সেন্ট লুসিয়া টেস্ট ২০০৪
রিচার্ডস-লারার প্রশংসা-ভেজা সেঞ্চুরি নিয়ে হাবিবুল কী বলেছিলেন?
২২ আগস্ট ২০২১
টেস্টে এর আগেই করেছিলেন দুটি সেঞ্চুরি, খেলেছিলেন জিম্বাবুয়েতে ৭৬ রানের হার না মানা এক ইনিংসও। তবে হাবিবুল বাশারের কাছে সেরা টেস্ট ইনিংস সেন্ট লুসিয়ার ওই সেঞ্চুরিই। কেন সেরা, তার ব্যাখ্যা খুঁজতে ফিরে যেতে হচ্ছে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের কাছে। ওই যে ৪৫২ করে বলেছিলেন, `এ এমন এক দিন, যেদিন সব মনমতো হয়েছিল।`
প্রথম প্রকাশ: ৩০ মে ২০০৪। প্রথম আলো।
স্যার ভিভ রিচার্ডস আপ্লুত হয়ে বলছেন, ‘ভেরি গুড ইনিংস’। প্রথম দিনের খেলা শেষ হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে ব্রায়ান লারা বললেন, ‘প্রথম বলেই উইকেট হারানোর পর নেমে বাংলাদেশ-অধিনায়ক যে ইতিবাচক ব্যাটিং করেছে, এক কথায় তা অসাধারণ!’ ডেভ হোয়াটমোর এটিকে বলছেন তার দেখা ‘সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক সেঞ্চুরিগুলোর একটি’। হাবিবুল বাশার যে এই ১১৩-কে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর সেরা ইনিংস বলে মানছেন, তাতে তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই।
টেস্টে তাঁর দুটি সেঞ্চুরি ছিল। জিম্বাবুয়ে আর পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই দুটি সেঞ্চুরিই ১০৮ রানের। এই ১১৩-ই টেস্ট ক্রিকেটে হাবিবুলের সর্বোচ্চ। সর্বোচ্চ বলেই সেরা নয়। এই সেন্ট লুসিয়া টেস্টের আগ পর্যন্ত তাঁর দুই সেঞ্চুরির কোনোটিকে নয়, হাবিবুল তাঁর সেরা ইনিংস বলে মেনে এসেছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারে টেস্টের ৭৬-কে। ১১৩ যে সেটিকেও ছাড়িয়ে গেল, তার কারণটা হাবিবুলের মুখ থেকেই শুনুন, ‘পুরো ইনিংসে মাত্র একটি বল আমার পেছনে গেছে, এ ছাড়া একবারও বিট হইনি। একটা বলও পায়ে লাগেনি। যেভাবে মারতে চেয়েছি, সেভাবেই মারতে পেরেছি। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি, আমার কাছে এটি এখনো বিশেষ কিছু। টেস্ট ক্রিকেটে এটাই আমার সেরা ইনিংস।’
ক্রিকেট সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয়ে গেছে কবেই, পুরনো সেই দিনের কথা স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেই এখন দিন কাটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। তারপরও ‘দ্য কিং ইজ ডেড, লং লিভ দ্য কিং’— এই প্রবাদটি তো আর মিথ্যে হয়ে যায়নি। রাজ্য হাতছাড়া হয়েছে, সেই রাজসিক ক্রিকেটবোধটা মরে যায়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের কাছে এখনো ক্রিকেটের একটাই অর্থ— বিনোদন। সাহসীর ভক্ত তারা, ভক্ত ইতিবাচক খেলার। সেন্ট লুসিয়া টেস্টের ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা যে হাবিবুল বাশারকে হৃদয়ে বরণ করে নিলেন, তার কারণও এটিই। প্রথম বলেই উইকেট— একজন ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যানের জন্য এর চেয়ে বড় চাপ আর হতে পারে না। হাবিবুলের ওপর চাপ তো সেখানেই শেষ হওয়ার নয়। শুধু ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যান নন, তিনি তো দলের অধিনায়কও। তারপরও নেমেই যেভাবে স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছড়াতে শুরুকরলেন, তাতে টেস্ট ক্রিকেটের চাপ-টাপ নিয়ে লোকজন যে এত কথা বলে, সেগুলোকে মনে হতে লাগল শুধুই কথার কথা!
‘আসলে প্রথম বলেই উইকেট পড়ে যাওয়ায় আমি কিছু ভাবার সুযোগ পাইনি। নার্ভাস হতেও তো একটু সময় লাগে! প্যাড-ট্যাড পড়ে ভালোভাবে বসার আগেই তো নেমে পড়তে হলো।’ একটু মজা করে নিলেন, সিরিয়াস হলেন এরপর, ‘প্রথম বলটিই ব্যাটের মাঝখানে লাগাটা আমার আত্মবিশ্বাসটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। তা ছাড়া আমি জানতাম, ওয়ানডেতে যা-ই হোক, টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলাররা প্রচুর বাজে বল দেয়। জানতাম, উইকেটে থাকলে রান হবেই।’
ওয়েস্ট ইন্ডিজ চার ফাস্ট বোলার নিয়ে নামছে জানার পরই একটা হাসি খেলে গিয়েছিল তার মুখে। চার ফাস্ট বোলার মানেই প্রচুর শর্ট বলের নিশ্চয়তা, তিনি ভালো পুল খেলেন বলে রান করার নিশ্চয়তাও, কারণ কি এটাই? হাবিবুলের ঢিলেঢালা-আয়েশি ভাবভঙ্গি ভেতরের যে আগুনটাকে আড়াল করে রাখে, সেটিই ফুটে বেরোল এই প্রশ্নের উত্তরে, ‘চ্যালেঞ্জ নিতে আমার খুব ভালো লাগে। যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই চার ফাস্ট বোলারকে খেলা একটা চ্যালেঞ্জ। আমিও এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলাম। আজ সেই চ্যালেঞ্জে জিতেছি, আরেক দিন হয়তো হেরে যাব। ক্রিকেটটাকে আমি এভাবেই দেখতে চাই।’
তিনটি সেঞ্চুরি করে ফেলার পর এখন আর এটি বলা ঠিক নয়। তবে ফিফটিকে সেঞ্চুরিতে রূপ দিতে না পারার কারণে এক সময় যে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘মিস্টার ফিফটি’, তা তো আর মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে না। সাংবাদিকদের মুখে এতবার কথাটা শুনেছেন যে, সেন্ট লুসিয়ায় ফিফটি করার পরও ‘মিস্টার ফিফটি’ শব্দ দুটি ঘুরপাক খেতে শুরুকরেছিল হাবিবুলের মাথায়। এই বাড়তি বোঝাকে ঝেড়ে ফেলতে শরণাপন্ন হলেন ডেভ হোয়াটমোরের, 'পঞ্চাশ করার পরই আমি আউট হয়ে যাই, এটা মাথায় এসেছিল এখানেও। তখন কোচের কথা মনে করেছি। কোচ বলেছিলেন, "তোমাদের সমস্যা হলো তোমরা বেশি পরের কথা চিন্তা করো। রানের কথা তো ভাবারই দরকার নেই। বল অনুযায়ী খেলো।" আমি সেভাবেই খেলেছি।'
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যানই শুধু নন, এই দলের একমাত্র বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান হিসেবেও পুরো ক্রিকেট বিশ্ব চেনে তাঁকে। সেই পুরনো সত্যিটাকেই নতুন করে জানিয়েছে এই সেঞ্চুরি।
তবে এই ১১৩-র মহিমা এখানেই শেষ হচ্ছে না। অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক টেস্টে পেয়েছিলেন ‘পেয়ার’, জিম্বাবুয়ে সফরে একটি ওয়ানডে ছাড়া বাকি সব ম্যাচেই ব্যর্থ। অধিনায়কত্বের চাপে ব্যাটসম্যান হাবিবুল বাশার হারিয়ে যাচ্ছেন কি না, প্রথম সিরিজেই এই প্রশ্ন তুলে ফেলেছিলেন অতি উৎসাহী কেউ কেউ। এই সেঞ্চুরিকে তাদের জন্য জবাব হিসেবে দেখতে পারেন। তবে সেটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো, হাবিবুলের নিজের মনে অঙ্কুরিত হতে থাকা সংশয়েরও মৃত্যু ঘটাল এই সেঞ্চুরি।
১১৩ করেই যে আউট হয়ে গেলেন, সেটা কি অধিনায়কত্বের চাপে? রসিকতাটা বুঝতে পেরে হো হো করে হাসলেন হাবিবুল বাশার। শুধু রসিকতার প্রতিক্রিয়া নয়, সেটি তৃপ্তিরও হাসি। ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস খেলার তৃপ্তি।