অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়-২
বল হাতেও সেই সাকিব
উৎপল শুভ্র
৩০ আগস্ট ২০২১
দ্বিতীয় দিন শেষে হাতে ৯ উইকেট নিয়ে ৮৮ রানের লিড। ম্যাচের লাগাম বাংলাদশের হাতেই, যাতে ১৬তম বারের মতো ইনিংসে ৫ উইকেট পাওয়া সাকিবের অবদানই সবচেয়ে বেশি। ভুলে যাওয়া যাবে না মেহেদী মিরাজকেও, স্টিভ স্মিথ নামের কাঁটা সরিয়েছেন তো তিনিই।
প্রথম প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০১৭। প্রথম আলো।
দ্বিতীয় দিন শেষে
বাংলাদেশ: ২৬০ ও ৪৫/১। অস্ট্রেলিয়া ১ম ইনিংস: ২১৭
মেহেদী হাসান মিরাজ খুব একটা পার্থক্য দেখছেন না। মিরপুরে এর আগের টেস্টটিতে উইকেট যেমন ছিল, এবারও নাকি প্রায় সে রকমই। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দশ মাস আগের সেই টেস্টটি কি তাহলে একটু মনে করিয়ে দিতে হয়। নাকি সেটির দরকার নেই!
বাংলাদেশের ক্রিকেট-রূপকথার অংশ হয়ে যাওয়া সেই টেস্টের স্মৃতিতে কি আর এত তাড়াতাড়ি ধুলো জমার কথা! ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম জয়, সেটিও তিন দিনে এবং এক সেশনে ১০ উইকেট তুলে নিয়ে! এখানে মনে হয় না মিল থাকবে। আবারও অমন ভোজবাজির মতো কিছু ঘটে গেলে ভিন্ন কথা, নইলে এই টেস্ট তিন দিনে শেষ হচ্ছে না। তবে পঞ্চম দিন বলেও কিছু এখানে থাকার কথা নয়। বৃষ্টি বাগড়া না দিলে এই টেস্টের আয়ু চার দিনের বেশি নয়।
এখন পর্যন্ত বৃষ্টি খুবই সদয়। দুই দিনই তা এসেছে। তবে খুবই ভদ্রস্থ বেশে। প্রথম দিন তা ৩৬ মিনিট খেলা বন্ধ রাখলেও এরপরই এমন ঝলমলে রোদ যে, পুরো খেলাই হয়েছে। কালকের একপশলা বৃষ্টি তো যেন ঠিক ঘড়ি ধরে। চা-বিরতি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে বিরতির মধ্যেই শেষ। প্রকৃতিও মনে হয় টেস্ট ম্যাচটা খুব পছন্দ করছে!
করারই কথা। এখন পর্যন্ত যতটুকু খেলা হয়েছে, তাতে রোমাঞ্চকর এক সমাপ্তির সব মসলাই এটিতে মজুত। রোমাঞ্চটা বেশি খেলা করছে বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমেই। হাতে দ্বিতীয় ইনিংসের ৯ উইকেট নিয়ে ৮৮ রানের লিড। আজ তৃতীয় দিনের খেলা শুরু হওয়ার আগে ম্যাচের লাগামটা সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশের হাতেই।
প্রথম দুই দিনের খেলা দেখে থাকলে অবশ্য আপনার মনে হতেই পারে, সেটি আসলে সাকিব আল হাসানের হাতে!
আগের দিন ব্যাট হাতে দলের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। কাল বোলার সাকিবও দেখা দিলেন স্বমহিমায়। ১৬তম বারের মতো ইনিংসে ৫ উইকেট নিলেন। যেটি বাড়তি উদযাপন দাবি করে। শুধু অস্ট্রেলিয়া ছাড়া বাকি সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষেই ইনিংসে ৫ উইকেট ছিল। অস্ট্রেলিয়াকে সামনে পেয়ে প্রথম সুযোগেই গড়ে ফেললেন দারুণ এক কীর্তি। সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে ইনিংসে ৫ উইকেটের যে কীর্তি আছে আর মাত্র তিনজনের।
আরেকটি রেকর্ডের দিকেও এগিয়ে গেলেন আরেক পা। অষ্টমবারের মতো সাকিবের একই টেস্টে ফিফটি ও ইনিংসে ৫ উইকেট। এর চেয়ে বেশিবার যা করতে পেরেছেন শুধু একজনই। তবে সাকিবের চেয়ে তা তিনবার বেশি করতে ইয়ান বোথামকে খেলতে হয়েছে ১০২টি টেস্ট। নিজের ৫০তম টেস্টটা স্মরণীয় করে রাখার দায়িত্বটা মনে হচ্ছে সাকিব নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছেন।
দিনের নায়ক অবশ্যই সাকিব। তবে কাল উদযাপনের সবচেয়ে বড় উপলক্ষটা কিন্তু মিরাজের উপহার। এই সিরিজে বাংলাদেশের বোলারদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকির কথা বললে এক-দুই-তিন নম্বরে ‘স্টিভ স্মিথ’ লিখে তারপর খুঁজতে হবে অন্য কোনো নাম। র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান। তার চেয়েও বড় কথা, স্পিনটা বলতে গেলে মুখস্থ খেলেন। এশিয়ায় ব্যাটিং গড় ৫১.৪৭। শুধু স্পিন আলাদা করে নিলে যা সামান্যই কমছে (৪৪.১৬)। বছরের শুরুতে ভারত সফরে চার টেস্টে তিনটি সেঞ্চুরি করেছেন। সেই স্মিথকে মাত্র ৮ রানে বোল্ড করে দিয়ে কে জানে, এই টেস্টের চিত্রনাট্যে সবচেয়ে বড় মোচড়টাই দিয়ে ফেললেন কিনা মিরাজ!
স্মিথকে হারিয়ে দিনের তৃতীয় ওভারেই অস্ট্রেলিয়া ৪ উইকেটে ৩৩। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের লিডটা ৪৩ রানের চেয়ে অনেক বড় হবে বলেই মনে হচ্ছিল তখন। না হওয়ার মূলে দুটি জুটি। পঞ্চম উইকেটে রেনশ ও হ্যান্ডসকম্বের ৬৯ রানের পর নবম উইকেটে অ্যাগার ও কামিন্সের ৪৯। অস্ট্রেলিয়ার মতো দল বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনীও ছাড়বে না, জানা কথাই। একটি-দুটি জুটি তাই অবশ্যম্ভাবীই ছিল। তবে বাংলাদেশের জন্য তা বড় যন্ত্রণার কারণ হলো। দুটি জুটিতেই যে ক্যাচিং ব্যর্থতার বড় অবদান।
রেনশর দুটি ক্যাচ পড়েছে। শর্ট লেগে দুবারই তা ফেলেছেন ইমরুল। শর্ট লেগের ক্যাচ একটু কঠিনই হয়। তবে কাভারে শফিউল কামিন্সের যে ক্যাচটি ফেলেছেন, পুরস্কার ঘোষণা করলেও তা ফেলা কঠিন। তখন ১১ রানে থাকা কামিন্স শেষ পর্যন্ত আউট হলেন ২৫ রান করে। জুটিতে যোগ হয়ে গেল আরও ২৭ রান। এমনিতে এমন বড় কিছু নয়। কিন্তু উইকেটের চরিত্রের কারণেই তা বড় হয়ে উঠছে। এখানে প্রতিটি রানই যে মহামূল্য!
অ্যাস্টন অ্যাগারের অপরাজিত ৪১ যে কারণে অনেক সেঞ্চুরির সমান। যদিও এতে বিস্মিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ব্যাটিংটা অ্যাগার ভালোই পারেন। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে দুটি সেঞ্চুরি আছে। টেস্ট অভিষেকে হইচই ফেলে দেওয়াও তো ব্যাট হাতেই। ২০১৩ সালে ট্রেন্টব্রিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর ৯৮ রানের ইনিংসটি টেস্ট ক্রিকেটে ১১ নম্বর ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ।
সাকিব ব্যাট হাতে আছেন। আছেন বল হাতেও। ৫০তম টেস্টের আরেকজন তামিম ইকবালের যেখানে একটাই অস্ত্র। সেই ব্যাট দ্বিতীয় ইনিংসেও আশার আলো ছড়াচ্ছে। ৩০ রানে অপরাজিত তামিমকে যে নাইটওয়াচম্যান তাইজুলকে নিয়ে মাঠ ছাড়তে হলো, সেটি শুধুই সৌম্যর অবিমৃশ্যকারিতার কারণে। উদ্বোধনী জুটিতে ৪৩ রান হয়ে গেছে, এরপর আর একটি ওভারই বাকি। নির্বিঘ্নে এটুকু সময় কাটিয়ে দিয়ে অস্ট্রেলিয়ানদের রাত আরও বিনিদ্র করে তোলার বদলে সৌম্য তাদের আনন্দে মাতিয়ে তুললেন। অ্যাগারকে তুলে মারতে গিয়ে লং অনে দেওয়া ক্যাচটায় উল্টো সৌম্যর রাতটাই হয়তো বিনিদ্র!