অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়-৪
ঐতিহাসিক জয়ে উজ্জ্বল তাঁরা দুজন
উৎপল শুভ্র
৩০ আগস্ট ২০২১
ব্যাটিংয়ের জন্যে দুরূহতম এক উইকেটে দুই ইনিংসেই ফিফটি। তবুও ম্যাচসেরা হতে পারেননি তামিম ইকবাল। কারণ, বাংলাদেশ দলে যে একজন সুপারম্যান আছে। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি যিনি বল হাতেও নিয়মিতই জ্বলে ওঠেন। সাকিব আল হাসান নামের সেই সুপারম্যান শেষ দিনে বলতে গেলে একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে।
বাংলাদেশ: ২৬০ ও ২২১। অস্ট্রেলিয়া: ২১৭ ও ২৪৪। ফল: বাংলাদেশ ২০ রানে জয়ী।
জয়ের আনন্দে ভেসে যেতে যেতে তামিম ইকবালের কি একটু আফসোস হচ্ছে? আহা, বোলিংটাও যদি পারতাম! তাহলে কী হতো? সাকিব আল হাসানের ছায়ায় এমন ঢাকা পড়ে যেতে হতো না।
ব্যাটসম্যানশিপের কঠিনতম পরীক্ষার এক মঞ্চ সাজিয়ে বসেছিল মিরপুরের এই উইকেট। যে উইকেটে কিপিং করতে গিয়ে মুশফিকুর রহিমের মনে হয়েছে, ‘যেন সাপ কিলবিল করছে।’ দারুণ হয়েছে উপমাটা। উইকেটে পড়ে সত্যি সাপের মতোই এদিক-ওদিক গেছে বল, ফোঁস করে ফণাও তুলেছে। দুই ইনিংসেই তামিম ইকবালের ব্যাট যেন সাপুড়ের বিন। শেষে ছোবল খেতে হয়েছে তাঁকেও। তবে এর আগে ৭১ ও ৭৮ রানের যে ইনিংস দুটি খেলেছেন, তার মহিমা অনেক সেঞ্চুরিকেও হার মানায়।
ত্রিশ বছর আগে বেঙ্গালুরুর এমনই এক উইকেটে জীবনের শেষ টেস্ট ম্যাচে পাকিস্তান আর জয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন সুনীল গাভাস্কার। তাঁর ৯৬ রানের ইনিংসটিতে মুগ্ধ ইমরান খান বলেছিলেন, ‘টার্নিং উইকেটে কীভাবে স্পিন খেলতে হয়, তা শিখতে সানির এই ইনিংসের ভিডিও দেখলেই চলবে।’
দ্বিতীয় টেস্টের আগে ড্যারেন লেম্যানও অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের তামিমের ব্যাটিংয়ের ভিডিও দেখিয়ে একই কথা বললে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দুই ইনিংস মিলিয়ে ধরলে এটিকেই বলতে হবে ব্যাটসম্যান তামিমের সেরা টেস্ট। তারপরও তিনি পার্শ্বনায়ক। কারণ, বাংলাদেশ দলে যে একজন ‘সুপারম্যান’ আছেন!
তাঁর নামটা বোধ হয় না বললেও চলছে। রান সাকিবও করেছেন। সেটি সাকিবীয় ঢঙেই। এই উইকেটে প্রথম ইনিংসে যে ব্যাটিংটা করেছেন, নিজের ওপর অগাধ আত্মবিশ্বাস থাকলেই শুধু তা করা যায়। সব সময় তাতে কাজ হবে না, জানা কথাই। দ্বিতীয় ইনিংসে যেমন রান পাননি। কিন্তু তাতে কী! সাকিব তো শুধু ব্যাটসম্যান নন। সাকিব ক্রিকেটের সেই বিরল প্রজাতির প্রতিনিধি, যিনি বলতে পারেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য।’
‘বাঁশরী’টাকে এখানে ‘বল’ পড়ুন, আর ‘রণতূর্য’কে ব্যাট। ক্রিকেট ইতিহাস অলরাউন্ডার খুব কম দেখেনি। তবে ‘ব্যাটিং ভালো না বোলিং ভালো’ এই সংশয়ে ফেলতে পেরেছেন খুব কমজনই। সাকিব যা নিয়মিতই ফেলছেন। ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়ে সব ক্ষেত্র মিলিয়েই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা হয়ে গেছেন অনেক দিনই। খেলা আছে, বিজ্ঞাপনজগতে ব্যস্ততা আছে, নিত্যনতুন ব্যবসায়ী বুদ্ধিও খেলা করে তাঁর মাথায়। এত সব কীভাবে সামলান? উত্তরটা তো দিয়ে দেওয়া যায় ওই এক শব্দেই—‘সুপারম্যান’!
এখনো বাংলাদেশ সাকিবের মূল্য বোঝে না, এমন নয়। তবে সেটি আরও বোঝা যাবে সাকিব খেলা ছাড়ার পর। এমন আর একজনকে পেতে বাংলাদেশকে কত দিন অপেক্ষা করতে হবে, কে জানে! মোটামুটি সাড়ে তিন দিনে শেষ হয়ে যাওয়া এই টেস্ট ম্যাচ আবারও নতুন করে বুঝিয়ে দিল সাকিব-মহিমা।
বাংলাদেশের এই দলের একটা মজার ব্যাপার আছে। কোনো উপলক্ষ পেলেই জ্বলে ওঠে। শ্রীলঙ্কায় শততম টেস্ট নিয়ে মহা হইচই। বাংলাদেশ ঠিকই জিতে গেল। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে কার্ডিফে খেলা, তাহলে তো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ের সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে হয়। অবিশ্বাস্য এক প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে ঠিকই তা ফিরিয়ে আনল বাংলাদেশ। এখানেই দেখুন না! সাকিব আর তামিমের ৫০তম টেস্ট নিয়ে কী আলোড়ন! টেস্ট ইতিহাসেই আর কোনো খেলোয়াড়ের ৫০তম টেস্ট নিয়ে এমন হয়নি। ৫০তম টেস্ট কখন আসে-যায়, কেই-বা মনে রাখে! আর এখানে সেটিকে চিরদিন মনে রাখার বন্দোবস্তটাও নাকি করলেন তাঁরা দুজনই!
ক্রিকেট তো আর এক-দুজনের খেলা নয়। অবদান আরও অনেকেরই আছে। বল হাতে তাইজুল-মিরাজ। দ্বিতীয় ইনিংসে মুশফিকের ওই ৪১ তো পরিস্থিতি বিচারে অমূল্য। জয়-পরাজয়ের ব্যবধান মনে রাখলে প্রথম ইনিংসে মিরাজের ১৮ আর শফিউলের ১৩ রানও তো দেখা যাচ্ছে নির্ধারক। খুঁজলে এমন টুকটাক অবদান আরও অনেক পাওয়া যাবে। এখন তো দেখা যাচ্ছে, শুধু মাঠের ১১ জনেরই নয়, এই জয়ে উম্মে আহমেদ শিশিরেরও অবদান আছে! পরশু রাতে সাকিবের যখন মনে হচ্ছিল, টেস্টটা আর জেতা হলো না; শিশির বলেছেন, ‘তুমিই পারবে জেতাতে!’
‘সুপারম্যান’-এর স্ত্রী বলে কথা!