কেন সুমনকেই বারবার শিকার হতে হয় এমন?

টেস্ট ক্রিকেটে শুরুর সময়টায় বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের বিজ্ঞাপন হয়ে ছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন। অথচ তাঁকে নিয়ে নির্বাচকদের ছেলেখেলার কারণে এমন তো হতেই পারত, টেস্টই খেলা হলো না তাঁর। অভিষেক টেস্টে সুমনকে বাদ দিয়ে দল ঘোষণার পর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে লেখাটা লিখেছিলাম। বোর্ড সভাপতির হস্তক্ষেপে পরে সুযোগ পান সুমন। বাকিটুকু, যেমন বলা হয়, ইতিহাস!

প্রথম প্রকাশ: ১ নভেম্বর ২০০০। প্রথম আলো।

গত এক বছর মনে হচ্ছিল, তাঁকে নিয়ে নির্বাচকদের খেলাটা বোধ হয় অবশেষে শেষ হয়েছে। ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে শারজায় পঞ্চম এশিয়া কাপে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকে হাবিবুল বাশার সুমনকে নিয়ে তো খেলাই করেছেন নির্বাচকরা। দল থেকে ইচ্ছেমতো বাদ দিয়ে বারবার ভেঙে দিয়েছেন এই ন্যাচারাল স্ট্রোক মেকারের আত্মবিশ্বাস। এমনিভাবেই আইসিসি ট্রফি, বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে তাঁর ব্যাটিং থেকে বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ। অভিষেক টেস্টের দল গড়তে গিয়ে আবারও সেই একই কাজ করলেন তানভীর হায়দার অ্যান্ড কোং।

মিনি বিশ্বকাপ ও দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের জন্য যখন বাংলাদেশ দল গড়া হয়, যে চার/পাঁচটি নাম নির্দ্বিধায় লিখে নিয়ে দল নির্বাচনের কাজ শুরু করেছিলেন নির্বাচকেরা, অবধারিতভাবেই তার একটি ছিল হাবিবুল বাশার সুমন। তার মানে সুমনের বাদ পড়ার কারণ হতে পারে একটাই–ওই সফরেই তাঁর ভয়াবহ কোনো সমস্যা আবিষ্কার করে ফেলেছেন নির্বাচকেরা! মিনি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিতে বুলবুলের দোষে রান আউট হওয়ার আগে দারুণ খেলছিলেন সুমন, কিম্বার্লিতে চার দিনের ম্যাচে আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে আউট হয়েছেন–এ কথা বলছেন প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাংবাদিক। তাহলে আর কী বাকি রইল? তিন ম্যাচের ওই ওয়ানডে সিরিজ? তাতে সুমন ব্যর্থ, কিন্তু কে এমন কী করেছে? যে ম্যাচটিতে ৫১ রানে অলআউট হলো বাংলাদেশ, সেটিতেও তো দুই অঙ্কে পৌঁছানো একমাত্র ব্যাটসম্যান সুমন।

তাছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার ওই বাউন্সি উইকেট আর ঢাকার স্লো-লো উইকেটের পার্থক্য বুঝবেন না নির্বাচকেরা? গত এক বছরের পারফরম্যান্স কোনো বিবেচনাতে আসবেই না? গত বছর এমন সময়েই চট্টগ্রামে ইংল্যান্ড 'এ' দলের বিপক্ষে সুমন অপরাজিত ১৪৩ রানের যে ইনিংসটি খেলেছিলেন, বাংলাদেশ অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল সেটিকে বর্ণনা করেছিলেন 'তাঁর দেখা অন্যতম সেরা ইনিংস' বলে। সেই সিরিজ কাভার করতে আসা তিন ইংরেজ সাংবাদিক মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, 'তোমরা যে নিয়মিত তিন/চার দিনের ম্যাচ খেলো না, এই ছেলেটির ব্যাটিং দেখে তো তা মনেই হলো না।'

১৯৯৭-এর অক্টোবরে নাইরোবিতেও এমনই মুগ্ধতাজাগানিয়া একটি ইনিংস খেলেছিলেন সুমন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৭০ রানের ইনিংসটিকে সে সময় পর্যন্ত ওয়ানডেতে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের সেরা ইনিংস বলে নির্দ্বিধায় স্বীকৃতি দিতে চাই। অথচ এরপরই তিনি বাদ! বিস্ময়ের বিস্ময়, বিশ্বকাপের ৩০ জনের প্রাথমিক দলেও ডাক পাননি! বিশ্বকাপের পর গত বছর অক্টোবরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও প্রথমে বাদ দেওয়া হয়েছিল সুমনকে। ওয়ানডে সিরিজের ঠিক আগে অপির ইনজুরি সুযোগ করে দিল তাঁকে। দুটি ওয়ানডেতে ২৫ ও ০ করার পরও (মাত্র ৪৫ বলে সেঞ্চুরি করা প্রমত্ত ব্রায়ান লারাকে আউট করার কথাটাও বলা উচিত) টিকে গেলেন ইংল্যান্ড 'এ' দলের বিপক্ষে। সেই সিরিজে সুমনই সেরা পারফরমার। বিসিবি একাদশের পক্ষে ওয়ানডেতে ৮৩ রান দিয়ে শুরু। এরপর চট্টগ্রামে তিন দিনের ম্যাচের দুই ইনিংসে ১৪৩ ও ৩৫। ঢাকায় চার দিনের ম্যাচটিতে ব্যর্থ হলেও জানুয়ারিতে এমসিসির বিপক্ষে বিসিবি একাদশের পক্ষে ওয়ানডেতে ৪৪ রানের পর চার দিনের ম্যাচে ৮৫ রানের দারুণ এক ইনিংস। গত এক বছরে বাংলাদেশের কজন ব্যাটসম্যান এর চেয়ে বেশি ধারাবাহিকতা দেখাতে পেরেছেন?

১০ নভেম্বর যে দলের বিপক্ষে অভিষেক টেস্ট, গত জুনে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে সেই ভারতের সঙ্গেই সুমন খেলেছিলেন ৫৭ রানের এক ইনিংস। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮৭ রানে অলআউট হয়ে যাওয়া ম্যাচটিতেও ওয়াসিম আকরামদের যে খেলা যায়, একমাত্র সুমনই তা প্রমাণ করেছিলেন। ইনিংসটি ছিল মাত্র ২৩ রানের, কিন্তু তাতে ৪টি বাউন্ডারি আর ব্যাট করার ধরন মিলিয়ে চিনিয়ে দিয়েছিল তাঁর জাতটা। হায়! এ সবকিছুই ভুলে গেলেন নির্বাচকেরা!

হতাশাটা বিশাল এক ধাক্কাই দিয়েছে তাঁকে। তারপরও হয়তো অভিজ্ঞতাটা নতুন কিছু নয় বলেই একেবারে ভেঙে পড়েননি। বরং টেলিফোনে প্রত্যয়ীই শোনাল সুমনের কণ্ঠটা, 'আমি কামব্যাক করবই'। প্রধান নির্বাচকের দেখানো বাদ দেওয়ার কারণ জানার পর অস্ফুট স্বরে বললেন, 'আমার ফিটনেস খুব ভালো নয়, মানি। কিন্তু আজ সকালের টেস্টেও তো আমি আগের চেয়ে ভালো করেছি।'

বাক্যটির শেষে 'তাহলে কেন' এই শব্দ দুটি হয়তো অনুচ্চারিতই রয়ে গেছে। সুমনের স্বভাবটাই এমন, নিজের অধিকার সম্পর্কে কখনোই চেঁচিয়ে বলার লোক তিনি নন। প্যাঁচগোচও কিছু কম বোঝেন। এই সময়ে এগুলো বোধ হয় গুণের চেয়ে 'দোষ' বলেই বিবেচিত হয় বেশি। আইসিসি ট্রফির পর বিশ্বকাপ, বিশ্বকাপের পর অভিষেক টেস্ট–আসল সময়ে সুমনকে বারবার ছুঁড়ে ফেলার আর তো কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।