরি ছেঁটে ফেলতে তো কেউই পারেনা। আসিফও তা-ই। এই কারণেই গাড়ি কেনার সামর্থ্য হওয়ার পরও মন খারাপ হয় ওই মোটর বাইকটার জন্য। ওটা যে আসিফের জীবনের একটা সময়কে ধারণ করে ছিল!