মার্টিন ক্রো-রস টেলর
গুরুকে ‘ছাড়িয়ে’ অশ্রুসিক্ত শিষ্য
উৎপল শুভ্র
২০ সেপ্টেম্বর ২০২১
মার্টিন ক্রোর সেঞ্চুরির রেকর্ড ছোঁয়ার পর রস টেলর নিজেকে আর সামলাতে পারেননি। জলে টলোমলো চোখ নিয়ে দিনের খেলা শেষে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ভেঙে পড়েন। সাক্ষাৎকার যিনি নিচ্ছিলেন, তাঁর চোখও শুকনো ছিল না। ইয়ান স্মিথ যে ছিলেন মার্টিন ক্রোর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
প্রথম প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০১৯। প্রথম আলো।
মৃত্যুর পদধ্বনি যখন শুনতে পাচ্ছেন, তখন একদিন মার্টিন ক্রো তাঁকে বলছিলেন, ‘যদি মাঠে কোনো প্রজাপতি দেখো, বুঝে নিয়ো সেটাই আমি।’
২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর ব্যাটিং করার সময় হ্যামিল্টনের সেডন পার্কে একটা প্রজাপতি উড়ে আসতে দেখলেন রস টেলর। তখন তিনি ৭০-এর ঘরে। তারপর সেঞ্চুরি হলো। মার্টিন ক্রোর সমান ১৭টি টেস্ট সেঞ্চুরি। ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে মার্টিন ক্রো চলে গেছেন এর প্রায় পৌনে দুই বছর আগেই। যাঁকে ফোন করে টেলর বলেছিলেন, ‘আপনি কি আমার “মেন্টর” হবেন? আমি আপনার ১৭টি টেস্ট সেঞ্চুরিকেও ছাড়িয়ে যেতে চাই।’
সেটি ২০০৬ সাল। রস টেলরের তখনো টেস্ট অভিষেকই হয়নি। মাত্রই খেলতে শুরু করেছেন নিউজিল্যান্ডের ওয়ানডে দলে। ২২ বছরের তরুণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর আত্মবিশ্বাস ক্রোকে এমনই মুগ্ধ করেছিল যে, সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। কদিন পরই ক্রোর সঙ্গে কথা বলতে অকল্যান্ডে উড়ে যান টেলর। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে সবচেয়ে বিখ্যাত গুরু-শিষ্য জুটির গল্পের সেই সূচনা।
আর শেষ মার্টিন ক্রোর মৃত্যুতে। সুসময়ে, দুঃসময়ে—সব সময়ে আমৃত্যু টেলরের পাশে ছিলেন ক্রো। ক্রোর সেঞ্চুরির রেকর্ড ছোঁয়ার পর টেলর তাই নিজেকে আর সামলাতে পারেননি। জলে টলোমলো চোখ নিয়ে দিনের খেলা শেষে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ভেঙে পড়েন। সাক্ষাৎকার যিনি নিচ্ছিলেন, তাঁর চোখও শুকনো ছিল না। ইয়ান স্মিথ যে ছিলেন মার্টিন ক্রোর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মৃত্যুর আগে যাঁকে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে অনুরোধ করেছিলেন, ‘আমার শেষকৃত্যে বিদায়ী বক্তৃতাটা তুমিই দিয়ো।’ তিনজনের আড্ডায়-গল্পে কত ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় উড়ে গেছে, আর আজ তাঁরা দুজন যাঁকে নিয়ে কথা বলছেন, সেই তৃতীয় জন কি না পৃথিবী থেকে চলে গেছেন মাত্র ৫৩ বছর বয়সেই। আবেগ তো ছুঁয়ে যাবেই টেলর-স্মিথকে।
কাল বেসিন রিজার্ভেও কি কোনো প্রজাপতিকে উড়তে দেখেছেন টেলর! হয়তো না। এ কারণেই কি ছক্কা মেরে সেঞ্চুরি করার পর আকাশের দিকে তাকিয়ে মার্টিন ক্রোকে খুঁজলেন! সেই সেঞ্চুরিকে ডাবলে রূপ দেওয়ার পর দিনের খেলা শেষে আবারও টেলরের সামনে মাইক্রোফোন হাতে সেই ইয়ান স্মিথ। এবার আর কাঁদলেন না রস টেলর। পরে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন, কারণ হয়তো সেটাই—‘হোগান (মার্টিন ক্রো) সব সময় আমাকে তাঁর ১৭ সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা বলতেন। তিনি নিশ্চয়ই খুশি হয়েছেন।’
ক্রোর ১৭ সেঞ্চুরি এখন আর নিউজিল্যান্ডের রেকর্ড হয়ে নেই। টেলর যখন তা ছুঁয়েছিলেন, তার আগেই কেন উইলিয়ামসন তা ছুঁয়ে ফেলেছেন। কে জানে, অন্যভাবে হলেও প্রিয় হোগানের সঙ্গ পেতেই কি পনেরো মাস সেই ১৭-তেই আটকে থাকলেন টেলর! উইলিয়ামসন এরই মধ্যে করে ফেলেছেন আরও তিনটি সেঞ্চুরি। ১৭ থেকে ১৮-তে যেতে টেলরের এত দিন লাগল যে! ইয়ান স্মিথকে বলেছেন, ‘১৭ নম্বর সেঞ্চুরিটাকে এত বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলাম যে, ১৮-এর প্রতি একটু মনে হয় অবহেলাই করা হয়েছে।’ সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ১৭ নম্বর সেঞ্চুরিটা নিয়ে এতই আচ্ছন্ন ছিলেন যে, সেটি করে ফেলার পর বোধ হয় একটা তৃপ্তি ভর করেছিল। একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচার অনুভূতিও। ‘একটা সময়ে এই ১৭ যে কত বড় একটা সংখ্যা ছিল!’—এখন স্বাভাবিক মনে হওয়া অর্জনটা যে একসময় এমন ছিল না, বললেন সেটিও।
সেঞ্চুরিতে মার্টিন ক্রোকে ছাড়িয়ে যাওয়ার দিনে ভেঙে দিয়েছেন তাঁর আরেকটি রেকর্ডও। প্রথমটিতে ক্রো খুশিই হবেন বলে তাঁর ধারণা, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে নিশ্চিত নন। এটা কি এ কারণে যে, কালকের আগ পর্যন্ত ওই একটা রেকর্ডই অক্ষত ছিল মার্টিন ক্রোর। ১৯৯৫ সালে নিউজিল্যান্ডের পক্ষে টেস্টে সবচেয়ে বেশি রান ও সেঞ্চুরির রেকর্ড নিয়েই অবসর নিয়েছিলেন ক্রো। রানের রেকর্ড ভেঙে গেছে সেই ২০০৪ সালেই, যেটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশও। সে বছর অক্টোবরে বাংলাদেশের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টেই ক্রোকে ছাড়িয়ে যান স্টিভেন ফ্লেমিং। রেকর্ডটি এখনো তাঁরই। পরে একে একে ক্রোকে ছাড়িয়ে গেছেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, রস টেলর ও কেন উইলিয়াসনও। সেঞ্চুরির রেকর্ড অক্ষত দেখেই চিরদিনের জন্য চোখ বুজেছিলেন ক্রো। সেই রেকর্ড ভেঙেছে গত বছর মার্চে। বাকি যে একটা রেকর্ডই তাঁর ছিল—নিউজিল্যান্ডের এক ভেন্যুতে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড—কাল সেটিও ভেঙে দিলেন টেলর।
বেসিন রিজার্ভে ক্রোর ১১২৩ রানকে ছাড়িয়ে যেতে অবশ্য ৪টি ইনিংস বেশি খেলতে হয়েছে তাঁকে। ব্যাটিং গড়েও এগিয়ে মার্টিন ক্রো (ক্রো ৭০.১৮, টেলর ৬৪.৫২)। সেটিই স্বাভাবিক, ক্রোর ১৭ টেস্ট সেঞ্চুরির ৫টিই এই মাঠে। টেস্টে সর্বোচ্চ রানও। ১৯৯১ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ট্রিপল সেঞ্চুরির দরজা থেকে তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিল অর্জুনা রানাতুঙ্গার নিরীহদর্শন স্লো মিডিয়াম পেস। ক্রোতে টেলর এমনই আচ্ছন্ন যে, সেটিও মনে পড়েছে তাঁর, ‘একবার মনে হচ্ছিল, এই মাঠে মার্টিন ক্রো ২৯৯ রানে আউট হয়েছিলেন, আমি বোধ হয় আজ ১৯৯ রানে আউট হয়ে যাব।’
আউট হয়ে যেতে পারতেন তো ২০ রানেই। সকালে আবু জায়েদ রাহীর এক ওভারেই দু–দুবার ক্যাচ পড়েছে তাঁর। প্রথমে শর্ট কাভারে ফেলেছেন মাহমুদউল্লাহ, এক বল পরই দ্বিতীয় স্লিপে সাদমান। ওই ওভারে টেলরকে নাচিয়ে ছেড়েছেন রাহী। ডাবল সেঞ্চুরি কেন, তখন সেঞ্চুরির কথা ভাবারও সাহস পাননি টেলর, ‘এই উইকেটে ডাবল সেঞ্চুরির কথা ভাবার প্রশ্নই আসে না। সকালে তো সেঞ্চুরির কথাও ভাবার মতো অবস্থা ছিল না।’
তিন বলের মধ্যে যখন দুবার ভাগ্যদেবী তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসলেন, তখন মনে পড়েছে দুই মাস আগে এই মাঠে খেলা সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচটির কথা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই টেস্টে আগের দিন ৫০ রানে অপরাজিত টেলর তৃতীয় দিন প্রথম ওভারেই আউট হয়ে গিয়েছিলেন দিমুথ করুনারত্নের নেওয়া অবিশ্বাস্য এক রিফ্লেক্স ক্যাচে। যে ক্যাচটি আসলে হওয়ার কথা নয়। টেলর নিজেকে সেদিন এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, আজ ভাগ্য যেমন মুখ ফিরিয়ে নিল, একদিন আবার সেটি তোমার দিকে তাকিয়ে হাসবেও।
কী আশ্চর্য, একই মাঠে পরের টেস্টেই তা ঠিকই হাসল। একই দিনে প্রিয় শিষ্যের দুই অর্জনে মৃত্যুর সেতু দিয়ে পৌঁছানো সেই রহস্যলোক থেকে হয়তো হাসছিলেন মার্টিন ক্রো-ও!