উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
বিশ্বকাপের আগেই রশিদ খান-নবীদের যে লড়াই
ইফতেখার নিলয়
২৬ অক্টোবর ২০২১
আফগানিস্তানের উত্থান ক্রিকেটের এক অপরূপ গল্প। ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয়হীন একটা দেশের তরতর করে এগিয়ে যাওয়া বিস্ময় ছাড়া আর কিছু নয়। তালেবানের ক্ষমতায় ফেরা সেই আফগান ক্রিকেটের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল। শঙ্কা দেখা দিয়েছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলা নিয়েও। শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান খেলছে...তা কত দূর যেতে পারে তারা?
গত আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলে দুই দশক পর আবার তালেবান আসীন হয় আফগানিস্তানের সিংহাসনে। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার আগ মূহুর্তে রাজধানী কাবুলে চলা অশান্তির প্রভাব বিরাজমান ছিল দেশটির আনাচে-কানাচেও। পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব নেতাদের কাছে সহায়তা চেয়ে রশিদ খানের টুইট আলোচনার ঝড় তুলেছিল ক্রিকেট দুনিয়ায়। রশিদ খানের সেই টুইটে সামনের দিনগুলোতে আফগানিস্তান ক্রিকেটের স্থায়িত্ব নিয়েও জন্ম দেয় বিরাট এক প্রশ্ন।
শুধু রশিদ খানের মতো আফগান ক্রিকেটারই নন, আফগানিস্তানের ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সবার কপালেই চিন্তার ভাঁজ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে শুরু করে। দুই বছর আগে টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করা আফগানিস্তানের ক্রিকেট কি তবে বিলীন হয়েই যাচ্ছে? বিশ্ব গণমাধ্যমের এমন সব খবরে শঙ্কার হাওয়া ঝড়ো বেগে বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেটির অবসান ঘটে তালেবানের জ্যেষ্ঠ নেতা আনাস হাক্কানী আফগান খেলোয়াড় ও ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে ক্রিকেটের প্রতি তালেবানের ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেওয়ার পর। অনিশ্চয়তা ও শঙ্কায় দিন পার করা আফগান ক্রিকেটার ও সমর্থকরা যেন তীব্র খরার মাঝে এক পশলা বৃষ্টির দেখা পেয়েছিল সেই খবরে।
যদিও নারী দলের খেলা পুনরায় মাঠে গড়ানো নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা থেকেই গেছে। আফগান নারী দল ক্রিকেট মাঠে না ফিরলে, আফগান ছেলেদের বিপক্ষে আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য টেস্ট বাতিলের অগ্রিম ঘোষণা দিয়ে রেখেছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া।
আফগানিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করে ভারতের সাবেক ক্রিকেটার গৌতম গম্ভীর বলেছিলেন, 'আমি তালেবান নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না, তবে আফগানিস্তানের ক্রিকেটারদের মধ্যে যে প্রতিভা আছে, সেটাই আফগানিস্তান ক্রিকেটকে খুব দ্রুত এত দূর নিয়ে এসেছে। নবী, রশিদ আর মুজিব যেকোনো দলে জায়গা করে নেওয়ার যোগ্যতা রাখে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক পাশে রেখে আফগান ক্রিকেটকে মসৃণভাবে এগিয়ে যেতে দেওয়া দরকার।'
তালেবান সরকারের সবুজ সংকেত পাওয়ায় আফগানিস্তানের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যাত্রাও আর বাধাগ্রস্ত হয়নি। ক্রিকেটার ও ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে সেই সাক্ষাতের পর সাবেক বোর্ড সভাপতি আজিজুল্লাহ ফজলিকে পুনরায় বসানো হয় তার আগের চেয়ারে। কিন্তু, নানাবিধ জটিলতায় শ্রীলঙ্কার মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে হতে যাওয়া ওডিআই সিরিজ ভেস্তে যায়।
শুধু তালেবানেই আফগান ক্রিকেটের অস্থিরতার শেষ হয়নি। সেপ্টেম্বরের শুরুতে দল ঘোষণার পর অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ান রশিদ খান। সরে দাঁড়ানোর কারণ উল্লেখ করে টুইটারে রশিদ খান লেখেন, 'দল নির্বাচনের আগে দলের অধিনায়ক হিসেবে আমার সাথে আলোচনা করা হয়নি। আমার পছন্দকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাই আমি অধিনায়কের পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি।'
রশিদ খানের অধিনায়কত্ব ছাড়ার দিন কয়েক আগেই পাকিস্তানের বিপক্ষে ওডিআই সিরিজ বাতিল হওয়ায় সংকটের মাত্রা আরও তীব্র হয়। পরপর দুটো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আফগানিস্তান ক্রিকেটের এলোমেলো অবয়ব পুরোপুরি নজরে আসে সবার। বিশ্বকাপের আগে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সংকটে জর্জরিত আফগানিস্তান ক্রিকেটের বিশ্বকাপকেন্দ্রিক মানসিক প্রস্তুতিটা যে আদর্শ হয়নি, তো তো বোঝাই যাচ্ছে।
মাঠের প্রস্তুতিটাও সেরে নেওয়া যায়নি নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে। চলতি বছরের মার্চে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচের তিনটিতেই জয় পেয়েছিল আফগানিস্তান। মাঠের ক্রিকেটে প্রেরণা ছয় মাস আগে জেতা কেবল সেই তিন ম্যাচই। তিনটিই ছিল বিশ্বকাপ ভেন্যু শারজাতে। এছাড়াও এই ভেন্যুগুলোতে আইপিএলে ১৪ ম্যাচে ৬.৬৯ ইকোনমিতে ১৮ উইকেট নিয়ে রশিদ খান জানান দিয়েছেন, বিশ্বকাপে তিনি কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন। তবে দলের আরও দুই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় মোহাম্মদ নবী ও মুজিব-উর রেহমানের আইপিএলে সেভাবে খেলারই সুযোগ পাননি। নবী খেলেছেন তিন ম্যাচে, মুজিব মাত্র একটিতে। যে কারণে বলা যায়, সেই অর্থে আফগানিস্তানের বিশ্বকাপ প্রস্তুতিটা পরিপূর্ণ হয়নি।
তবে এসব প্রতিকূলতাকে নিয়েই তো আফগানিস্তান ক্রিকেটের বেড়ে ওঠা। বিশ্বকাপ দলে মোহাম্মদ শাহজাদের ফিরে আসাটা একটা প্লাস পয়েন্ট। জাজাই আর শাহজাদের ব্যাট একই ম্যাচে জ্বলে উঠলে মরুঝড় দেখতেই পারেন। শাহজাদ তো বহু আগেই বিশ্ব ক্রিকেটের পরিক্ষিত এক ওপেনার। রহমানুল্লাহ গুরবাজের ১৪৩ স্ট্রাইকরেটেও স্বপ্ন বুনবে আফগান সমর্থকেরা। মিডল অথবা লোয়ার যেকোনো অর্ডারে মারমুখী ব্যাটিংয়ের জন্য নাজিবউল্লাহ জাদরান দীর্ঘদিন ধরেই আফগানদের মূল ভরসা। সিমারদের মধ্যে অভিজ্ঞ হামিদ হাসানও আছেন এবারের বিশ্বকাপে।
আফগানদের মূল তিন ক্রিকেটার নিঃসন্দেহে রশিদ খান, মোহাম্মদ নবী আর তরুণ মুজিব-উর রহমান। তিন স্পিনারের ঘূর্ণির জাদুর পাশাপাশি ব্যাট হাতে নবীর মতো প্রায়ই কার্যকরী হয়ে উঠেন রশিদ। শুরুর দিকে মুজিবের স্পিন ঘূর্ণি সামলাতে সব দলকেই বেগ পেতে হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের বিপক্ষে নতুন বলে মুজিবের রেকর্ড ঈর্ষণীয়। আইপিএলে রশিদ ছাড়া কেউই নিয়মিত ছিলেন না। তবে, বিশ্বকাপ ভেন্যুতে দীর্ঘদিনের অবস্থান করে আহরিত জ্ঞান কাজে দেবে আফগানিস্তানের জন্য।
রশিদ খানের অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণার পর ২০১৪ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন মোহাম্মদ নবী। ক্রিকেট বিশ্বের অসংখ্য টি-টোয়েন্টি লিগে অংশ নিয়ে নবীর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। খেলাটা আমিরাতে হচ্ছে বলেও আফগানিস্তানের খুশি হওয়ার কারণ আছে। যেখানে এখন পর্যন্ত ছয়টি টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতেছে তারা। মাঠ-উইকেট-আবহাওয়া সবই তাদের পরিচিত।
ক্ষমতার পালাবদলে আফগানিস্তান ক্রিকেটের উপর যে হুমকি এসেছিল, তা ছেলেদের ক্রিকেটের উপর পড়েনি৷ তাই বিশ্বকাপের আগে কাটানো সকল প্রতিকূল পরিস্থিতির মতো বিশ্বকাপের ময়দানেও সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে নতুন আঙ্গিকে নিজেদের মেলে ধরতে অধিনায়ক মোহাম্মদ নবীর নেতৃত্বে প্রস্তুত আফগানিস্তান ক্রিকেট। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে পরাজিত হলেও এক ঝলক দেখিয়েছেন নবী, মুজিব আর নবীন। আর উইন্ডিজের বিপক্ষে জয়টা তো মনেই আছে সবার।
বিশ্বকাপে কত দূর যাবে আফগানিস্তান...এই প্রশ্নের উত্তরও এখন অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়ে। প্রাথমিক পর্ব থেকে আফগানিস্তানের গ্রুপে এসেছে স্কটল্যান্ড ও নামিবিয়া। এই দুই দলের বিপক্ষে অবশ্যই ফেবারিট আফগানিস্তান। গ্রুপের শক্তিশালী বাকি তিন দল ভারত, পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এক বা একাধিক অঘটন ঘটানোর স্বপ্ন তো তারা দেখতেই পারে। এখানে কি আফগানিস্তানের সেমিফাইনাল খেলার সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে?
তা হলে বড় ঘটনাই হবে, তবে সেটিকে 'অসম্ভব' বলার কোনো কারণই নেই।