টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম লিড, প্রথম হ্যাটট্রিক
এ এক অন্য বাংলাদেশ!
উৎপল শুভ্র
২৯ আগস্ট ২০২১
আগের ২৩ টেস্টে বাংলাদেশ জানত, লিড জিনিসটা শুধু প্রতিপক্ষই নিতে পারে। পেশোয়ার টেস্টে প্রথম জেনেছিল, নিজেরাও প্রথম ইনিংসে লিড নেওয়া যায়। যা নিশ্চিত হয়েছিল অলক কাপালির হ্যাটট্রিকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই যা বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিক। কিন্তু এত সব অর্জনের আলোয় ভাস্বর দিনটি শেষ হয়নি হাসিমুখে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৫ রানেই যে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ!
প্রথম প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০০৩। প্রথম আলো।
শেষ দেড় ঘণ্টাই পাল্টে দিল সব। নইলে সত্যিকার অর্থেই স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো একটি দিন। অলক কাপালির হ্যাটট্রিক, মোহাম্মদ রফিকের অসাধারণ বোলিং, ২৩ টেস্টে সবচেয়ে কম রানে প্রতিপক্ষের প্রথম ইনিংস শেষ করে দিয়ে প্রথমবারের মতো লিড নেওয়া— এক দিনে বাংলাদেশের কত অর্জন!
এখানেই সব শেষ হওয়ার কথা ছিল না। এই সব অর্জনের মধুর সমাপ্তি হতে পারত টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম জয় দিয়ে। প্রথম ইনিংসে ৬৬ রানের লিড নিয়ে বাংলাদেশ যখন দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করল, এই টেস্টের সবচেয়ে সম্ভাব্য ফল হিসেবে বাংলাদেশের জয়ের কথাটা ভাবায় একটুও বাড়াবাড়ি ছিল না। এই কদিন আগেও আকাশকুসুম কল্পনা বলে মনে হওয়া এই ভাবনার পালে হাওয়া লাগানোর কাজটি করছিল দু'দলের প্রথম ইনিংস।
কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে আর প্রথম ইনিংসের পুনরাবৃত্তি করতে পারেননি বাংলাদেশের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা। নির্ধারিত ২২ ওভারের ২.২ ওভার বাকি থাকতেই আলোর স্বল্পতা যখন সমাপ্তি টেনে দিল দিনের খেলার, বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস তখন ৪ উইকেটে ৫২। প্রথম ইনিংসে ৬৬ রানে এগিয়ে থাকার পরও লিডটা মাত্র ১১৮ রানের। আজ অলক আর রাজিন কত দূর নিয়ে যেতে পারবেন, তার ওপরই নির্ভর করছে অঘটন ঘটানোর স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ আবার ফিল্ডিং করতে নামতে পারবে কি না। আশার পিঠে শঙ্কাটা এই, বাংলাদেশের এমন অসাধারণ পারফরম্যান্সের পরও আজ চতুর্থ দিনেই শেষ হয়ে যেতে পারে এই টেস্ট।
শোয়েব আখতারের প্রথম ৪ বল থেকে ৭ রান নিয়েছিলেন হান্নান, সেই প্রথম ওভারেই আউট জাভেদ ওমর। প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরির পর দ্বিতীয় ইনিংসে ‘গোল্ডেন ডাক’, প্রথম বলেই আউট। আজ যে রাজা, কালই তাকে ভিখারি বানানোয় ক্রিকেটের যে জুড়ি মেলা ভার, পুরনো সত্যটিকেই আবার নতুন করে জানলেন জাভেদ ওমর। ওপেনিংয়ে জাভেদ ওমরের সঙ্গী হান্নান সরকারও ফিরেছেন শোয়েব আখতারের প্রথম স্পেলেই। জাভেদ ক্যাচ দিয়েছিলেন উইকেটকিপারকে, হান্নান দিয়েছেন দ্বিতীয় স্লিপে। অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেওয়ার যে রোগটা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কাটিয়ে উঠেছিলেন বলে মনে হয়েছিল গত কিছুদিন, মোক্ষম সময়ে ফিরে এল সেটিই।
হাবিবুল আর আশরাফুল মিলে ধাক্কাটা যখন একটু সামলে উঠেছেন বলে মনে হচ্ছিল, তখনই পর পর দু বলে তাঁরা দুজন নেই। দানিশ কানেরিয়ার লেগ ব্রেকে স্লিপে ক্যাচ দিলেন আশরাফুল। আর নামার পর থেকেই যার ব্যাট থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল আত্মবিশ্বাস, সেই হাবিবুল বাশার উমর গুলের বলে এলবিডব্লু। ৪৩ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তখন অথৈ সাগরে। সেই সাগরে সাঁতার কাটছেন অলক কাপালি আর রাজিন সালেহ।
এই অংশটুকু বাদ দিলে বাংলাদেশের জন্য পেশোয়ার টেস্টের তৃতীয় দিনটি ছিল সোনায় মোড়ানো। যে উইকেটে একসময় বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসের স্কোর ছিল ২ উইকেটে ৩১০, সেই উইকেটে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদেরও রাজত্ব করারই কথা ছিল। রাজত্ব দূরে থাক, রীতিমতো ধুঁকতে ধুঁকতে এগিয়েছে পাকিস্তানের ইনিংস। আগের দিনের ২ উইকেটে ১৩৪ রান নিয়ে খেলতে নেমে ১৫৯ পর্যন্তই যেতে পেরেছেন তৌফিক উমর ও ইনজামাম-উল হক। এর পরই রফিকের শিকার তৌফিক, ১৯ রান পর ইনজামামের স্টাম্পও এলোমেলো হয়ে গেল রফিকের আর্মারে।
ইউসুফ ইয়োহানার সঙ্গে রশিদ লতিফের জুটিটি যখন হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখনো সেই রফিক। রশিদ লতিফকে স্টাম্পিংয়ের শিকার বানিয়ে বাংলাদেশকে সত্যিকার চালকের আসনে বসিয়ে দিলেন এই বাঁহাতি স্পিনার। হ্যাটট্রিকের মতো অবিস্মরণীয় এক কীর্তি গড়ে হঠাৎ করেই পাকিস্তানের ইনিংস শেষ করে দিয়েছেন অলক কাপালি। হ্যাটট্রিক শব্দটিতে এমনই এক জাদু লুকিয়ে যে, অলক কাপালিই হয়ে গেছেন বাংলাদেশের ‘বোলিং হিরো’।
তবে মোহাম্মদ রফিক তাঁর চেয়ে একটুও পিছিয়ে নেই, বরং এগিয়েই। কেরানিগঞ্জের এক দীনহীন পরিবার থেকে উঠে এসে মোহাম্মদ রফিকের টেস্ট ক্রিকেটার হওয়ার গল্প জমজমাট উপন্যাস বা ব্লকবাস্টার সিনেমার উপজীব্য হতে পারে। রূপকথার মতো সেই গল্পে কাল যোগ হলো নতুন এক অধ্যায়। গত এপ্রিলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঢাকায় ৭৭ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন। সেই ক্যারিয়ার-সেরা বোলিংকে পেছনে ফেলতে পারেননি, তবে পরিসংখ্যানের বাইরেও যে ক্রিকেটে কিছু বিবেচনা থাকে, সেই বিবেচনায় পেশোয়ারে রফিকের ১১৮ রানে ৫ উইকেটকেই এগিয়ে রাখতে হচ্ছে। মাথার ওপর গনগনে সূর্য, যেন লু হাওয়া বইছে মাঠে, এই বিরুদ্ধ পরিবেশে শুধু বোলিং নয়, মানসিক শক্তিমত্তারও বড় পরীক্ষা দিতে হয়েছে রফিককে। সেই পরীক্ষায় তার লেটার মার্কস।
সকালে টানা ১৭ ওভারের এক স্পেল করেছেন, তাতে ৪৭ রান দিয়ে ২ উইকেট। লাঞ্চের পর পুরো সেশনই টানা বল করে গেলেন, ১২ ওভারে ৪০ রান দিয়ে আরো ২ উইকেট। আগের দিনের ১ উইকেট ছিলই, চতুর্থ টেস্টেই দুবার ইনিংসে ৫ উইকেট হয়ে গেল তাঁর। অথচ এই রফিককেই ওয়ানডে বোলার বানিয়ে টেস্টের পর টেস্ট বসিয়ে রাখা হয়েছে বাইরে।
চা-বিরতির পরও এক প্রান্তে রফিক। সারা দিনে প্যাভিলিয়ন প্রান্ত থেকে যে ৩৩ ওভার বল হলো, তার ৩২ ওভারই করেছেন রফিক। অলকের ছায়ায় ঢাকা পড়ার আগে রফিকের পরই বাংলাদেশের বোলিংয়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম হয়ে ছিলেন অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ। আগের ৯টি টেস্টে মাত্র ২টি উইকেট এই পর্যায়ে বোলার হিসেবে তাঁর কার্যকারিতা নিয়েই সংশয় জাগিয়েছিল। হয়তো সংশয় জেগেছিল তার মনেও। এখানে ২২ ওভারে মাত্র ৪২ রান দিয়ে ২ উইকেট প্রায় মুছে দিয়েছে সেই সংশয়। লাঞ্চের পর চা-বিরতি পর্যন্ত দেড় ঘণ্টায় এক প্রান্তে রফিক আর অন্য প্রান্তে তিনি। ১১ ওভারের সেই স্পেলে ২০ রান দিয়ে শোয়েব আখতারের উইকেট।
বোলিংয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। প্রথম ইনিংসে করা ২৫ রানকে ব্যাটিংয়েও উত্তর দেওয়ার শুরু বলে ধরে নিলে আজ খালেদ মাহমুদের ব্যাট থেকে বড় কিছু আসা উচিত। অধিনায়কও জানেন, সময় তাঁকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কী এক সন্ধিক্ষণের সামনে দাঁড় করিয়েছে!
নায়ক হওয়ার সুযোগ হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাঁকে।