মাহমুদউল্লাহরও প্রথম পছন্দ ছিলেন না তামিম
উৎপল শুভ্র
১০ সেপ্টেম্বর ২০২১
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাংলাদেশ দলে চমক বলতে কিছু নেই। চমক বলতে যা বোঝায়, তা তো কয়েক দিন আগেই সবাই পেয়ে গেছেন। নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার কারণ হিসেবে তামিম ইকবাল যা বলেছেন, তা বিশ্বাস করলে বুঝতে হবে, আপনি খুব সরল মনের মানুষ। আসল কারণ অবশ্যই অন্য কিছু। যা খুঁজতে গিয়ে সংবাদমাধ্যম পেয়েছেন কোচ রাসেল ডমিঙ্গোকে। কিন্তু অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহও কি তাঁর দলে চেয়েছিলেন তামিমকে?
যেকোনো সিরিজ বা টুর্নামেন্টের জন্য ক্রিকেট দল ঘোষণা করার পর সাংবাদিকদের কিছু রুটিন কাজ থাকে। দলে নতুন কেউ আছে কি না, তা খুব খেয়াল করে দেখতে হয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যদি নতুন না-ও হয়ে থাকেন, যে ফরম্যাটের জন্য দল, সেই ফরম্যাটে আগে ম্যাচ খেলেছেন কি না। নির্বাচকদের ঘোষিত দল নিয়ে বেশির ভাগ নিউজে আপনি ‘আনক্যাপড’ শব্দটা পাবেন। খবরের বদলে ‘নিউজ’ লিখেছি ‘আনক্যাপড’ শব্দটা লিখব বলেই। সরাসরি প্রতিশব্দ পাওয়া কঠিন। বাংলায় এক সময় লেখা হতো ‘নবাগত’। ‘নতুন মুখ’-ও খুব প্রচলিত।
লেখার জন্য তো বটেই, শিরোনাম করার জন্যও নতুন কেউ আছে কি না দেখতে হয়। খুব বেশি পরিচিত নয়, জাতীয় দলের আশেপাশে সেভাবে কেউ ছিলেন না, এমন কাউকে নির্বাচকেরা দলে নিলে শিরোনাম করাটা সহজ হয়ে যায়। আরও সহজ হয় দলে কোনো চমক থাকলে। চমক বলতে অনেক বছর ধরে খেলে আসছেন, এমন কেউ বাদ পড়ে গেলে।
এই দীর্ঘ ভূমিকার কারণ আপনার বুঝে ফেলার কথা। অন্তত কী প্রসঙ্গে এটা বলছি, তা তো অবশ্যই। আজ দুপুরেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য বাংলাদেশ দল ঘোষণা করা হয়েছে। সেই দলটায় চোখ বুলাতে বুলাতে ভাবছিলাম, পত্রিকা বা অনলাইনে এই খবরটার শিরোনাম কী হতে পারে। দলে নতুন কেউ নেই, কোনো চমকও নেই, গৎবাঁধা ‘টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাংলাদেশ দল ঘোষণা’ ছাড়া অন্য কোনো শিরোনাম করা তো আসলেই কঠিন। একবার ভেবে দেখুন, তামিম ইকবাল যদি আগে থেকেই নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা না দিতেন, তাহলে তামিমবিহীন এই দল কেমন আলোড়ন তুলত। শিরোনাম করার কাজটাও হয়ে যেত জলবৎ তরলং।
লিখতে লিখতেই মনে হলো, আলোড়ন যা ওঠার, তা তো তামিমের সরে দাঁড়ানোর ঘোষণাতেই উঠে গেছে। তামিম সরে না দাঁড়ালেও বিশ্বকাপের দল কোনো আলোড়ন তুলত না। কারণ দলে থাকতেন তামিম। নির্বাচকেরা তাঁকে রেখেই বিশ্বকাপের দল করেছিলেন। ‘দলে ফিরলেন তামিম’ জাতীয় কোনো শিরোনামই বড় জোর করা যেত তখন।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার যে কারণের কথা বলেছেন তামিম ইকবাল, তা বিশ্বাস করার কোনো কারণ তখনো দেখিনি। এখন তো আরও না। এত দিন বাইরে থাকার সময় যারা খেলেছেন, দলে ফিরে তাদের কারও জায়গা নিয়ে নেওয়াটা আনফেয়ার হবে...তামিমের মূল কথা তো এটাই ছিল, তাই না? পেশাদার টিম স্পোর্টস কি এই নিয়মে চলে নাকি! ইনজুরির কারণে বাইরে চলে যাওয়া দলের কোনো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় আবার দলে ফিরবেন তো কারও না কারও জায়গাতেই। একটা উদাহরণ দিয়েই বলি। তামিম যে কারণের কথা বলেছেন, তা অনুসরণ করলে তো মাশরাফি বিন মুর্তজার এত বছর খেলাই হয় না। মাশরাফি বাইরে থাকার সময় তাঁর বদলে যারা খেলেছেন, তাদের কারও জায়গাই তো তিনি নিয়েছেন, তাই না?
টি-টোয়েন্টি দলে চমক না থাকার কথা বলছিলাম। একটা বড় কারণ তো অবশ্যই এই যে, মাস দেড়েকের মধ্যে বাংলাদেশ টানা ১২টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলায় দলের সম্ভাব্য চেহারাটা সবার কাছেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনী মিটিংয়ে নির্বাচকদের তাই খুব বেশি সময় ব্যয় করতে হয়নি বলেই অনুমান করে নিতে পারেন। যে অনুমান সত্যি না হওয়ার সম্ভাবনার কারণও তামিম ইকবাল।
তামিম দলে থাকবেন কি থাকবেন না, নির্বাচনী মিটিংয়ে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় হয়েছে এ নিয়েই। যার সারাৎসার এরই মধ্যে সংবাদ মাধ্যমে কিছুটা প্রকাশিত। আপনিও হয়তো জেনে গেছেন, কোচ রাসেল ডমিঙ্গো তামিমকে দলে চাননি। হয়তো এ-ও জেনেছেন, তাঁর যুক্তি ছিল, অনেক দিন টি-টোয়েন্টি দলের বাইরে থাকা তামিমকে নিলে দলের সঙ্গে ছিলেন, এমন একজন তরুণ খেলোয়াড়কে বাদ দিতে হবে। এত দিন ‘টি-টোয়েন্টি দলে তামিমকে চাই না’ আওয়াজ তোলা অনেককেই ‘তামিমকে দলে চাই’ দাবি তুলে ডমিঙ্গোকে ভিলেন বানানোর চেষ্টাও দেখেছি। একমাত্র বাংলাদেশের ক্রিকেটেই মনে হয়, তারকা কোনো খেলোয়াড় বাদ পড়লে ভক্তদের মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার রেওয়াজ আছে। সে ধরনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল বলেই দেখেছি ফেসবুকে। শেষ পর্যন্ত সেই মানববন্ধন হয়েছে কি না, তা অবশ্য আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না।
তামিম যেদিন সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেন, তার একদিন পরই বিশ্বকাপ দল ঘোষণা করার কথা ছিল। তামিমকে রেখেই বিসিবির কাছে দল জমা দিয়েছিলেন নির্বাচকেরা। তামিম নিজেই সরে যাওয়ার পর তাঁর জায়গায় কে আসবেন, তা ঠিক করতেও একদমই সময় লাগেনি। কারণ নির্বাচনী সভায় তামিম প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার সময় এ নিয়ে কথা তো হয়েই ছিল।
বিসিবি সভাপতি নির্বাচকদের দল পাওয়ার পরও সেটিকে অনুমোদন দিতে দেরি করায় স্বাভাবিকভাবেই মাঝের কয়েক দিন গুঞ্জন ডালপালা ছড়িয়েছে। শোনা গেছে তামিম ইকবালকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টার কথাও। সেই চেষ্টা আসলেই হয়েছিল। বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান স্বয়ং এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলেই জানি। তাতে যে কাজ হয়নি, তা তো আর বলার দরকার পড়ছে না। কিন্তু বোর্ড সভাপতি না তামিমের সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তের পর তা মেনে নেওয়ার কথা বলে আগামী বছর অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে তামিমকে পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। হঠাৎ তাহলে কেন আবার ‘তামিমকে ছাড়া চলবেই না’ বলে মনে হলো তাঁর?
এই প্রশ্নের উত্তর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের তৃতীয় ম্যাচ। যে ম্যাচে জিততে মাত্র ১২৯ রান করলেই চলত, কিন্তু বাংলাদেশ মাত্র ৭৬ রানে অলআউট হয়ে যায়। যা দেখে বোর্ডের কর্তাব্যক্তিদের মনে তামিমের জন্য নতুন করে হাহাকার জেগে ওঠে। আহা, তামিম থাকলেই তো এই ম্যাচে বাংলাদেশ জিতে যায়! মজাটা হলো, ওই ম্যাচে শুধু ওপেনাররাই নন, ব্যর্থ বাংলাদেশের সব ব্যাটসম্যানই। শুধুই রানসংখ্যার হিসাবে গেলে লিটন ১৫ রান করেছেন, নাঈম ১১...এর চেয়ে বেশি রান করেছেন শুধু মুশফিক। কিন্তু তাঁর ৩৭ বলে ২০ রানের সেই ইনিংস ওপেনারদের চেয়েও হতশ্রী ছিল।
পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছিল, চতুর্থ ম্যাচটাও বাংলাদেশ হেরে গেলে তামিমের মানভঞ্জনের জন্য আরও অনেক কিছুই করা হতো। বাংলাদেশ তা জিতে যাওয়ায় তামিমের জন্যও তাই ভালো হয়েছে। তামিমের জন্য ভালো কেন? কারণ বোর্ড থেকে চাপ দিলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করে উপায় থাকত না। তখন মানুষের কাছে তাঁর মুখ থাকত নাকি? ভিডিওতে এসে পাবলিকলি বিশ্বকাপ দল থেকে সরে দাঁড়ানোর যে কারণের কথা বলেছেন, তা তো মাঝখানের তিন/চার দিনে বদলে যায়নি। আসল কারণটা তিনি তখনো বলেননি, এখনো বলতে পারতেন না।
শেষ পর্যন্ত তামিমকে ছাড়াই তাই ঘোষিত হয়েছে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল। যাতে কোনো চমক নেই বলে কৌতূহলের বিষয় হতে পারে একটাই, তামিমকে রেখেই যে প্রথমে যে দলটা বেছে নিয়েছিলেন নির্বাচকেরা, তাতে ঘোষিত ১৫ জনের কে বাইরে ছিলেন? সাধারণ ক্রিকেট বুদ্ধি বলে, নিশ্চয়ই দলে থাকা তিন ওপেনারের একজন। কিন্তু আসল ঘটনা বোধ হয় তা নয়। তামিমকে টি-টোয়েন্টি দলে পেতে কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর অনাগ্রহের কথা সবার মোটামুটি জানা হয়ে গেছে। এটাই বেশি চাউর হয়েছে বলে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর কথা আর আলোচনাতেই আসেনি। কিন্তু ঘটনা হলো, বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি অধিনায়কও তাঁর দলে তামিম ইকবালকে অপরিহার্য মনে করেন না। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, তামিমকে বাদ দেওয়ার কথা তিনি একবারও বলেননি, তবে অন্য তিন ওপেনার লিটন-নাঈম-সৌম্যকেও দলে চেয়েছেন। এর দুইটা অর্থ হয়। পনের জনের দলে চারজন ওপেনার রাখতে না পেরে তামিম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাদ পড়ে যান। সৌম্য তিন নম্বরেও অনেকবারই ব্যাটিং করেছেন বলে তামিমকে নিয়েও দলে তিন ওপেনারই থাকছেন, এই তত্ত্বে যদি যান, মাহমুদউল্লাহর চাওয়ার অন্য অর্থটা তখন পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তামিম যদি দলে ফেরেনও, ওপেনিংয়ে অধিনায়কের প্রথম পছন্দ থাকবেন না।
শুধু ডমিঙ্গোর কথাই নয়, মাহমুদউল্লাহর এই অবস্থানও যেভাবেই হোক, তামিমের কানে চলে যায়। কোচ তাঁকে দলে চান না, অধিনায়ক গররাজি..তামিম ইকবালের মতো প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন কারও এরপর সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে খুব বেশি ভাবতে হয়েছে বলে মনে হয় না। এত বছর দলের এক নম্বর ওপেনার হয়ে থাকা কেউ এতে অপমান বোধ না করলে সেটাই তো হতো বিস্ময়।
লেখাটা শেষ করার আগে একটা বড় সমস্যার একটু আভাস শুধু দিয়ে রাখি। তামিম নিজেও কিন্তু একটা ফরম্যাটের অধিনায়ক। সাদা বলের দুই অধিনায়কের সম্পর্কের মধ্যে কালো একটা বিভাজন রেখা আঁকা হয়ে গেছে। যেটি আসলে অনেক দিন থেকেই বিদ্যমান, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল নির্বাচনকে উপলক্ষ করে যা আরও বড় হয়েছে, এই যা। বিশ্বকাপের পরই তো বেশ কিছুদিনের জন্য টি-টোয়েন্টির মহোৎসব শেষ, মানে মাহমুদউল্লাহ-রাজেরও। সাদা বলের অন্য ফরম্যাট, মানে ওয়ানডেতেও এটির রেশ থেকে যায় কি না, তা নিয়ে কৌতূহল তো হচ্ছেই। একটু উদ্বেগমাখা কৌতূহলই।