টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
ফাইনালে ‘সাহসী ইংল্যান্ড’
উৎপল শুভ্র
১৩ অক্টোবর ২০২১
প্রথম ১০ ওভারের পর থেকে তো এই ম্যাচে একটাই দল। কোটলার আকাশে শুধু ইউনিয়ন জ্যাকই পতপত করে উড়ে গেল।
এউইন মরগানের ইংল্যান্ডও উড়ে যাচ্ছে কলকাতায়। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যা কেউ কল্পনাও করেনি, সেই কল্পনাতীত কাণ্ড ঘটিয়ে ইংল্যান্ড ফাইনালে!
প্রথম প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০১৬। প্রথম আলো।
নিউজিল্যান্ড: ২০ ওভারে ১৫৩/৮। ইংল্যান্ড: ১৭.১ ওভারে ১৫৯/৩। ফল: ইংল্যান্ড ৭ উইকেটে জয়ী।
শুরুটা কী বলছিল, আর শেষে এসে কী হলো!
জস বাটলার যখন স্যান্টনারকে উড়িয়ে ডিপ মিড উইকেটের বাইরে ফেললেন, ঘণ্টা তিনেক আগে ম্যাচের শুরুটা ঝাপসা হয়ে গেছে বেশ আগেই!
প্রথম ১০ ওভারের পর থেকে তো এই ম্যাচে একটাই দল। কোটলার আকাশে শুধু ইউনিয়ন জ্যাকই পতপত করে উড়ে গেল।
এউইন মরগানের ইংল্যান্ডও উড়ে যাচ্ছে কলকাতায়। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যা কেউ কল্পনাও করেনি, সেই কল্পনাতীত কাণ্ড ঘটিয়ে ইংল্যান্ড ফাইনালে!
২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়কে ব্যতিক্রম ধরুন। ব্যতিক্রমই তো! নইলে এরপরও তো সীমিত ওভারের ইংল্যান্ড রীতিমতো হাসি-তামাশার বিষয়ই হয়ে ছিল। যাতে সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটাররাও সাগ্রহে যোগ দিতেন। গত বিশ্বকাপের সময়ই সাবেক ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যান ও কোচ ডেভিড লয়েড আমাকে বলেছিলেন, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে ইংল্যান্ড সেই প্রস্তর যুগে পড়ে আছে। সেই ইংল্যান্ডই ‘সাহসী ক্রিকেট’-এর স্লোগান দিতে দিতে সত্যি সত্যি তা-ই খেলতে শুরু করেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২৩০ রান তাড়া করাটা যদি এর প্রমাণ হয়ে থাকে, এর চেয়ে বড় প্রমাণ সেমিফাইনালে এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। ১৭ বল বাকি থাকতে নিউজিল্যান্ডের ১৫৩ টপকে যাওয়াটা যার কিছুটাই মাত্র বোঝাতে পারছে। সবটা বোঝতে ইংল্যান্ড ইনিংসের শুরু আর শেষটা দেখতে হবে। শুরুর জেসন রয়কে, শেষের জস বাটলারকে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ওই বিশাল স্কোর তাড়া করায় জেসন রয়ের ১৬ বলে ৪৩ রানের ঝোড়ো ইনিংসের বড় ভূমিকা ছিল। টি-টোয়েন্টিতে তাঁর সর্বোচ্চ স্কোরও ছিল সেটি। ‘ছিল’, কারণ কাল অবলীলায় সেটিকে টপকে গেলেন। কোরি অ্যান্ডারসনের প্রথম ওভারেই পাঁচ বলে চারটি চার মেরে নতুন ইংল্যান্ডের বার্তাটা ছড়িয়ে দিলেন প্রতিপক্ষ শিবিরে। মাত্র ২৬ বলে ৫০ হয়ে গেল। যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সেঞ্চুরিও না হয়ে যায়! শেষ পর্যন্ত হয়নি। ৪৪ বলে ৭৮ রান করে আউট। ততক্ষণে নিশ্চিত হয়ে গেছে, মহানাটকীয় কিছু না ঘটলে ইডেন গার্ডেনের ফাইনাল ইংল্যান্ডকেই পাচ্ছে। জেসন রয় ফিরে যাওয়ার সময় ৪৭ বলে ৪৪ রান চাই ইংল্যান্ডের। এটা কোনো ব্যাপার হলো!
একটুও যদি নাটকের সম্ভাবনা জেগে থাকে, সেটি অবশ্য জেসন রয়ের আউট দিয়েই শুরু। ইশ্ সোধি পরের বলেই মরগানকে এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলে দাঁড়িয়ে গেলেন হ্যাটট্রিকের সামনে। বাটলার শুধু হ্যাটট্রিকই ঠেকালেন না, মিটমিট করে জ্বলতে থাকা নিউজিল্যান্ডের আশার প্রদীপও নিভিয়ে দিলেন। সোধির পরের ওভারে পরপর তিনটি বল সীমানার বাইরে পাঠালেন। পরের দুটি মাটির ছোঁয়া পেল সীমানার বাইরে গিয়ে। আগের দুই বলে রুট তুলে নিয়েছেন ৫ রান। শেষ বলে সিঙ্গেলে ওই ওভার থেকেই এলো ২২ রান। হঠাৎই দেখা গেল, দুই দলের স্কোর সমান হয়ে গেছে!
এমন একটা পারফরম্যান্সের শেষটা একটু ভালোভাবে করতে হয়। বাটলার যেভাবে তা করলেন, সেটি তো লেখার শুরুতেই বলা হয়ে গেছে।
এই ম্যাচে আর বলার থাকে একটাই। দারুণ শুরুর পর নিউজিল্যান্ড ইনিংসের অমন পথ হারিয়ে ফেলা। যেটির সবচেয়ে প্রতীকী হয়ে আছে শেষ ৪ ওভার। হাতে ৭ উইকেট নিয়ে একটা দল টি-টোয়েন্টির শেষ ৪ ওভারে কত রান তুলতে পারে? উত্তর নানা রকম হতে পারে, তবে মনে হয় না সেসবের মধ্যে ‘২০ রান’ থাকবে! এটা হয় নাকি! অবিশ্বাস্যভাবে নিউজিল্যান্ডের ইনিংসে সেটিই হলো। ক্রিস জর্ডান ও বেন স্টোকসের বোলিংয়ের কৃতিত্ব অবশ্যই আছে। তবে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের কি একেবারেই নেই! জর্ডান দারুণ কিছু ইয়র্কার করেছেন। কিন্তু শুধু ইয়র্কার কেন, ফুল টস মারাটাকেও তো খুব কঠিন বানিয়ে ছাড়লেন তাঁরা। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে শেষ ৪ ওভারে এত কম রান আর দেয়নি ইংল্যান্ড। ভবিষ্যতেও দেবে কি না, সন্দেহ!
মাত্রই ২০ ওভারের ইনিংস। ওটুকুর মধ্যেই পুরো বিপরীত রূপ দেখিয়ে ফেলল কিউই ব্যাটিং। প্রথম ১০ ওভারেই ৮৯ রান, উইকেট মাত্র ১টি। শেষ ১০ ওভারে রান মাত্র ৬৪। ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি, রান আটকানোর সবচেয়ে ভালো উপায় উইকেট তুলে নেওয়া। ইনিংসের শেষ অর্ধেকটায় নিউজিল্যান্ডের অমন ধুঁকতে থাকার মূলেও ওটি। সাত-সাতটি উইকেট পড়েছে ওই সময়ে।
যেটির শুরু কেন উইলিয়ামসনকে দিয়ে। নিউজিল্যান্ডের সাম্প্রতিক স্বপ্নযাত্রায় ব্যাটিংয়ে ভালো শুরুর বড় অবদান। নিয়মিতই যা এনে দিয়েছেন উইলিয়ামসন ও গাপটিল। এই ম্যাচের আগে দুজনের ১০টি উদ্বোধনী জুটির ৮টিতেই পঞ্চাশের বেশি রান। এর মধ্যে একটা অপরাজিত ১৭১ রানের জুটিও আছে। কাল ওয়ার্নার ও ওয়াটসনের পর মাত্র দ্বিতীয় জুটি হিসেবে তাদের টি-টোয়েন্টিতে এক হাজার রান হয়ে গেল। মাত্র ১৭ রানেই দুজনের বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়ায় এই মাইলফলক উদ্যাপন করার মতো কিছু হয়নি। উইলিয়ামসন ও মানরোর ৭৪ রানের দ্বিতীয় উইকেট জুটি ঠিকই সামলে নিয়েছিল সেটিকে। কিন্তু এরপর থেকেই যে নিউজিল্যান্ড গোলকধাঁধায় পথ হারানো পথিক। আবারও যেন সেই চিরন্তন ‘সেমিফাইনালের দল’!