আয়ারল্যান্ডের কাছে পরাজয় কি আসলেই অঘটন?
উৎপল শুভ্র
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
আয়ারল্যান্ডের কাছে প্রস্তুতি ম্যাচে হারার পর মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্মৃতি। নটিংহামে এই আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজয়ের কারণেই অধিনায়কত্ব হারিয়ে ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। ম্যাচের পরই প্রেস কনফারেন্সে এসে তাঁর দলের ক্রিকেটারদের ধুয়ে দেওয়া কোচ জেমি সিডন্সের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম তাঁর ক্ষোভের কারণ। এর সঙ্গে নিজের বোঝা-শোনা মিলিয়ে ক্রিকেটারদের সমস্যার একটা তালিকাও তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
প্রথম প্রকাশ: ১০ জুন ২০০৯। প্রথম আলো।
সাতসকালে বাংলাদেশ থেকে ফোন— ‘ভাই, বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের বলে দেন, ওদের আর দেশে ফেরার দরকার নাই!’
আশরাফুলদের তো তা হলে উভয় সংকট। তাঁরা যাবেন কোথায়? ইংল্যান্ডে থেকে যাওয়াটাও তো খুব একটা প্রীতিকর হবে বলে মনে হচ্ছে না। আয়ারল্যান্ড-বিপর্যয়ের পর গত পরশু ট্রেন্ট ব্রিজের বাইরে দাঁড়িয়ে গালে লাল-সবুজ আঁকা প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণদের দলটা যে মহা-উত্তেজিত হয়ে বলে দিয়েছে, ‘এই খেলা দেখার জন্য এত কষ্ট করেছি, ভাবতেই খারাপ লাগছে। ওদেরকে এখনই দেশে ফেরত যেতে বলুন।’
গত পরশু শ্রীলঙ্কা দলকে ট্রেন্ট ব্রিজে ‘অভ্যর্থনা’ জানাল তামিল বিক্ষোভ। আর বাংলাদেশকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংবর্ধনা। সারাক্ষণ তারস্বরে চেঁচিয়ে সমর্থন জানিয়ে যাওয়া জার্সি-পতাকায় সুসজ্জিত এমন দর্শক বাংলাদেশের গ্যালারিতেও খুব সহজদৃষ্ট নয়।
অথচ মাঠে কী হলো? ওসব বিক্ষোভ-টিক্ষোভকে ক্রিকেটের বাইরের ব্যাপার বলে পাত্তা না দিয়ে সত্যিকার পেশাদার এক পারফরম্যান্সে অস্ট্রেলিয়াকে উড়িয়ে দিল শ্রীলঙ্কা। আর সফরে প্রথমবারের মতো চাপের মুখে পড়ে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা পেশাদার পরিচয়ে ছড়িয়ে দিল ছোপ ছোপ কালির দাগ।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজয়ের পরপরই বাংলাদেশ দলকে দেশে ফেরার টিকিট ধরিয়ে দিয়েছে আইসিসি। কাল সকাল আটটায় নটিংহাম থেকে লন্ডনের উদ্দেশে বাস ছাড়ল। সেখান থেকে বিকেলের ফ্লাইটে দেশের পথে যাত্রা। তবে মোহাম্মদ আশরাফুল, সাকিব আল হাসান ও জেমি সিডন্স সেই যাত্রায় শামিল হননি। না, অন্য কোনো কারণ খুঁজতে যাবেন না। সিডন্স এখান থেকেই ছুটি কাটাতে কাল রাতে অস্ট্রেলিয়ায় উড়ে গেলেন। আশরাফুল-সাকিব থেকে গেলেন ডাক্তার দেখাতে। সাকিবের সমস্যা কুঁচকিতে, আপাতত ইনজেকশনেই যেটির সমাধান সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক। আশরাফুলের সমস্যা চোখে, যেটির সম্ভাব্য সমাধান অস্ত্রোপচার বলে ভাবা হলেও শেষ পর্যন্ত হয়তো তা লাগছে না।
চোখে এলার্জি-জনিত সমস্যায় অনেক দিনই ভুগছেন আশরাফুল, খুব একটা পাত্তা দেননি। আইপিএলে খেলার সময় চোখ থেকে অনবরত পানি পড়তে থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকায় ডাক্তার দেখাতে বাধ্য হন। সেই ডাক্তার চোখের অবস্থা বেশ খারাপ বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছে জানিয়ে দিয়েছিলেন, লেসার অস্ত্রোপচার ছাড়া আর কোনো পথ নেই। সেটিরই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে কাল বিকেলে লন্ডনের ডাক্তারের কাছে গিয়ে আশরাফুল অবশ্য সুখবরই পেলেন। তেমন কোনো সমস্যা নেই, অস্ত্রোপচারও লাগবে না, ড্রপ ব্যবহারেই নাকি নিরাময় সম্ভব।
আশরাফুলের চোখ থেকে প্রায়ই পানি পড়ে। আয়ারল্যান্ডের কাছে আবারও অপদস্থ হওয়ার পর আরও বেশি পড়ার কথা। আসলেই কি তাই? দলের কিছু সূত্র যে জানাচ্ছে, বাংলাদেশ দলের পরাজয়ে পুরো দেশ যেমন মুষড়ে পড়ে, খেলোয়াড়দের প্রতিক্রিয়া মোটেই সে রকম হয় না। হবে কেন? তাঁরা পেশাদার—পেশাদারদের তো জয়-পরাজয় দুটিই সহজভাবে নিতে হয়। সমস্যা হলো, পরাজয়কে গায়ে না-মাখা ছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রে যে এই পেশাদারিত্বের পরিচয়টা খুঁজে পাওয়া ভার!
টি-টোয়েন্টি উল্টোপাল্টা হওয়ারই খেলা। এই দেখুন না, দুই ম্যাচেই হেরে বাংলাদেশের সঙ্গে একই দিনে কেমন বিদায় নিয়ে নিল অস্ট্রেলিয়াও। বাংলাদেশও তাই আয়ারল্যান্ডের কাছে হারতেই পারে। মূল সমস্যাটা ওই পরাজয় নয়, কোচ জেমি সিডন্স যেসব দিকে ইঙ্গিত করছেন, সেসব। মাঠে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করার সঙ্গে মাঠের বাইরে খেলোয়াড়দের বিশৃঙ্খল জীবনের যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছেন কোচ। পরশু ম্যাচ-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে সিডন্সের বক্তব্য নিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের মধ্যে মহা-আলোড়ন। তাঁদের কাছে ‘ডিসিপ্লিন’-এর সমস্যা মানেই যে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস জাতীয় কোনো খবরের গন্ধ। সংবাদ সম্মেলনে খেলোয়াড়দের অমন ধুয়ে দিতে দেখে এক ইংরেজ সাংবাদিক এমনও জানতে চাইলেন, ‘এটা কি লেখা যায়, সিডন্স দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন?’
ওই সংবাদ সম্মেলনের পাঁচ ঘণ্টা পর পার্ক প্লাজা হোটেলের লবিতে সাক্ষাত্কার দেওয়ার সময় সিডন্সের ‘রাগ’ অবশ্য ‘হতাশা’য় রূপান্তরিত। তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যাও পাওয়া গেল তখনই, ‘আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। সময়মতো টিম বাসে ওঠা, ঘুম-খাওয়া এসবে নিজের যত্ন নেওয়া, ঠিকমতো অনুশীলন করা—এসবও তো খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা যদি নিজেদের পেশাদার মনে করে, তাহলে এসব ক্ষেত্রেও তাদের পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে হবে।’
সেটি যে তাঁরা দিচ্ছেন না, সেটি পরিষ্কার করে দিয়ে সিডন্স জানালেন, বারবার বলেও যখন কিছু হচ্ছে না, এসব ঠিক করার জন্য তিনি জরিমানা জাতীয় শাস্তির ব্যবস্থা করার কথা ভাবছেন। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজয়ে খেলোয়াড়ি দক্ষতা, বা বলা ভালো সেটির অভাবের কোনো ভূমিকা দেখছেন না। চাপের মুখে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতাকেই দায়ী করছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যেখানে খুব দ্রুত শিখতে হয়, সেখানে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা দিনের পর দিন, ম্যাচের পর ম্যাচ একই ভুল করে যাচ্ছে বলে সিডন্সের আক্ষেপটা প্রায়ই প্রকাশিত হয়ে পড়ল। এর পরও ‘দক্ষতার ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় উন্নতি আছে’ বলে সিডন্স আশার কথা শোনাতে চাইলেও দলের কিছু সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সমস্যার তালিকা করলে সেটি ভয়াবহ দেখায়—
* জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েই আত্মতৃপ্তি। এই বিশ্বকাপে জাতীয় দলে প্রথম সুযোগ পাওয়া দুজনও সেটি স্পষ্ট করে দিয়ে গেছেন।
* বেশির ভাগ খেলোয়াড়ের ক্রিকেটীয় বুদ্ধিমত্তার স্তর খুব নিচুতে। তারই একটা উদাহরণ—ট্রেন্ট ব্রিজে একদিকের বাউন্ডারি ছোট। আইরিশরা ছক্কা মেরেছে সেদিকেই। অথচ বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা উল্টো দিকে মারতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছে।
* বিশ্ব পর্যায়ে খেলছি, বিশ্বসেরাদের সঙ্গে লড়ে নিজেকে চিনিয়ে দেব—এই অহংবোধ বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেশির ভাগের মধ্যেই অনুপস্থিত।
* নিজের খেলায় উন্নতির জন্য বাড়তি পরিশ্রম করতে অনীহা। প্র্যাকটিসে অবশ্য-পালনীয় কাজগুলোও ঠেলে-ধাক্কিয়ে করাতে হয়।
* নিজের স্বাস্থ্য বা খেলার জন্য ক্ষতিকর জেনেও সেগুলো করা। জেমি সিডন্স তো বলেই দিলেন—এই টুর্নামেন্টে সবচেয়ে আনফিট দল ছিল বাংলাদেশ।
সব মিলে যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজয়টাকে অঘটন বলতেও বাধো-বাধো ঠেকছে। বরং টাকার অভাবে আয়ারল্যান্ড ক্রিকেট মাত্র দুজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে কেন্দ্রীয় চুক্তি করতে পেরেছে আর পর পর দুটি বিশ্বকাপে হেরেও বাংলাদেশ কেন আইসিসি থেকে তাদের চেয়ে ১০ গুণ টাকা পেয়ে যাবে—ব্রিটিশ মিডিয়ার একটা অংশের তোলা প্রচ্ছন্ন এই প্রশ্নটাকেও একেবারে অযৌক্তিক মনে হচ্ছে না!