সবচেয়ে কম বয়সে টেস্ট সেঞ্চুরি
অভিষেকেই ইতিহাস গড়ে ফেললেন আশরাফুল
উৎপল শুভ্র
৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
পঞ্চম টেস্টেই বিশ্ব ক্রিকেটকে বড় একটা নাড়া দিয়েছিল বাংলাদেশ মোহাম্মদ আশরাফুলের কল্যাণে। টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরি, সেটিও আবার অভিষেকেই। ২০০১ সালের এই দিনে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে সেই সেঞ্চুরি ফিরে ফিরে দেখার মতো।
প্রথম প্রকাশ: ৯ সেপ্টেম্বর ২০০১। প্রথম আলো।
গত পরশু রাতে ১১টায়ই বিছানায় চলে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। রুমমেট মোহাম্মদ শরীফ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। কিন্তু আশরাফুল শুধু এপাশ ওপাশ করছেন, তাঁর ঘুম আসছে না কিছুতেই। দু-একবার তন্দ্রামতো এলো। আশরাফুল দেখলেন, তিনি সেঞ্চুরি করেছেন, দেখতে দেখতে ডাবল সেঞ্চরিও। হঠাৎ করেই দেখলেন ভিডিওতে দেখা ব্রায়ান লারার ৩৭৫ রানের রেকর্ড ভাঙা সেই ইনিংস। তার ডাবল সেঞ্চুরি হয়ে গেছে, 'বুলবুল ভাই' করেছেন ১৭৩–শ্রীলঙ্কাকে আবার ব্যাট করতে নামতে হচ্ছে দ্বিতীয় ইনিংসে।
তন্দ্রাটা কেটে যাওয়ার পর স্বপ্ন দেখছিলেন, এটা বুঝতেও কিছুটা সময় লাগল মোহাম্মদ আশরাফুলের। সকালে মাঠে আসার সময় বাসে অধিনায়ক নাঈমুর রহমানকে বললেন, 'দুর্জয় ভাই, আমি স্বপ্ন দেখেছি ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলেছি।' এমন স্বপ্নে যেকোনো অধিনায়কেরই খুশি হওয়ার কথা। নাঈমুর হাসিমুখে বললেন, 'তা তো তুই করতেই পারিস।' মোহাম্মদ আশরাফুলের স্বপ্ন পুরোটা সত্যি হয়নি। ডাবল সেঞ্চুরি করতে পারেননি আগের দিন ৪ রানে অপরাজিত থাকা এই ব্যাটসম্যান। তবে সেঞ্চুরি করেছেন, তাতেই হয়ে গেছে নতুন এক ইতিহাস।
টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি বড় এক কীর্তি। তবে সেই কীর্তিমানদের সংখ্যা কম নয়। আশরাফুলের আগেই ৬৯ জন ছিলেন এই তালিকায়। তবে একটা জায়গায় মোহাম্মদ আশরাফুল একেবারেই অনন্য। ১২৪ বছরের টেস্ট ইতিহাসে মোহাম্মদ আশরাফুলের চেয়ে কম বয়সে কেউ সেঞ্চুরি করেনি। অফিসিয়াল হিসাব অনুযায়ী মোহাম্মদ আশরাফুলের ১৭তম জন্মদিন আজ (ম্যাচ শেষে অবশ্য জানালেন, তা পালন করা হয়ে গেছে গত ৭ জুলাই। সেই হিসাব ধরলেও মোহাম্মদ আশরাফুলেরই থাকছে কম বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ডটি)। সে হিসাবে সেঞ্চুরিটি তিনি করেছেন ১৬ বছর ৩৬৪ দিন বয়সে। আজ থেকে ৪০ বছর আগে ভারতের বিপক্ষে দিল্লি টেস্টে ১৭ বছর ৮২ দিন বয়সে সেঞ্চুরি করেছিলেন পাকিস্তানের মুশতাক মোহাম্মদ। ১৯৯০ সালে শচীন টেন্ডুলকার সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন এই রেকর্ড ভাঙার। এছাড়া এই ৪০ বছরে মুশতাকের রেকর্ডে হাওয়ার ঝাপটাও লাগেনি। আর গতকাল কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে সেই রেকর্ডকে অতীত করে দিলেন বাংলাদেশের মোহাম্মদ আশরাফুল।
এমন এক সময়ে, যখন বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাসের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন কেউ কেউ, যখন বাংলাদেশের ব্যাটিং হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রেসবক্সে বিদেশি সাংবাদিকদের রসিকতার বিষয়। সেই মুখগুলোতেই কাল বিস্ময় আর সমীহ ফুটিয়ে তুলল আশরাফুলের দুর্দান্ত স্ট্রোক প্লে, বয়স ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে বেমানান পরিণতিবোধ এবং মুরালিধরন-ভাসের মতো বোলারদের স্বচ্ছন্দে উড়িয়ে দেওয়ার সাহস। নিরাশার অন্ধকারে এক ঝলক আলো হয়ে এলেন মোহাম্মদ আশরাফুল।
মাত্র এক সপ্তাহ আগে মুলতানের হলিডে ইন হোটেলের লবিতে তাঁর বয়সী সব অটোগ্রাফ শিকারিদের ভিড়ে মিশে গিয়ে যে কিশোর ছুটে বেড়াচ্ছিলেন পাকিস্তানের এক ক্রিকেটার থেকে আরেক ক্রিকেটারের কাছে, কলম্বো টেস্টে সেই ছেলেটিই জহির আব্বাসের মুখ দিয়ে বের করাল বিস্ময়সূচক এক ধ্বনি 'ফ্যান্টাস্টিক! মনেই হয়নি ও প্রথম টেস্ট খেলছে।' ট্রেভর চ্যাপেল এক কথায় বলে দিলেন, 'আমি ওর ব্যাটিং বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।'
ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কার নিতে মুত্তিয়া মুরালিধরনের সঙ্গে মঞ্চে ওঠার মিনিট পাঁচেক পর মোহাম্মদ আশরাফুল জানাচ্ছেন, 'মাঠে নামার আগে একটু টেনশন হচ্ছিল। কিন্তু এরপর আর মনেই হয়নি যে, বড় কিছু করছি।' তার চেয়েও বিস্ময় উপহার দিলেন এরপর, 'অনেক ব্যাটসম্যানের সেট হতে সময় লাগে। কিছু বল খেলতে হয়। কিন্তু আমার প্রথম বল থেকেই নিজেকে সেট বলে মনে হয়।'
১৪তম বাউন্ডারিটি মেরে সেঞ্চুরিতে পৌঁছানোর মুহূর্তে আশরাফুলের মনে পড়েছে বাবা-মা-ভাই-বোনের কথা, একই সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠেছে 'ওয়াহিদ স্যারের' মুখ। ওয়াহিদ স্যার মানে মোহাম্মদ আশরাফুলের এখানে আসার নেপথ্য কারিগর, তাঁর প্রথম গুরু, বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক লেগ স্পিনার ওয়াহিদুল গনি। যে মুরালিধরনকে নিয়ে তাঁর তুলনায় অনেক অভিজ্ঞ বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল, তাঁকেও কী স্বচ্ছন্দেই না খেলেছেন আশরাফুল! গতকাল ৬৬তম টেস্টে ৩৫০ উইকেট নিয়ে ফেলা এই অফ স্পিনারকে মেরেছেন তাঁর ১৬ বাউন্ডারির তিনটি, এর মধ্যে দুটি কাল লাঞ্চের পর। প্রথমটি লাঞ্চের পর প্রথম বলেই। এই রহস্য ব্যাখ্যা করতেই এলেন 'ওয়াহিদ স্যার', 'ওয়াহিদ স্যারের কাছে সব ধরনের বোলার আছে। মুরালির যে দুসরা (অফ স্পিনারের অ্যাকশনে লেগ স্পিন) নিয়ে এত কথা, সাগর নামে একটি ছেলে সেটিও করতে পারে। ওখানে প্র্যাকটিস করার কারণে ভাস-মুরালিকে খেলতে আমার কোনো সমস্যা হয়নি।'
ভাস-মুরালিরাও একটু ভড়কে গেছেন। বাংলাদেশের 'পিচ্চি' এক ব্যাটসম্যান এভাবে তাঁদের মেলে বসা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে দেখে বিস্ময় এক সময় পরিণত হয়েছে রাগে। রুচিরা পেরেরা নিস্ফল বাউন্সার দিলেন, আশরাফুলের কোনো সমস্যাই হলো না।স্টাম্পে বল করলেন, আশরাফুল আরামে ডিফেন্সিভ খেললেন। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে বাড়তি পেসের চেষ্টা করতে গিয়ে একবার বোলিংয়ের সময় পড়েই গেলেন মাটিতে। ভাসের বাউন্সার একবার আঘাত হেনেছে তাঁর হেলমেটে, কিন্তু আশরাফুল টলেননি। বরং ভাসের বলেই পুল করে এমন দুটি বাউন্ডারি মেরেছেন যে, ম্যাচ শেষে নিজের সেরা শট বলতে গিয়ে বেছে নিলেন সে দুটিকেই। শেষ পর্যন্ত যখন আউট হলেন, সেটিকেও বোলারের কাছে পরাজয়ের চেয়ে এই গরমে ৪ ঘণ্টা ৮ মিনিট ব্যাটিং করার ক্লান্তি বলেই মনে হয়েছে।
অভিষেকেই সেঞ্চুরি, সেটিও টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে...এরপর ক্রিকেট নিয়ে যে স্বপ্নের কথা জানালেন আশরাফুল, সেটিতেই প্রতিফলিত তাঁর কিশোর বয়স। 'আগামী সাত-আট বছর' বলেই সংশোধন করলেন, 'আগামী দশ/বারো বছর যেন বাংলাদেশ দলে নিয়মিত হতে পারি, সেটাই আমার লক্ষ্য।'
৮ সেপ্টেম্বর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে যে মহাকাব্য রচিত হয়েছে তাঁর ব্যাটে, তাতে মোহাম্মদ আশরাফুলের স্বপ্নটা 'খুব সাধারণ' মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।