ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ভারত সেমিফাইনাল
কোহলির হতে হতে সিমন্সের রাত!
উৎপল শুভ্র
১৩ অক্টোবর ২০২১
টি-টোয়েন্টির অন্তর্নিহিত অস্থিরতা, রোমাঞ্চপ্রিয়তা ক্যারিবীয় চরিত্রের সঙ্গে দারুণ মানিয়ে যায়। কোহলি বনাম গেইল লড়াই অমন একপেশে হয়ে যাওয়ার পরও তাই এতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জেতে। গেইলের বিশাল ছায়া থেকে বেরিয়ে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেন পার্শ্ব নায়কেরা। জনসন চার্লস, লেন্ডল সিমন্স, আন্দ্রে রাসেল। ওয়াংখেড়েতে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেমিফাইনালের গল্প।
প্রথম প্রকাশ: ১ এপ্রিল ২০১৬। প্রথম আলো।
ভারত: ২০ ওভারে ১৯২/২। ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ১৯.৪ ওভারে ১৯৬/৩। ফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৭ উইকেটে জয়ী।
পরপর দুই বলে রান আউট হতে হতে বেঁচে যাওয়ার পর বিরাট কোহলি কী করতে পারেন?
শুধু কালকের ম্যাচের কথা হলে এই প্রশ্নের উত্তর—৪৭ বলে ৮৯!
১৯২ রান তাড়া করতে নেমে ক্রিস গেইল কী করতে পারেন?
প্রথম ৫ বলে একটি চার ও একটি সিঙ্গেল নেওয়ার পর ষষ্ঠ বলে বোল্ড। ৬ বলে ৫ রান!
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসের মাত্র দ্বিতীয় ওভার। আগের দিন গেইলের বিরুদ্ধে অশ্বিনকে লেলিয়ে দেওয়া নিয়ে এত কথা হয়েছে, অথচ নেহরার পর ধোনি বল তুলে দিলেন বুমরাহর হাতে। বেশির ভাগ দিনে গেইল যাঁর প্রথম বলটিকে গ্যালারিতে ফেলতেন। কিন্তু এদিন সেই ফুল টসেই বোল্ড!
তখন মনে হচ্ছিল, দ্বিতীয় সেমিফাইনালের গল্প নটে গাছ-টাছ মুড়িয়ে এখানেই বোধ হয় ফুরিয়ে গেল। ধোনিদের ডাকছে ওয়াংখেড়ে থেকে ইডেনের ফুলেল রাস্তা। এই ম্যাচের বাকি সব আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
দর্শকেরাও তেমনই মনে করেছিলেন। ওয়াংখেড়ে তখন উত্তাল। ঘণ্টা খানেক পর যেখানে শ্মশানের স্তব্ধতা। মাত্রই আন্দ্রে রাসেলের ছক্কাটা মাঠের বাইরে আছড়ে পড়েছে। দু হাত ছড়িয়ে দিয়ে তিনি ছুটছেন লেন্ডল সিমন্সের দিকে। দৌড়ে মাঠে নেমে আসছে পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল।
এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট-ওয়ানডেতে যা-ই করুক, টি-টোয়েন্টিতে অন্য দল। খেলাটার অন্তর্নিহিত অস্থিরতা, রোমাঞ্চপ্রিয়তা ক্যারিবীয় চরিত্রের সঙ্গে দারুণ মানিয়ে যায়। কোহলি বনাম গেইল লড়াই অমন একপেশে হয়ে যাওয়ার পরও তাই এতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জেতে। গেইলের বিশাল ছায়া থেকে বেরিয়ে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেন পার্শ্ব নায়কেরা। জনসন চার্লস, লেন্ডল সিমন্স, আন্দ্রে রাসেল।
ভাগ্যদেবী কখনো কারও প্রতি সদয় হন, কখনো না বিরূপ। তবে সেটিরও একটা সীমা থাকে। কাল লেন্ডল সিমন্সের প্রতি ভাগ্যদেবীর প্রসন্ন দৃষ্টি সব সীমাই ছাড়িয়ে গেল। তিন-তিনবার ড্রেসিংরুমের পথে অর্ধেক মাঠ পেরিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম দুবার ফিরে এলেন টিভি রিপ্লে বোলার নো বল করেছেন জানিয়ে দেওয়ায়। প্রথমবার ১৮ রানে। দ্বিতীয়বার মাত্রই হাফ সেঞ্চুরি করার পর। এবার হাসতে হাসতে। নিজেরই যে বিশ্বাস হচ্ছিল না!
তৃতীয়বার যখন ‘আউট’, ম্যাচ তখন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ৩ ওভারে ৩২ রান চাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের। অফ স্টাম্পের বাইরে বুমরাহর প্রথম তিনটি বলে ব্যাটই লাগাতে পারেননি। চতুর্থ বলে চালালেন। ওয়াইডিশ লং অফে নিয়ন্ত্রণ হারাতে হারাতে জাদেজার ছুড়ে দেওয়া বল কোহলির হাতে। বেরিয়ে যাওয়ার পথে আবারও দাঁড়ালেন সিমন্স। আবারও টিভি আম্পায়ার জানালেন, এখানেই সিমন্সের শেষ নয়। বলটা ধরার সময় জাদেজার পা সীমানা ছুঁয়েছে।
৫১ বলে অপরাজিত ৮২ রানের ইনিংসে শেষ পর্যন্ত সিমন্সের হাতেই ম্যাচ-সেরার ট্রফি। যেটি আন্দ্রে রাসেলকে দিলেও মোটেই অন্যায় হতো না। তাঁর ২০ বলে অপরাজিত ৪৩ রানের ইনিংসটিই তো আসল শক্তিশেল হয়ে বিঁধল ভারতের বুকে। ৪টি ছক্কার একটি আরেকটির চেয়ে বড়। সবচেয়ে বড়টা গ্যালারির তিনতলায় গিয়ে পড়ল। প্রায় আকাশ ছোঁয়ার পরও যেটির দৈর্ঘ্য ৯৯ মিটার। আরেকটি প্রেসবক্সের কাচে।
এই বিশ্বকাপে ভারত এর আগের চারটি ম্যাচই খেলেছে নিজেদের পছন্দমতো বানানো উইকেটে। ওয়াংখেড়ের কিউরেটর নাকি ধোনিদের আবদার মানেননি। আইসিসিরও একটু নজর ছিল। ম্যাচটা হলো তাই টি-টোয়েন্টির জন্য আদর্শ উইকেটেই। টসে জিতলে যেখানে দুই অধিনায়কই পরে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন।
ড্যারেন স্যামি তা-ই করলেন। তবে এটির দুটি অর্থ হতে পারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ রান তাড়া করতে ভালোবাসে। সাদা চোখে এটিই কারণ। সঙ্গে হয়তো ‘কোহলি-ফ্যাক্টর’-ও! কোহলি যেন পরে ব্যাটিং করতে না পারেন, এটাও যে ইদানীং ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ জেতার পূর্বশর্ত। এই ম্যাচের আগে প্রথমে ব্যাটিং করে যে কোহলির ব্যাটিং গড় ৩৫.২২, পরে ব্যাটিংয়ে সেটিই ৯১.৮০!
প্রথমে ব্যাটিংয়ে গড়টা আরও খারাপ হয়ে যেত, যদি না রামদিন আর ব্রাভো অমন অবিশ্বাস্যভাবে কোহলিকে নতুন জীবন দিতেন! চারপাশ থেকে যেভাবে কোহলি-বন্দনা চলছে, আপাতদৃষ্টিতে চাপে নিষ্কম্প কোহলিও নিশ্চয়ই চাপ অনুভব করছিলেন। ইনিংসের মাত্র নবম ওভারে কিপারের হাতে বল রেখে বাই নিতে ছোটার আর কী ব্যাখ্যা! রামদিনের আন্ডারআর্ম থ্রো স্টাম্পে লাগল না। কোহলি এতটাই দূরে চলে গিয়েছিলেন যে, ব্রাভো আবারও সুযোগ পেলেন রান আউট করার। থ্রো করার বদলে বল গড়িয়ে দিতে গিয়েই বোধ হয় তিনি ভুলটা করলেন।
পরের বলে আবার রামদিনের ব্যর্থতায় কোহলির নতুন জীবন। মোহালিতে ধোনির সঙ্গে কোহলির জুটি ভারতকে সেমিফাইনালে তুলেছিল। দুই ইনিংসের বিরতির সময় মনে হচ্ছিল, ফাইনালেও বোধ হয় নিয়ে গেলেন ওই দুজনই। অপরাজিত তৃতীয় উইকেট জুটিতে মাত্র ২৭ বলে ৬৪ রান। ধোনির অবদান মাত্র ১৫, এটিই বুঝিয়ে দিচ্ছে শেষ দিকের ‘কোহলি-ভয়ংকর’কে। শেষ ৪ ওভারে ৪৫ রান করেছেন মাত্র ১৬ বলে। শুনলেই মনে হবে, না জানি কেমন চার-ছয়ের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন!
এখানেই কোহলি অনন্য। ধুমধাড়াক্কা না মেরে শুধু ক্রিকেটিং শট খেলেও যে রান করা যায় এবং সেটি দ্রুতই করা যায়, প্রতিনিয়তই সেটির প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন। ১৯০ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসে ছক্কা মাত্র ১টি। ৮৯ রানের ৩৯-ই দৌড়ে। ক্রিকেট কোচিং স্কুলগুলোতে কোচদের কাজও খুব সহজ করে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের রানিং বিটুইন দ্য উইকেট শেখাতে তাঁদের কিছুই করতে হবে না। ধোনির সঙ্গে কোহলির রানিং বিটুইন দ্য উইকেটের ভিডিও দেখালেই চলবে।
টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং থেকে অনিশ্চয়তার নামগন্ধও যেন মুছে ফেলতে চাইছেন কোহলি। সর্বশেষ ১২টি ইনিংসে ১০ বারই অপরাজিত, ৮টি হাফ সেঞ্চুরি, ৪০ বা এর বেশি স্কোর ১০টি। রীতিমতো অতিপ্রাকৃত ব্যাপার-স্যাপার! আরও অতিপ্রাকৃত মনে হচ্ছিল, যখন ধোনি তাঁর হাতে বল তুলে দেওয়ার পর প্রথম বলেই উইকেট নিয়ে বসলেন!
শেষ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৮ রান চাই। অশ্বিনের দুটি ওভার তখনো বাকি। তারপরও ধোনি কোহলির হাতে বল তুলে দিলেন কি এই বিশ্বাস থেকে যে, এখন এমন এক সময়, যখন কোহলির ছোঁয়া পেলেই সব সোনা হয়ে যায়!
শেষ পর্যন্ত তা আর হলো না। কোহলির রাত হতে হতে এটি হয়ে গেল সিমন্সের রাত।
আসলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রাত!