বাংলাদেশের আরেকটি হারে সেমিতে ভারত
উৎপল শুভ্র
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
ধোনি শূন্য রান করলেও ভারত হেসেখেলে জেতে। তারপরও নয় বল বাকি থাকতে জিয়াউরকে ছক্কা মেরে যেভাবে ম্যাচটা শেষ করে দিলেন, সেটির একটা প্রতীকী অর্থ দাঁড়িয়ে গেল। শুধু ম্যাচই জেতাল না, এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম দল হিসেবে সেমিফাইনালেও তুলে দিল ভারতকে। আর প্রাথমিক পর্বে দুই জয়ের পর বাংলাদেশের হয়ে গেল হারের হ্যাটট্রিক।
প্রথম প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০১৪। প্রথম আলো।
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৩৮/৭। ভারত: ১৮.৩ ওভারে ১৪১/২। ফল: ভারত ৮ উইকেটে জয়ী।
শ্রীনিবাসন নিয়ে বিতর্কে মহেন্দ্র সিং ধোনিও ভালোই জড়িয়ে গেছেন। ম্যাচ পাতানো কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত চেন্নাই সুপার কিংসের অধিনায়ক তিনি। সিএসকের মালিক শ্রীনিবাসনের কোম্পানি ইন্ডিয়া সিমেন্টসের বড় চাকুরেও। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে শ্রীনিবাসনের চূড়ান্ত অপদস্থ হওয়ার দিনে তাঁর নামেও কালি লেগেছে। অভিযোগ উঠেছে ম্যাচ পাতানো সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সামনে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার।
ম্যাচটা তাই ধোনি যেভাবে শেষ করলেন, তাতে একটুও বিস্ময় নেই। ধোনির ক্যারিয়ারে নানা উত্থান-পতন এসেছে, তবে একটা ব্যাপার কখনোই বদলায়নি। তিনি চলেছেন নিজের তৈরি করা নিয়মেই। সব বিতর্কের জবাব দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন হাতের ব্যাটটাকেই।
এমনিতে কালকের ১২ বলে ২২ রান এমন কিছু নয়। ধোনি শূন্য রান করলেও ভারত হেসেখেলে জেতে। তারপরও নয় বল বাকি থাকতে জিয়াউরকে ছক্কা মেরে যেভাবে ম্যাচটা শেষ করে দিলেন, সেটির একটা প্রতীকী অর্থ দাঁড়িয়ে গেল। যেটি শুধু ম্যাচই জেতাল না, এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম দল হিসেবে সেমিফাইনালেও তুলে দিল ভারতকে। ২০০৭ প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেই শুরু ধোনির অত্যাশ্চর্য গল্পের। এরপর এই প্রথম ভারত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে।
আর বাংলাদেশ? প্রাথমিক পর্বে প্রথম দুই ম্যাচে জয়ের পর হারের হ্যাটট্রিক হয়ে গেল। হংকং-লজ্জা দিয়ে শুরু এই পরাজয়ের মালায় চাইলে অবশ্য আপনি ‘উন্নতি’ খুঁজে পেতে পারেন। হংকংয়ের বিপক্ষে ১০৮, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৯৮-এর পর কাল ১৩৮। উন্নতিই তো!
পরাজয়ের মাত্রায় অবশ্য খুব একটা হেরফের হয়েছে বলা যাচ্ছে না। টি-টোয়েন্টিতে নয় বল বাকি থাকতে ৮ উইকেটে পরাজয়কে টেস্টে ইনিংস হারের সমতুল্যই বলতে পারেন। মিরপুর স্টেডিয়ামকে কানায় কানায় ভরিয়ে তোলা দর্শকদের জন্য এর চেয়েও দুঃখের হলো, ম্যাচের কোনো পর্যায়েই ভারতের জয় নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় না জাগা।
বাংলাদেশের ইনিংসের প্রথম ওভারেই তিনটি চার। রান এলো ১৩। আনন্দ আর হর্ষধ্বনির সমাপ্তিও সেখানেই। এরপরও অনেকবারই কোরাস উঠেছে গ্যালারিতে। সেটি অভ্যাসবশত আর ‘এসেছি যখন আনন্দ করেই যাই’ ভেবে।
এই একটা ম্যাচ, যেটির আগে দুবার ‘রবীন্দ্রনাথ’ বাজেন। ‘আমার সোনার বাংলা...’ ও ‘জন গন মন...’ দুই দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতাই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ম্যাচ শুরু হওয়ার মিনিট দশ-বারোর মধ্যে বাংলাদেশের ইনিংস এলোমেলো করে দেওয়ার মূলেও আরেক ‘রবি’। রবিচন্দ্রন অশ্বিন।পরপর দুই বলে উইকেট নিয়ে সাড়ে তিন ওভারে বাংলাদেশকে যিনি ২ উইকেটে ২০ বানিয়ে দিলেন।
ভারতীয় অফ স্পিনার উপমহাদেশে সীমিত ওভারের ক্রিকেটের রীতি অনুযায়ী এক পেসারের (ভুবনেশ্বর কুমার) নতুন বলের সঙ্গী। নিজের দ্বিতীয় ওভারেই ওই যুগল আঘাত। প্রথমে তামিম ইকবাল। একমাত্র স্লিপকে যিনি ক্যাচিং প্র্যাকটিস করালেন। পরের বলে শামসুরের কাণ্ডের কাছে অবশ্য যেটিকে খুবই ‘নির্দোষ’ দেখাল।
ব্যাটিং ব্যর্থতায় এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবারই পালাক্রমে সুযোগ মিলছে। শামসুরের যেমন সুযোগ এলো প্রথম ম্যাচ খেলার। যেন ঠিক করেই নেমেছিলেন, সুযোগ যখন পেয়েছি, যা করার প্রথম বলেই করে ফেলতে হবে! প্রথম বলেই তাই তেড়েফুঁড়ে সুইপ করতে গেলেন। এটাও ক্যাচিং প্র্যাকটিসের মতোই দেখাল। ডিপ স্কয়ার লেগের ফিল্ডারকে এক চুলও নড়তে হলো না।
অশ্বিনের ‘দুই বলে দুই’-এর পর ধারাভাষ্য কক্ষে শোয়েব আখতারের দিকে চেয়ে কি মুচকি একটা হাসি দিয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী! জানা গেল না। তবে যেটি জানা গেল, তা হলো দুই ইনিংসের বিরতির সময় মাঠে এই অশ্বিনকে নিয়েই দুজনের মধ্যে এক চোট হয়ে গেছে। সৌরভ অশ্বিনের প্রশংসা করায় শোয়েব নাকি ব্যঙ্গের সুরে বলে বসেন, ওর সব জারিজুরি তো দেশেই। ভারতের বাইরে পারফর্ম করল কবে?
দুজনের ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সম্পর্কের ইতিহাস সেই খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই। সৌরভ তাই রাগত জবাব দেন। নানা সূত্রে জবাব-টবাবের কথা জানা গেল পরে। যা প্রেসবক্স থেকে দেখা দুজনের শরীরী ভাষার সঙ্গে খুব মিলে গেল।
অশ্বিন শুরুটাকে এলোমেলো করে দিয়েছিলেন। তবে মোক্ষম আঘাতটি হানলেন প্রথম ওভারে ১৩ রান দেওয়া ভুবনেশ্বর কুমারই। ব্যাটের কানা ও প্যাড ছুঁয়ে বল সাকিবের স্টাম্পে। পঞ্চম ওভারের শুরুতে ৩ উইকেটে ২১ রানেই আসলে স্বপ্নের সমাধি।
এরপর এনামুলের ৪৩ বলে ৪৪ আর মাহমুদউল্লাহর ২৩ বলে ৩৩ ম্যাচটার আয়ু বাড়ানোটাই শুধু নিশ্চিত করতে পারল। ১৩৮ কি আর কোনো রান নাকি! ভারতের এই ব্যাটিং লাইন আপ বাংলাদেশের এই বোলিংয়ের বিপক্ষে ২০ বারের মধ্যে ১৯ বারই আরামে যা টপকে যাবে।
স্কোরবোর্ডে ১৩ রান উঠতেই ধাওয়ানকে বোল্ড করে আল আমিন ক্ষীণ একটা আশা জাগিয়েছিলেন, ২০ বারের মধ্যে ‘একবার’ এই রাতেই নয় তো! রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলির শতরানের জুটি এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিল সেই আশার প্রদীপ।
জয় থেকে ভারত যখন ২৬ রান দূরে, রোহিত শর্মাকে ফিরিয়ে দিলেন মাশরাফি। কে নামছেন এবার? রায়না নাকি ফর্মে ফেরানোর জন্য যুবরাজকে পাঠালেন ধোনি?
নামলেন ধোনি নিজেই। হয়তো প্রতীকী ওই ছক্কাটা দিয়ে ম্যাচ শেষ করবেন বলেই!