অভিনন্দন বাংলাদেশ এবং `লাভলি` থেকে `অসহ্য` ক্রিকেট
উৎপল শুভ্র
৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
চার-ছয়ের ফুলঝুরিতে ক্রিকেটের বেসবল হয়ে যাওয়াটা দেখতে যেমন ভালো লাগে না, উইকেটে ম্যাচের পর ম্যাচ ব্যাটসম্যানদের হাসফাঁস করা দেখতেও কি ভালো লাগে নাকি! নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে এসে যা মনে হয় সীমাটা ছাড়িয়েই গেছে। এক মাসের মধ্যে এমন নবম ম্যাচে বিরক্তিকর থেকে আরও বিরক্তিকর হয়ে ওঠা ক্রিকেট দেখতে দেখতে ফেসবুকে তাই একটা স্ট্যাটাসই দিয়ে ফেললাম।
কোনো কোনো লেখায় এমন হয়, লিখতেই লিখতেই হেডিংটা মাথায় চলে আসে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টি জয় নিয়ে লেখাটায় যা হয়েছিল। লিখতে লিখতেই মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করেছিল ‘ক্রিকেট, লাভলি ক্রিকেট’ শব্দবন্ধ। শেষ পর্যন্ত এটিকেই হেডিং করেছিলাম। ক্রিকেটকে এমন ‘লাভলি’ মনে হয়েছিল কি বাংলাদেশ জিতেছিল বলে?
হ্যাঁ, এটা তো অবশ্যই একটা কারণ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের প্রথম জয়, সেটিকে ‘লাভলি’ মনে হওয়াটা তো খুবই স্বাভাবিক। তবে শুধু বাংলাদেশের জয়ই নয়, ক্রিকেটকেও ‘লাভলি’ মনে হওয়ার আরেকটা বড় কারণ ছিল, টি-টোয়েন্টিতে দিনের পর দিন বলের ওপর ব্যাটের নির্দয় আস্ফালনের আনন্দদায়ী ব্যতিক্রম হতে দেখে। শুধু চার-ছয়ের বন্যা বয়ে গেলেই কি ক্রিকেট ম্যাচ মন রাঙায়, নাকি রাঙায় তাতে ব্যাট আর বলের সুষম লড়াই থাকলে? আমি সারা জীবনই দ্বিতীয়টিকে ভালো ক্রিকেট ম্যাচের পূর্বশর্ত বলে মেনে এসেছি।
মাত্র ১৩১ রান করেও বাংলাদেশ জিতে যাওয়াটাতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটা সেই পূর্বশর্ত পূরণ করেছে বলেই মনে হয়েছিল। তখন তো আর কল্পনাতেও ছিল না যে, মিরপুরে পরের আটটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ এই ১৩১-কেই পাহাড় প্রমাণ স্কোর বলে মনে করাবে। বলের ওপর ব্যাটের প্রাধান্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত দুই চোখ এর বিপরীত কিছু চাইছে ঠিকই, কিন্তু ক্রমাগত তা দেখতে দেখতে ক্রিকেট দেখাটাই হয়ে উঠবে চরম বিরক্তিকর।
অস্ট্রেলিয়া সিরিজটা তা-ও সহ্য করা গিয়েছিল। বাংলাদেশ একের পর এক ম্যাচ জিতছে, প্রথম তিন ম্যাচ জিতেই নিশ্চিত করে ফেলেছে সিরিজ জয়...এটা তো স্বপ্নের মতো একটা ব্যাপার। সিরিজ জয়ের ম্যাচেই কি আবারও তাই ‘লাভলি ক্রিকেট’ কথাটা ব্যবহার করেছিলাম! টানা লো স্কোরিং ম্যাচেও এক ধরনের আনন্দ খুঁজে পেয়ে হেডিং করেছিলাম, ‘তবুও বলব, ক্রিকেট লাভলি ক্রিকেট’।
কিন্তু সব কিছুরই তো একটা সীমা থাকে। চার-ছয়ের ফুলঝুরিতে ক্রিকেটের বেসবল হয়ে যাওয়াটা দেখতে যেমন ভালো লাগে না, উইকেটে ম্যাচের পর ম্যাচ ব্যাটসম্যানদের হাসফাঁস করা দেখতেও কি ভালো লাগে নাকি! নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে এসে যা মনে হয় সীমাটা ছাড়িয়েই গেছে। এক মাসের মধ্যে এমন নবম ম্যাচে বিরক্তিকর থেকে আরও বিরক্তিকর হয়ে ওঠা ক্রিকেট দেখতে দেখতে ফেসবুকে তাই একটা স্ট্যাটাসই দিয়ে ফেললাম, ‘ক্রিকেট খেলা দেখাটা এমন যন্ত্রণাদায়ক হবে, কখনো তা কল্পনাও করিনি’। আইরনিই বলতে হবে, এমন এক ম্যাচ দেখতে দেখতে এটি মনে হলো, যে ম্যাচে বাংলাদেশকে হাতছানি দিচ্ছে ইতিহাস। যে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এর আগে ১০টি টি-টোয়েন্টি খেলে ১০টিতেই পরাজয়, যে নিউজিল্যান্ড টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশকে অনেকবারই লজ্জায় ডুবিয়েছে, সেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চার ম্যাচের তিনটিতেই জিতে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয় তো মহা আনন্দের এক উপলক্ষ। অতি ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে পড়ার পরও ‘ঐতিহাসিক’ কথাটা ব্যবহার করার লোভও সামলানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ দলকে অভিনন্দন জানানোটাও তাই অবশ্য কর্তব্যের পড়ে। অভিনন্দন বাংলাদেশ! অভিনন্দন মাহমুদউল্লাহ!
মাহমুদউল্লাহকে আলাদাভাবে অভিনন্দন জানানোর একটা কারণ তো অবশ্যই তিনি অধিনায়ক বলে। তবে অভিনন্দনটা শুধু পদাধিকার বলেই পাচ্ছেন না, যোগ্য অধিনায়কের মতোই যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সামনে থেকে। হতশ্রী বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে কিছুটা নির্ভরতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে একমাত্র তাঁর মধ্যেই। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের ম্যাচটাতেও তো বাংলাদেশকে ফিনিশিং লাইন পার করালেন তিনিই।
যা দেখতে দেখতে অবশ্য আরেকটা ব্যাপারেও একটু বিস্ময় জাগল। ব্যাটিং দুরূহ উইকেট, স্পিন-স্বর্গ উইকেট...সবই ঠিক আছে; কিন্তু এই উইকেটের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ব্যাটিংটাই তো দেখতে পাচ্ছি না। ৯৩ রান তাড়া করতে বাংলাদেশকে শেষ ওভার পর্যন্ত ব্যাটিং করতে দেখে মনে হলো, উইকেট ব্যাটসম্যানদের মনোজগতে এমনই ছায়া ফেলেছে যে, টার্গেট কত, এটা আর কোনো ব্যাপার নয়। ১৩০ রান তাড়া করতে নামলে যা হতো, ৯৩ রান তাড়া করতেও তা-ই হচ্ছে, টার্গেট ৬০ রান হলেও বোধ হয় সেটিকে একই রকম কঠিন বানিয়ে ছাড়তেন ব্যাটসম্যানরা।
পুরস্কার বিতরণীতে মাহমুদউল্লাহর কথা শুনে অদ্ভুত এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়ে গেল। সম্ভবত বাংলাদেশের ব্যাটিং প্ল্যান নিয়ে কথা বলতে গিয়েই যখন বললেন, তিনি চেয়েছেন ৩০-৩৫ রানের হলেও যেন পার্টনারশিপ হয়, যেটির উদ্দেশ্য ‘টেকিং দ্য গেম ডিপ’। ৯৪ রানের টার্গেট নিয়ে ব্যাটিং করতে নামা কোনো দল খেলাটাকে ‘ডিপ’-এ অর্থাৎ শেষ ঝটকাটা দেওয়ার জন্য শেষ অঙ্ক পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরিকল্পনা নিয়ে নামছে, এমন কথা জীবনে এই প্রথম শুনলাম। পরে ভেবে দেখলাম, যে উইকেটে খেলা হচ্ছে, তাতে এমন অভূতপূর্ব অনেক কিছুই শোনার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখাই মনে হয় ভালো।
অস্ট্রেলিয়া সিরিজের আগে জোর গলায় জয়ের কথা বলা যায়নি। তবে নিউজিল্যান্ড সিরিজে বাংলাদেশ ছিল পরিষ্কার ফেবারিট। নিউজিল্যান্ডের এই দলটা তাদের মূল টি-টোয়েন্টি দলের ছায়াও নয়। বিশ্বকাপ দলের সঙ্গে এই দলের কারোর কোনো সংশ্রব না থাকাটাই এর বড় প্রমাণ। এর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জয় যোগ হয়ে এই সিরিজ শুরুর আগে চাপ বলতে যা বোঝায়, তার সবই ছিল বাংলাদেশের ওপর। জিতলে সবাই বলবে, নিউজিল্যান্ডের এই দলের বিপক্ষে তো জেতারই কথা, এ আর এমন কি! কিন্তু হারলে উঠে যাবে ‘গেল গেল’ রব। ঠিক যেন ফুটবলে পেনাল্টি মারার মতো অবস্থা। গোল করলে কেউ মনেও রাখে না, মিস করলেই সর্বনাশ! এই বিবেচনায় বাংলাদেশের সিরিজ জয় মাহমুদউল্লাহর জন্য বড় একটা স্বস্তি হয়েই এসেছে। তৃতীয় ম্যাচে হেরে বসার পর বিসিবির অন্দরমহলের শোরগোল কিছুটা তো তাঁর কানে না পৌঁছে পারেই না।
ক্রিকেট খেলা দেখাটা যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠার অভূতপূর্ব যে অভিজ্ঞতার কথা বলছিলাম, সেটির মূল আসামী অবশ্যই উইকেট। অনেকে এজন্য বিসিবিকে গালমন্দ করছে। যারা আরও সুনির্দিষ্ট হতে চান, তারা তির ছুঁড়ছেন কিউরেটর গামিনি ডি সিলভার দিকে। বাইরের পৃথিবীরও এমন মনে করা খুবই স্বাভাবিক যে, যেকোনো মূল্যে জয় পেতেই এমন চষাক্ষেতের রূপ দেওয়া হয়েছে মিরপুরের উইকেটকে। কিন্তু আসল ঘটনা বোধ হয় তা নয়। টানা খেলা, রোদে পোড়ার বদলে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে কাভারের নিচে ঢাকা পড়ে থাকা মিলিয়ে মিরপুরের এই উইকেটকে অন্য কিছু বানানো গামিনি কেন, পৃথিবীর কারও পক্ষেই হয়তো সম্ভব হতো না। এ বছরের হিসাব করলেই দেখা যাবে, ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক মিলিয়ে মিরপুরে প্রায় ৭০টির মতো ম্যাচ হয়েছে। উইকেটগুলো দেখলেই মনে হয়, একটু বিশ্রাম চেয়ে রীতিমতো আর্তনাদ করছে।
সেটিতে কান দেওয়া না-দেওয়ায় হয়তো কিছু আসে যায় না। উইকেট তো নীরব প্রতিবাদ জানানোর বাইরে কিছু করতে পারে না। তবে 'লাভলি ক্রিকেট'কে 'অসহ্য ক্রিকেট' বানিয়ে দিতে তো অবশ্যই পারে।