বাংলাদেশ-পাকিস্তান পেশোয়ার টেস্ট ২০০৩
শোয়েব আখতার কি সেদিন বল টেম্পারিং করেছিলেন?
শুভ্র.আলাপ
৩১ আগস্ট ২০২১
২ উইকেটে ৩১০ থেকে চোখের পলকে ৮ উইকেটে ৩২০...২০০৩ সালের পেশোয়ার টেস্টে বাংলাদেশকে এমন বিপর্যয়ে ফেলে দিয়েছিলেন শোয়েব আখতার। দ্বিতীয় দিন লাঞ্চের পর হঠাৎ করেই তাঁর জ্বলে ওঠা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন আছে ভালোই। তাঁর অমন বোলিংয়ের পেছনে কি কেবল হাতের জাদুই ছিল, নাকি অন্য কোনো কূটকৌশল লুকিয়ে?
পেশোয়ারের ওই টেস্টটা বাংলাদেশকে দিয়ে যায় মিশ্র এক অনুভূতি। লিড নেওয়া কিংবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হ্যাটট্রিকের স্বাদ পাওয়ার অনুভূতিগুলো তো প্রথমবার পাওয়া গিয়েছিল ওই টেস্টেই। কিন্তু এত প্রথমেও লাভ তো হয়নি কোনো। টেস্ট শেষ চার দিনেই। আরও বহুবারের মতো 'ইশ, অল্পের জন্য' আক্ষেপে পুড়ে বাংলাদেশ হেরেছিল ৯ উইকেটে।
হঠাৎ করেই বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ওই পেশোয়ার টেস্ট নিয়ে আলাপের কারণ, গতকাল ছিল সেই টেস্টের সমাপ্তির ১৮তম বার্ষিকী। সে উপলক্ষেই উৎপলশুভ্রডটকম-এর ইউটিউব শো শুভ্র.আলাপে যোগ দিয়েছিলেন ওই টেস্টের দুই সাক্ষী হাবিবুল বাশার আর জাভেদ ওমর।
আজ ১৮ বছর পর স্কোরবোর্ডে তাকিয়ে মনে হতে পারে, বাংলাদেশ হেরেছিল দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিং ব্যর্থতায়। কিন্তু ওই টেস্টে চোখ রাখা দর্শকেরা বোধ হয় আফসোসের আফসোসের পোড়েন বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস নিয়েই। হান্নান সরকারকে প্রথম দিনের প্রথম ছয় ওভারের মাঝে হারালেও পুরো দিনে বাংলাদেশ এরপর হারিয়েছিল কেবল হাবিবুল বাশারের উইকেটই। দিন শেষ করেছিল ২ উইকেটে ২৪০ রান নিয়ে। পরের দিনের প্রথম সেশনটাও কেটেছিল নির্বিঘ্নে। আর কোনো উইকেট না হারিয়েই বাংলাদেশ তুলে ফেলেছিল ৩১০। ড্রেসিংরুমে তখন ছড়িয়ে পড়েছে ইনিংস ঘোষণা করার একটা আশা, আগের ২৩ টেস্টে যা চিন্তায় আনারও সাধ্য হয়নি।
কিন্তু সে আশার বেলুন ফুটো হয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয় সেশনেই। লাঞ্চের পরই যেন ফেরত এসেছিল সেই পুরোনো বাংলাদেশ। ৫১ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে ৩৬১ রানেই অলআউট বাংলাদেশ। পুরো চিত্রটা বোঝা যায় না এতেও, বাংলাদেশ তো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল শোয়েব আখতারের ১৬ বলের এক স্পেলে।
শোয়েব আখতারের ওই স্পেলটা বিস্ময় জাগিয়ে যায় এখনো। লাঞ্চের আগে তিন-তিন ছয় ওভারের দুটি স্পেল করেছিলেন। উইকেট তো পানইনি, উইকেট পেতে পারেন বলে মনেও হয়নি কখনো। খেলার মতো তিনি যথেষ্ট ফিট কি না, মাঠময় তখন ছড়িয়ে পড়েছে সেই আলোচনাই। উৎপল শুভ্র জানান, সেই সিরিজে পাকিস্তানের অধিনায়ক রশিদ লতিফের সঙ্গে এক সময় বেশ ভালোই খাতির ছিল তাঁর। করাচিতে প্রথম টেস্টের পর রশিদ লতিফই তাঁকে বলেছিলেন, 'আমরা আনফিট একজন প্লেয়ারকে (শোয়েব আখতার) খেলাচ্ছি!'
দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিন লাঞ্চ পর্যন্ত যে মন্তব্যের সঙ্গে একমত হওয়ার মতোই বোলিং করেছিলেন শোয়েব আখতার। লাঞ্চের প্রথম ওভারটাতেও। দ্বিতীয় ওভার থেকে সেই শোয়েব আখতারই হয়ে উঠলেন 'আনপ্লেয়েবল'। রিভার্স সুইংয়ের কাড়িকুড়িতে শোয়েব বল বল কোনদিকে কোনটা নিলেন, ব্যাটসম্যানরা যেন বুঝতে পারলেন না কিছুই। ১৬ বলের স্পেলে ৫ রানে নিয়ে নিলেন ৫ উইকেট। বাংলাদেশ হঠাৎই ৩২০-৮!
এমন ধ্বংসযজ্ঞের শুরুটা হয়েছিল যাঁর আউটে, সেই জাভেদকেই ধরা হলো শুরুতে। পুরো স্পেলটাকে 'ম্যাসাকার' বলে জাভেদ ভাগ করে নিতে চাইলেন তাঁর আউটের পরে ড্রেসিংরুমের অবস্থাটা। জাভেদ আউট হয়ে ফিরেছেন একটু আগেই। ড্রেসিংরুমের ভেতরে তাঁর 'কুল ডাউন' তখনো শেষ হয়নি, স্ট্রেচিং করছেন। ড্রেসিংরুমের ভেতরে তখন টেলিভিশনও ছিল না, জাভেদ তাই জানতে পারেননি মাঠে কী হচ্ছে। হঠাৎই এক সতীর্থ এসে তাঁকে জানালেন, 'জাভেদ ভাই, উঠেন। নামতে হবে।'
'নামতে হবে মানে?'
'আমরা অলআউট হয়ে গেছি।'
ওই টেস্ট নিয়ে অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাইলেন উৎপল শুভ্রও। খোলা প্রেসবক্সে বসে খেলা দেখতে দেখতে তাঁর নিজের ভেতরেও কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। মিডিয়া প্রান্তের বিপরীত দিক থেকে শোয়েব বল করছিলেন বলে উৎপল শুভ্রও ছিলেন মুখোমুখি। দেখেই তাঁর মনে হচ্ছিল, ওই বলগুলো খেলা যায় না।
কিন্তু হঠাৎ করেই যে এমন 'খেলা যায় না' রিভার্স সুইংয়ে নাকাল হলো বাংলাদেশ, সেই রিভার্স সুইংয়ের রহস্যটা কি ধরতে পারা গিয়েছিল? ওটা কি পাকিস্তানিদের হাতের জাদু, নাকি এর ভেতরে কিছু কালো-জাদুও লুকিয়ে ছিল? উৎপল শুভ্র মনে করিয়ে দিলেন, রাসেল টিফিনকে বাংলাদেশ দল বল পরীক্ষাও করতে বলেছিল একবার। কেন তাদের মনে হয়েছিল, বলটা পরীক্ষা করা দরকার?
জাভেদ যেতে চাইলেন না ওই আলোচনায়। তবে হাবিবুল বাশার একদম সরাসরিই বলে দিলেন, 'আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, সামথিং (ওয়াজ) রং উইথ দ্য বল।'
পাকিস্তানিরা রিভার্স সুইংয়ের শিল্পটা খুব ভালো করেই রপ্ত করেছেন, সেটা স্বীকার করলেন হাবিবুল বাশারও। আর তখন ওই সময়টায় রিভার্স সুইং পাওয়ারই কথা ছিল তাদের। কিন্তু রিভার্স সুইং পাওয়ার পরিমাণটাই আসলে সন্দেহ জাগিয়েছিল তাঁর মনে। 'সারাদিন ধরে কিছু হচ্ছে না, উইকেট পুরোপুরি ফ্ল্যাট লাগছে, সেখান থেকে হঠাৎ করেই এত বড় বড় রিভার্স সুইং পাওয়া একটু সন্দেহজনকই তো!'
পেশোয়ার টেস্ট নিয়ে আড্ডা হওয়ার কথা থাকলেও আলাপটা আসলে শাখা-প্রশাখা মেলেছিল সব দিকেই। শোয়েব আখতারকে নিয়ে আলাপটাই যেমন ছড়িয়ে গিয়েছিল হাবিবুল-জাভেদের খেলা ভয়ঙ্করতম বোলারের আলোচনায়। তাঁরা দুজন কাদের নাম বলেছিলেন, তা চাইলে দেখে নিতে পারেন আপনিও।