অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়-১
পঞ্চাশের প্রথম দিনেই সাকিব–তামিম
উৎপল শুভ্র
৩০ আগস্ট ২০২১
সাকিব আর তামিমের ৫০তম টেস্ট নিয়ে যত হইচই হয়েছে, আর কোনো ক্রিকেটারের ৫০তম টেস্ট নিয়ে তা হয়েছে বলে মনে হয় না। এটা আর এমন কি হাতিঘোড়া! তবে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টের প্রথম দিন এই হাইপের সার্থকতা প্রমাণ করেছিলেন দুজনই। ১০ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলা বাংলাদেশের উদ্ধার তো এই দুজনের জুটিতেই।
প্রথম প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০১৭। প্রথম আলো।
প্রথম দিন শেষে
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ২৬০; অস্ট্রেলিয়া ১ম ইনিংস: ১৮/৩
শরীরে বইছে উপমহাদেশীয় রক্ত। স্পিনটা তাই ভালো খেলারই কথা। কিন্তু উসমান খাজার রেকর্ড তা বলে না। বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য হুমকির তালিকায় তাঁর নামটা তাই অনেক পরে। তারপরও ঢাকা টেস্টের প্রথম দিনের দিকে ফিরে তাকালে অস্ট্রেলিয়ান ‘নাম্বার থ্রি’র আউটটাই সবচেয়ে তাৎপর্যবাহী হয়ে উঠছে!
সেটি তাঁর আউট হওয়ার ধরনের কারণে। রানআউটের সঙ্গে বেশির ভাগ সময়ই দুর্ভাগ্যের একটা যোগ থাকে, এখানে যা একদমই নেই। যেভাবে বলটা খেলেই দৌড় দিলেন, সেটির আসলে কোনো ব্যাখ্যাই হয় না। নাকি একটা ব্যাখ্যা হয়? আতঙ্ক!
অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিকেরাও দেখলাম এই লাইনেই ভাবছেন। দুই প্রান্ত থেকে স্পিনের বজ্র আঁটুনি। বল তো ইচ্ছামতো ঘুরছেই, নিচুও হয়ে যাচ্ছে প্রায়ই। ফাস্ট বোলিং সাহসের পরীক্ষা নেয়, স্পিন দক্ষতার সঙ্গে মনেরও। উসমান খাজার পাগুলে ওই দৌড়ের সঙ্গে এর যোগসূত্র না থেকে পারেই না। চাপ! চাপ! আতঙ্কে রূপ নেওয়া বিষম চাপ!
মিরপুরের উইকেটের চরিত্রটাও বুঝে নিতে পারেন এ থেকে। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের ২৬০ ভালো না খারাপ বুঝতেও যা জরুরি। ৩ উইকেটে ১৬৫ থেকে ২৬০ রানে অলআউট এমনিতে মন খারাপ হওয়ার মতোই। কিন্তু সেই অনুভূতিটা বদলে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে ১৮ রানে দিন শেষ করার পর। না, এই উইকেটে ২৬০-ও অনেক রান। এমন উইকেট, যেখানে টেস্টের প্রথম দিনে ১৩ উইকেটের ৯টিই স্পিনারদের!
তামিম ও সাকিবের ইনিংস দুটির মাহাত্ম্যও যা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। দুজনের ১৫৫ রানের ওই জুটিই তো দিন শেষে মাঠ ছাড়ার সময় ‘হাই ফাইভ’ করার সুযোগ করে দিল হাসিমুখ সতীর্থদের। ভালো-মন্দ, সাফল্য-ব্যর্থতা সবকিছুর বিচার শেষে এই দুজনকে বলতে পারেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুই রাজপুত্র। হেলাফেলার দল থেকে বাংলাদেশের সমীহ জাগানো দলে উত্তরণে এই দুজনেরই সম্ভবত সবচেয়ে বড় ভূমিকা। মাস ছয়েক আগে-পরে টেস্ট অভিষেক, কীভাবে কীভাবে যেন ক্যারিয়ারের ৫০তম টেস্টটা দুজনকে মিলিয়ে দিয়েছে এক বিন্দুতে। টেস্টের আগের দিন অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম বলেই দিয়েছেন, সাকিব-তামিমকে একটা ভালো কিছু উপহার দিতেই এই টেস্টে খেলবে বাংলাদেশ দল।
টেস্ট শুরুর পনেরো মিনিট যেতে না যেতেই পরিস্থিতিটা এমন যে ‘ভালো কিছু’ হওয়ার সম্ভাবনাটা ওই দুজনের ব্যাটের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে গেল। সাকিব যখন নামলেন, ম্যাচের মাত্র চার ওভার শেষ হয়েছে। স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে ৩ উইকেটে ১০। আগুনে এক স্পেলে বাংলাদেশের টপ অর্ডারকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছেন প্যাট কামিন্স। প্রথম ওভারেই গতির ঝড় তুলে সৌম্যকে কাঁপিয়ে দিলেন। পরের ওভারে পরপর দুই বলে তুলে নিলেন ইমরুল ও সাব্বিরকে। ২ ওভার শেষে কামিন্সের বোলিং বিশ্লেষণ দেখাচ্ছে: ২-১-৫-৩!
বাংলাদেশের টপ অর্ডার নিয়ে প্রশ্নটাও আরও বড় হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। এই টেস্টের একাদশ ঠিক করতে বিনিদ্র রাত কাটানোর কথা চন্ডিকা হাথুরুসিংহে নিজেই টুইট করে জানিয়েছেন। একটা পুরো জাতির আবেগ নাকি সেরা দল—কারণ নাকি এই টানাপোড়েন। একাদশ থেকে পরিষ্কার, ‘জাতির আবেগ’কে পাত্তা না দিয়ে তাঁর চোখে ‘সেরা দল’টিকেই নামিয়েছেন শ্রীলঙ্কান কোচ। যা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, হাথুরুর চোখে যা ‘আবেগ’, সেটিতেই বরং যুক্তি ছিল বেশি।
হাথুরুসিংহে যে ‘আবেগ’-এর কথা বলছেন, সেটির একটা নাম আছে। যা আপনার অনুমান করে ফেলার কথা—মুমিনুল হক। বোর্ড সভাপতির হস্তক্ষেপে যিনি শুধু স্কোয়াডেই প্রবেশাধিকার পেলেন, হাথুরুসিংহে নিজের জেদে অটল থাকায় একাদশের দরজাটা আর খুলল না। মুমিনুলের রেকর্ড বলে, তাঁর সুযোগ পাওয়াটা ‘আবেগ’-এর চেয়ে যুক্তির প্রতিই বেশি সুবিচার হতো। নিজেদের দিনে সৌম্য-সাব্বির বড় কিছু করে ফেলতেই পারেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঠিক আগের টেস্টটিতেই তো সৌম্যর ফিফটি আছে, সাব্বিরের আছে দুটি ‘চল্লিশ’। কিন্তু ব্যাটিংয়ের ধরনের কারণে এই দুজনকে টেস্টে প্রথম চারে রাখাটা বড় বেশি ‘ফাটকা’ খেলা হয়ে যায়।
সেই ‘ফাটকা’ কাজে না আসার পুরো চাপটা এসে পড়ল তামিম-সাকিবের ওপর। কী দারুণভাবেই তা জয় করলেন তাঁরা দুজন! দুজন দুভাবে। সাকিব তাঁর স্বভাবজাত আক্রমণাত্মক ঢঙে। ৬৫ বলে তাঁর ফিফটি। একসময় বলে বলে রান তোলাটাকেই ব্যাটিং মনে করা তামিমের ফিফটি যেখানে ১১৯ বলে।
নিজের ব্যাটিংয়ের ধরন নিয়ে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অনেক সংশয় পেরিয়ে তামিম এখন পরিণত এক ব্যাটসম্যানের প্রতিচ্ছবি। এখন তিনি ইচ্ছামতো ‘গিয়ার’ বদলাতে জানেন, জানেন কখন খোলসে ঢুকতে হবে, কখন বেরিয়ে আসতে হবে সেই খোলস ভেঙে। কালই যেমন একটা সময় গেল, যখন টানা ৩৩টি বলে কোনো রানই নিলেন না। সেই তামিমই আবার লায়নকে তিনটি ছক্কা মেরে দিলেন। এর মধ্যে একটি তো চোখে লেগে থাকার মতো। ইনসাইড আউট মেরে এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে ছক্কা। ক্রিকেটের কঠিনতম শটগুলোর একটি, তামিমের খেলার ধরনে যেটিকে একটুও কঠিন মনে হলো না। দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে লায়ন তো আর এমনিতেই তাঁর মুগ্ধতার কথা জানিয়ে গেলেন না।
আফসোস একটা তারপরও থাকল। তামিমের যেমন, তেমনি সাকিবেরও। ৫০তম টেস্টে তামিমের ফিফটি ২৯ রানের জন্য সেঞ্চুরিতে রূপ পেল না। সাকিব ফিরে গেলেন মাত্র ১৬ রান দূরে থাকতে।
সাকিবকে আউট করেই উইকেট-সংখ্যায় কিংবদন্তি রিচি বেনোকে ছুঁয়েছেন লায়ন। পরে আরও ২ উইকেট নিয়ে ছাড়িয়েও গেছেন তাঁকে, ছুঁয়েছেন ২৫০ উইকেটের মাইলফলক। অস্ট্রেলিয়ার স্পিনারদের মধ্যে মাত্র একজনই সামনে। তবে দুইয়ে থাকলেই একে ওঠার স্বপ্ন দেখার স্বাভাবিক নিয়মটা এখানে খাটছে না। এক নম্বরে যিনি আছেন, তাঁর নাম যে শেন ওয়ার্ন। নামটা সমস্যা নয়, সমস্যা হলো টেস্টে ওয়ার্নের উইকেট-সংখ্যা—৭০৮!