দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছেন মাশরাফি
উৎপল শুভ্র
৫ অক্টোবর ২০২১
ইনজুরির কারণে সোয়া বছর বাইরে থাকার পর ফিরে এসেছিলেন ২০০৩ বিশ্বকাপে। দুই ম্যাচ খেলার পর আবারও মাঠের বাইরে। এবার এক ভুতুড়ে ইনজুরিতে। বেনোনিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন প্র্যাকটিসের সময় বলের ওপর পা পড়ে যাওয়াটা যে লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়ার মতো ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে নেবে, সেটা মাশরাফি কীভাবে ভাববেন!
প্রথম প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৩। প্রথম আলো।
গতকাল সকালে বেনোনির উইলোমুর পার্কে নতুন বল হাতে মঞ্জুরুল যখন দৌড় শুরু করলেন, তখন মাঠ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে স্যান্ডটন সান হোটেলে তাঁর রুমে বসে টেলিভিশনে তা দেখতে দেখতে চোখ মুছছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা।
সকালে বৃষ্টি হয়েছে, টস জিতে খালেদ মাসুদ যখন ফিল্ডিং নিলেন, আকাশ তখনো মেঘলা। খেলা শুরু করতে হচ্ছে ফ্লাড লাইটের আলোয়। পেস বোলিংয়ের এই আদর্শ পরিবেশ মাশরাফির দুঃখটা আরো বাড়িয়েছে। সকালে তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য লিয়াজোঁ অফিসারকে হোটেলে রেখে বাংলাদেশ দল যখন মাঠের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল, নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না, তারপরও শুভ কামনা জানিয়েছেন সতীর্থদের। টিম বাস ছেড়ে যাওয়ার পর তাঁকে একলা পেয়ে আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরেছে হতাশা-দুঃখ-নিস্ফল ক্রোধ। গত এক বছর ডাক্তার-হাসপাতাল এ সব নিয়েই থাকতে হয়েছে। মাশরাফি মানতেই পারছিলেন না, আবারও ফিরে এসেছে সেই দুঃস্বপ্ন, একটু পরই তাকে আবার যেতে হবে ডাক্তারের কাছে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত মাশরাফির গল্পটা ছিল ‘এলাম, দেখলাম আর জয় করলাম’। ২০০১ সালের নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শুরুটা তা-ই ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ বড় দুর্ভাগা দেশ, খুব কমই কিছু পায়, পেলেও তা ধরে রাখতে পারে না। ২০০১-এরই ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ড সফরে ইনজুরি নিয়েও ওয়েলিংটন টেস্ট খেলার পরই ভেঙে পড়ল মাশরাফির অপ্রস্তুত শরীর। প্রথমে পিঠের ইনজুরি, সেটা কাটিয়ে যখন ফিরে আসার পথে, তখন স্কিপিং করতে গিয়ে দড়িতে পা জড়িয়ে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল তার বাঁ পা। আবার ডাক্তার, আবার হাসপাতাল, আবার নিজেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে কঠিন সংগ্রাম। এ সব করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে আসতে না আসতেই আবার এই ভুতুড়ে ইনজুরি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাশরাফি তাই প্রশ্ন করছেন, ‘কেন আমারই বারবার এমন হবে? স্কিপিং করতে গিয়ে ইনজুরিটা না হয় আমার দোষেই। কিন্তু এবার যা হলো, তাতে তো আমার কোনো দোষ নেই। আমার কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না।’
তারপরও কথা বললেন, সে কথাগুলো বেদনার স্রোত হয়ে উঠে এল তার বুকের গভীর থেকে, ‘কেউ জানে না, গত এক বছর আমি কী কষ্টটাই না করেছি! প্রথমে বলা হয়েছিল আট মাস, তারপর এক বছর। এখন নাকি আবার তিন মাস খেলতে পারব না। বাংলাদেশে সেরকম কোনো ফিজিওথেরাপিস্ট নেই বলে আমি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শিখেছি, যাতে ইন্টারনেটে গিয়ে ফিজিওথেরাপির ব্যাপারে জানতে পারি।’
গত পরশু সকালে ওয়ার্ম আপের সময় যখন ঘটনাটা ঘটল, তখন মাশরাফি এত বড় দুঃসংবাদ কল্পনাও করেননি, ‘বলের ওপর পা পড়ার পর জোরে একটা শব্দ হয়েছে। তবে তারপরও আমি ভেবেছি, বোধহয় মচকে গেছে, বড়জোর এক সপ্তাহ বাইরে থাকতে হবে। লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে, এটা আমি কল্পনাই করিনি।’
বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে— এটা মানতেই বেশি কষ্ট হচ্ছে তাঁর, ‘এই বিশ্বকাপের কথা ভেবেই আরও বেশি কষ্ট করেছি। দুটি ম্যাচ খেলেছি, কিন্তু আমি তো আরও ভালো করতে চেয়েছিলাম, দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম। পারলাম না।’
শেষ কথাটা বলার সময় আবার কান্নায় বুজে এল মাশরাফির গলা। বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু কে কাকে সান্ত্বনা দেবে, খবরটা শুনে মাশরাফির মা-ই উল্টো ভেঙে পড়েছেন কান্নায়। কাঁদতে কাঁদতে মাশরাফিকে বলেছেন, ‘তোরই কেন এমন হবে? প্রথমবার হয়েছিল, মেনে নিয়েছি যে প্লেয়ারদের এমন হতেই পারে। কিন্তু আবার কেন?’
মাশরাফি আর কী বলবেন, তিনিও তো এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছেন। তবে হতাশাটা যত বড় আকার নিয়েই ধাক্কা দিক, মাশরাফি হাল ছাড়ছেন না। কণ্ঠে তখনো কান্নার ছোঁয়া, তবে তার মধ্যে ফাস্ট বোলারের প্রতিজ্ঞার সুরটা টের পাওয়া গেল ঠিকই, ‘আমি আবার কামব্যাক করব, করবই।’
সেটি কতদিনের মধ্যে সম্ভব হবে, তা জানতে আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আইসিসির মেডিকেল প্যানেলের তিন ডাক্তার মাশরাফিকে দেখেছেন গত পরশু। দেখার পর বলেছেন, চার/পাঁচ দিন পর্যবেক্ষণ করার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন তাঁরা। মাশরাফি তাই আপাতত দলের সঙ্গেই থাকছেন। যদি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়, সেটিও দক্ষিণ আফ্রিকাতেই সেরে ফেলা হবে।
অস্ত্রোপচার করতে হলে তো মাঠে ফেরার অপেক্ষাটা আরও বাড়বে। লিগামেন্ট যেহেতু ছিঁড়েই গেছে, অস্ত্রোপচার না লাগলেও অপেক্ষাটা খুব কম দীর্ঘ হবে না। লড়াই তাহলে আবার লড়াই শুরু হলো, মাশরাফি!