আসিফ আলী নামটা মনে রাখতে বলছেন স্টোকসও
উৎপলশুভ্রডটকম
৩০ অক্টোবর ২০২১
পাওয়ার হিটিংয়ের জন্য তাঁর সুনাম আছে। কিন্তু বিশ্ব মঞ্চেও বলে বলে ছক্কা মারতে পারবেন কি না, এ নিয়ে সংশয় তো ছিলই। সেটি উড়িয়ে দিয়ে ‘ফিনিশার’ হিসেবে চাপের মুখে ছক্কার পর ছক্কায় দলকে জেতাচ্ছেন আসিফ আলী। আফগানিস্তানের বিপক্ষে এক ওভারে চার ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ শেষ করে দেওয়ার পর তো পরিণত হয়েছেন এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে আলোচিত নামে।
মাত্র ৭ বল খেলে কেউ ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ হতে পারেন? এই প্রশ্নের জবাবটা গত রাতের পর কারও অজানা নয়। অসাধারণ বীরত্বে পাকিস্তানের ‘ফিনিশার’ আসিফ আলী তা করে দেখিয়েছেন। প্রচণ্ড চাপের মধ্যে স্নায়ুর ওপর রেখেছেন দারুণ নিয়ন্ত্রণ। পাওয়ার হিটিংয়ে সব চাপ এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বিজয়ী করেছেন পাকিস্তানকে। রোমাঞ্চকর খেলায় সবটুকু আলো কেড়ে নিয়েছেন এক ওভারে চার ছক্কা হাঁকিয়ে। ৭ বলে আসিফের ২৫ রানের হার না মানা থ্রিলার এখন গল্প হয়ে ফিরছে।
অথচ নায়ক না হয়ে খলনায়ক হয়ে যাওয়ার সব শঙ্কাই ছিল আসিফের। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটা শেষ দিকে এমন জমে উঠেছিল যে, এক সময় আফগানিস্তানকেই মনে হচ্ছিল সম্ভাব্য জয়ী। রশিদ খানের শিকার হয়ে ফিফটি করা অধিনায়ক বাবর আজম ফেরার পর থেকেই যেটির শুরু। ১৮তম ওভারের পঞ্চম বলে পেসার নাভিন উল হকের শিকার শোয়েব মালিক। পরিস্থিতি খুব কঠিন। শাদাব খানও অলরাউন্ডার। শেষ বলটা গ্যাপে ঠেলে একটা রানের জন্য ক্রিজের প্রায় অর্ধেকটা চলে এসেছেন। আসিফ তাঁর ডাকে সাড়াই দেননি। ফিরে যেতে হলো বলে শাদাবের বিরক্তিটা ছিল স্পষ্ট। কিন্তু আসিফ নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন। ওই ওভারে নাভিন ২ রান দিলে শেষ দুই ওভারে মানে ১২ বলে পাকিস্তানের জিততে দরকার পড়ে ২৪ রান। এবং কারিম জানাতের প্রথম, তৃতীয়, পঞ্চম ও ষষ্ঠ বলে মোট চারটা ছক্কা হাঁকিয়ে এক ওভার হাতে রেখেই খেলায় ইতি টেনে দেন আসিফ।
নিজের ওপর কী প্রবল বিশ্বাস! আগের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জয়েও বড় ভূমিকা ছিল আসিফের ছক্কার। সেখানেও তিনি আদর্শ ফিনিশারের ভূমিকায় অবতীর্ণ। ১২ বলে ৩ ছক্কা ও ১ চারে অপরাজিত ছিলেন ২৭ রানে। ১৭তম ওভারে টিম সাউদিকে টানা দুই বলে ছক্কা মেরে খেলাটাকে সহজ করে দিয়েছিলেন। শোয়েব মালিকের সঙ্গে মিলে ম্যাচটা বের করে ফেলেন সহজে। কিন্তু ওই ইনিংসে আফগানদের বিপক্ষে ম্যাচের মতো ঔদ্ধত্য কোথায়!
শাদাব ওই এক রান নিলে নিজে থাকতেন পরের ওভারে স্ট্রাইকে। তিনিও যেমন নতুন ব্যাটসম্যান, তেমনই আসিফও। কিন্তু শাদাবের ওপর ভরসা না করে নিজের ওপর ভরসা করার সিদ্ধান্তটাই নিয়েছিলেন আসিফ। স্ট্রাইক মানে ম্যাচের ভাগ্য নিজের হাতে নিতে চেয়েছিলেন এবং তাতে কিছুক্ষণের মধ্যে শতভাগ সাফল্য। ম্যাচের পর তাই ওই এক রান না নেওয়ার প্রসঙ্গ এলে আসিফ বলেন, ‘জানতাম তখন এক রান হতে পারে। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল যে আমি ছক্কা মেরে প্রয়োজনীয় রান তুলে ফেলতে পারব।’
ছক্কার মারার সামর্থ্যের ওপর এমনই বিশ্বাস যে, ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে নিয়ে বললেন, শোয়েব মালিক আউট হওয়ার আগে তাঁকে বলেছেন, ওভারে ২৫ রান লাগলেও তা তিনি তুলে ফেলতে পারবেন।
যেদিকে বাউন্ডারি সীমা বড়, সেদিকে খেলতে আসিফকে বাধ্য করতে চেয়েছিল আফগানিস্তান। জানাত বলও করছিলেন সেই পরিকল্পনায়। কিন্তু আসিফও সাজানো ফিল্ডিংয়ের তোয়াক্কা না করে অফ সাইডেই বাতাসে ভাসিয়ে খেলা শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘যেদিকে বাউন্ডারি ছোট, সেদিকে ওরা বল করেনি। তবে আমি তাকে বড় দিকেই মেরে দিয়েছি।’
সেই মার ইংল্যান্ডের অলরাউন্ডার বেন স্টোকসকে এমনই মুগ্ধ করেছে যে, তিনি টুইট করেছেন, "Rememer the name @AasifAli2018". পাকিস্তানের সাবেক গতিতারকা শোয়েব আখতার টুইট করেছেন এক বাক্যে, ‘আসিফ আলি ইউ বিউটি!!!’ পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান রমিজ রাজা আসিফ ইউ বিউটি হ্যাশ ট্যাগ ব্যবহার করে লিখেছেন, ‘চাপের মুখে অবিশ্বাস্য মার। সেনসেশনাল।’ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও প্রশংসা করেছেন আসিফের। এত রথী-মহারথীর ভিড়েও স্টোকসের প্রশংসাটা একটু আলাদা হয়ে নজর কাড়ে।এক ওভারে চার ছক্কার কথা উঠলেই যে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের কথা মনে পড়ে যায় অনেকের। সেদিন স্টোকস ছিলেন ভুক্তভোগী বোলার। কার্লোস ব্রাফেট তাঁর প্রথম চার বলেই টানা চার ছক্কায় মীমাংসা করে দিয়েছিলেন শিরোপার। তখন ধারাভাষ্যে থাকা ইয়ান বিশপের বলা কথাটারই পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি, 'রিমেম্বার দ্য নেম'। নামটা মনে রেখো।
প্রশংসা চারদিকে। কিন্তু ভেসে যাচ্ছেন না আসিফ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটা তাঁর কাছে একটা মিশন। যে মিশনে তিনি না-ও থাকতে পারতেন। নিচের দিকে ব্যাট করেন। ক্ষমতা আছে। আছে সামর্থ্য। কিন্তু ক্যারিয়ারটা তো এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেননি। তাই আসিফের টুইটের ভাষাটা এরকম, ‘ইসলামাবাদ ইউনাইটেডসহ আমার কঠিন সময়ে যারা আমার ওপর আস্থা রেখেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।’ এই টুইটের প্রথম বাক্যটা দেশের জন্য যেকোনো কিছু করার প্রবল বাসনা থেকে, ‘আর কোনো হুকুম, পাকিস্তান?’
২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক আসিফের। ৩২ ম্যাচের ২৯ ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ মিলেছে। ৮ ম্যাচে অপরাজিত। মোটে ৩৯৬ রান। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৪১। গড় ১৯ এর কাছাকাছি। স্ট্রাইক রেট ১৩৩.৩৩। বাউন্ডারির চেয়ে ওভার বাউন্ডারির দিকে তার ঝোঁক পরিষ্কার। ২৬ ছক্কার পাশে ১৬টি চার।
ছক্কা মারার ক্ষমতার জন্যই আসলে পাকিস্তান দলে সুযোগ পাওয়া আসিফের। সেই সুযোগের সঙ্গে মিশে আছে বাংলাদেশের কাটার মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমানের নামও। খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই আসিফের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের টুইটে আছে পিএসএলের দল ইসলামাবাদ ইউনাইটেডের নাম। ২০১৮ সালে পিএসএল শিরোপা জিতেছিল ইসলামাবাদ। সেখানে আসিফের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। সেই আসরেই পাওয়ার হিটার হিসেবে তার নজর কাড়া। মোস্তাফিজের বলে সুপার ওভারের ছক্কাটা আসর থেকে দলের বিদায় ঠেকায়। আর ফাইনালে হাসান আলীর বলে টানা তিন বলে তাঁর তিন ছক্কা শিরোপা জেতায় ইসলামাবাদকে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতেও লড়াইটা শিরোপা জেতার। টানা তিন ম্যাচ জিতে পাকিস্তান সেমিফাইনালে কার্যত উঠেই গেছে। ফেবারিট হিসেবেও মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে নিজেদের। সেই তকমাকে সত্যি প্রমাণ করার জন্য অস্ত্রশস্ত্র আরও অনেকই আছে, তবে যুদ্ধটা শেষ করার জন্য আছেন একজন আসিফ আলী। বেন স্টোকসের মতো করে বলতে হয়, নামটা মনে রাখবেন।