ভারতের ‘বিদায়ে’ যে কারণে মাতম ওঠে
উৎপল শুভ্র
১ নভেম্বর ২০২১
কাগজে-কলমের হিসাবে ভারতের সেমিফাইনাল খেলার সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। পরের তিন ম্যাচেই ভারত যদি বড় ব্যবধানে জেতে, আর নিউজিল্যান্ড হোঁচট খায়, তাহলে কি একটা সম্ভাবনা থাকবে না? তবে অঙ্কের সুক্ষ্ম হিসাব-নিকাশে সুতোয় ঝুলছে যে সম্ভাবনা, পাঁড় ভারতীয় সমর্থকেরাও তাতে খুব আশা রাখতে পারছেন বলে মনে হয় না। বরং কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে সেই মাতম, বিশ্বকাপ থেকে ভারত তাড়াতাড়ি বিদায় নিলে যা ওঠে।
ভারতের অবস্থা তো তাহলে বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ! বাংলাদেশ তা-ও তৃতীয় ম্যাচ পর্যন্ত টিকে ছিল সেমিফাইনালের দৌড়ে, যেখানে ভারত দুই ম্যাচ শেষেই ছিটকে গেল সেই দৌড় থেকে। বাংলাদেশ তিন ম্যাচ হারার পরও তো নানা সমীকরণ মিলিয়ে সেমিফাইনালে ওঠার একটা পথ খুঁজে বের করে ফেলতে দেখছি অনেককে। অথচ দুই ম্যাচ হারার পরই ভারত কিনা একেবারে অন্ধ গলিতে!
এভাবে বলে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? ভারত-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ অলিখিত কোয়ার্টার ফাইনালের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছিল সত্যি, আর কোয়ার্টার ফাইনাল মানেই তো নকআউট...তারপরও কাগজে-কলমের হিসাবে ভারতের সেমিফাইনাল খেলার সম্ভাবনা তো এখনো শেষ হয়ে যায়নি। পরের তিন ম্যাচেই ভারত যদি বড় ব্যবধানে জেতে, আর নিউজিল্যান্ড হোঁচট খায়, তাহলে কি একটা সম্ভাবনা থাকবে না?
তা তো থাকবেই। বাংলাদেশের বাস্তবে কোনো আশা নেই জেনেও যদি এত সব সমীকরণ বের করা হয়, ভারতের ক্ষেত্রে কেন তা নয়! ভারতকে তাই অফিসিয়ালি এখনো ‘আউট’ বলা যাচ্ছে না। তবে অঙ্কের সুক্ষ্ম হিসাব-নিকাশে সুতোয় ঝুলছে যে সম্ভাবনা, পাঁড় ভারতীয় সমর্থকেরাও তাতে খুব আশা রাখতে পারছেন বলে মনে হয় না।
ঘটনাচক্রে ভারত ও নিউজিল্যান্ড দুই দলেরই পরের তিন ম্যাচে অভিন্ন প্রতিপক্ষ। আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড ও নামিবিয়া। একটু আগে যে বললাম, ভারত যদি তিন ম্যাচেই জেতে আর নিউজিল্যান্ড হোঁচট খায়...এতেই আসলে লুকিয়ে ভারতের ভয়। নিউজিল্যান্ডের ভাগ্য নিউজিল্যান্ডেরই হাতে, ভারতের তা নয়। আগেই নাটকীয় কিছু ঘটে গেলে ভিন্ন কথা। নইলে এই গ্রুপ থেকে দ্বিতীয় সেমিফাইনালিস্টের নাম জানতে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত মনে হয় অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। সেদিন শেষ গ্রুপ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান। এই ম্যাচের রেজাল্টই হয়তো ঠিক করে দেবে, পরদিন নামিবিয়ার বিপক্ষে ভারতের শেষ ম্যাচটাতে নেট রান রেটের আদৌ কোনো গুরুত্ব থাকবে কি না।
দুই ম্যাচে ভারত যা খেলেছে, তাতে অবশ্য আগামী পরশু তৃতীয় ম্যাচটা নিয়েই এখন ভারতীয়দের বুক ধুকপুক করার কথা। যে ম্যাচে প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান, ভারতকে ১০ উইকেটে হারানো পাকিস্তানকেও যারা রীতিমতো কাঁপিয়ে দিয়েছে। আসিফ আলী ‘নতুন শহীদ আফ্রিদি’ হিসেবে আবির্ভূত আগ পর্যন্ত জয়ের সুবাসও পেয়েছে। এমন নড়বড়ে ভারতকে পাওয়া নিশ্চয়ই আফগানিস্তানের স্বপ্নেও ছিল না। ইশ সোধির ম্যাচ-সেরা হওয়াটারও বাড়তি তাৎপর্য আছে। রশিদ খানের এমনিতেই চওড়া বুক যা আরও চওড়া করে দেওয়ার কথা।
বিশ্বকাপে ২৯ বছরের ‘নিয়ম’ ভেঙে পাকিস্তানের বিপক্ষে পরাজয়কে ‘অফিসে একটা বাজে দিন’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল ভারতের। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচেও এমন অসহায় আত্মসমর্পণের পর তা আর কিভাবে বলেন বিরাট কোহলি! পরাজয়ের ব্যবধান একটু কম হতে পারে, কিন্তু পারফরম্যান্স তো আরও খারাপ। ১১০ রানে অলআউট হয়ে যাওয়াটাও যা বোঝাতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। এমন প্রবল প্রতাপান্বিত ভারতীয় ব্যাটিং লাইন আপের টানা ৭৬ বল বাউন্ডারিহীন কাটিয়ে দেওয়ার অবিশ্বাস্য কীর্তি হয়তো যা কিছুটা পারছে।
কাগজে-কলমে বেঁচে থাকা ক্ষীণ আশা বিসর্জন দিয়ে মাতমটা কিন্তু তাই উঠে গেছে। আইসিসির কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট থেকে ভারতের বিদায়ঘণ্টা বাজলেই যে মাতম ওঠে। ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব ক্রিকেটেই। বিশ্ব ক্রিকেট বলছি আইসিসি বোঝাতে। ভারতের বিদায় মানেই যে টুর্নামেন্টের অনেকটাই রং হারিয়ে ফেলা। 'রং'-এর বদলে এখানে 'টাকাপয়সা'-ও পড়তে পারেন।
উপমহাদেশের বাকি তিন দেশেও জনপ্রিয়তায় ক্রিকেট এক নম্বর খেলা। তবে বিশাল জনসংখ্যার বিশাল বাজার ভারতীয় ক্রিকেটকে এমন একটা শৃঙ্গে পৌঁছে দিয়েছে যে, আর কোনো দেশের সঙ্গেই এর তুলনা চলে না। বাকি সব দেশ মিলেও কি তুলনা হয়! এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথাই যদি ধরেন, বাকি ১৫টি দেশের জনসংখ্যা যোগ করলেও তো মনে হয় ভারতের সমান হবে না।
এই বিশাল বাজার ভারতে ক্রিকেটকে শুধুই একটা খেলা রাখেনি, পরিণত করেছে বিশাল বাণিজ্যেও। বিশ্ব ক্রিকেটও যে বাজারের মুখাপেক্ষী। বৈশ্বিক কোনো আসর থেকে ভারতের অকাল বিদায় মানে তাই স্পনসরদেরও মাথায় হাত। শুধু স্পনসর কেন, আয়োজক দেশ-শহর সবারই তো বিশাল আর্থিক ক্ষতি।
কোনো বিশ্বকাপের শুরুতেই ভারত ছিটকে পড়লে তা কেমন সর্বব্যাপী বিপর্যয়ের রূপ নেয়, এর আদর্শ উদাহরণ হিসেবে ২০০৭ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের কোনো তুলনা হয় না। যেটির কথা উঠলেই আমার মনে পড়ে যায় বারবাডোজে বসত গাড়া মধ্য পঞ্চাশের ভারতীয় বংশোদ্ভূত ওই নাদুসনুদুস রেস্তোরা মালিকের শোকাতুর মুখ। বিশ্বকাপ মানেই হাজার হাজার ভারতীয় সমর্থকের ভিড়। সারা জীবনের ব্যবসা এই একটা বিশ্বকাপেই করে নেওয়া যাবে ভেবে ওই ভদ্রলোক প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ব্রিজটাউনের প্রাণকেন্দ্রে ‘অপ্সরা’ নামে দারুণ সুন্দর একটা রেস্তোরা খুলে ফেলেছেন। খোলার পর থেকেই দিন গুনছেন সুপার এইটে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের।
এরপর কী হয়েছিল, অনেকেরই তা মনে থাকার কথা। গ্রুপ পর্বে একই দিনে দুই অঘটন। কিংস্টনে পাকিস্তানকে হারিয়ে দিল আয়ারল্যান্ড, পোর্ট অব স্পেনে বাংলাদেশ ভারতকে। যে দুই পরাজয়ের সুদূরপ্রসারী ফল: সুপার এইটে ভারতও নাই, পাকিস্তানও নাই। ব্রিজটাউনে যে ম্যাচটাকে ভারত-পাকিস্তান নিশ্চিত ধরে নিয়ে হাজার হাজার ভারতীয় (কিছু পাকিস্তানিও) দিনটাতে লাল কালি দিয়ে দাগ দিয়ে রেখেছিলেন, হতবিহ্বল হয়ে তারা আবিষ্কার করলেন, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচটা হয়ে গেছে বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড! বারবাডোজে হোটেল বুকিং ক্যানসেল করার সেই রেকর্ডটা মনে হয় এখনো ভাঙেনি।
যে রেস্তোরা মালিকের কথা বলছিলাম, অপ্সরায় খেতে গিয়ে তাঁর মুখে শোনা কথাগুলোকে রীতিমতো হাহাকার বলে মনে হচ্ছিল। ভারত বিদায় নেওয়ায় তাঁর যে বিশাল আর্থিক ক্ষতি হয়ে গেল, সেটার সবিস্তার বর্ণনার পর শাপশাপান্ত করছিলেন রাহুল দ্রাবিড়ের দলকেও। পুরো ব্যাপারটাতে আমার কোনোই ভূমিকা নেই, তারপরও তাঁর এই ক্ষতির জন্য বাংলাদেশই দায়ী বলে একটু সংকুচিত তো বোধ করছিলামই!
শেষ পর্যন্ত অলৌকিক কিছুতে ভর করে ভারত সেমিফাইনালে উঠে না গেলে দুবাইয়ে কান পাতলেও এমন হাহাকার শোনা যাবে বলেই অনুমান করা যায়। খেলা নিয়ে লিখতে বসে খেলার বাইরের কথাই বেশি হলো। তবে একটা তথ্য মনে না করিয়ে দিলে লেখাটা অসম্পূর্ণ থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের ২৯ বছর ধরে টানা ১২ ম্যাচ জয়ের সঙ্গে হয়তো তুলনা চলে না। তবে পাকিস্তানের জন্য বিশ্বকাপে ভারত যা ছিল, আইসিসির বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে নিউজিল্যান্ডও কিন্তু ভারতের জন্য প্রায় কাছাকাছি কিছুই। সেই কিউই আধিপত্য আবার তিন ফরম্যাটে বিস্তৃত। টেস্ট-ওয়ানডে-টি টোয়েন্টি মিলিয়ে আইসিসি টুর্নামেন্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের এটি টানা পঞ্চম পরাজয়। সর্বশেষ জয় খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে দেড় যুগেরও বেশি। ২০০৩ বিশ্বকাপের সেঞ্চুরিয়নে।
মানেটা বুঝেছেন? বিরাট কোহলির এই দলের কেউ জানেই না, আইসিসি টুর্নামেন্টে নিউজিল্যান্ডকে হারাতে কেমন লাগে!