৪৯৯ রানে রান আউট এবং স্কোরবোর্ডের ভুল

উৎপল শুভ্র

১৬ আগস্ট ২০২১

৪৯৯ রানে রান আউট এবং স্কোরবোর্ডের ভুল

টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভাঙার সুযোগ পেয়েও তা করতে পারেননি, তবে পরের বছরই ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান করার রেকর্ড গড়েছিলেন ঠিকই। আনন্দটা অবশ্য পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেননি ৫০০তম রানটি নিতে গিয়ে রান আউট হয়ে যাওয়ায়। বিশেষ ধারাবাহিকের তৃতীয় পর্বে ওই ৪৯৯ এবং হানিফ মোহাম্মদের ঢাকা-স্মৃতি।

ব্রিজটাউনে ৩৩৭ রানের মহাকাব্যিক ওই ইনিংস খেলার পরও একটা আক্ষেপ ছিল হানিফ মোহাম্মদের। টেস্ট এবং ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে দীর্ঘতম ইনিংসের রেকর্ড গড়েছেন ঠিকই, কিন্তু এর চেয়েও বড় একটা রেকর্ড করার সুযোগও যে ছিল। লেন হাটনের বিশ্ব রেকর্ড ভাঙার সুযোগ। সেই রেকর্ড তো ছিল আর মাত্র ২৭ রান দূরেই। আক্ষেপটা আরেকটু বেড়ে যায়, যখন ঠিক পরের টেস্টেই গ্যারি সোবার্সকে ওই রেকর্ড ভেঙে ফেলতে দেখেন। শুধু দেখেন বললে পুরোটা বলা হয় না। লেন হাটনকে ছাড়িয়ে যাওয়া সিঙ্গেলটি হানিফের বলেই নিয়েছিলেন সোবার্স। ডান হাতি অকেশনাল অফ স্পিনার হানিফ সেই বলটি করেছিলেন বাঁ হাতে। আম্পায়ার তা জানানোর পর সোবার্সের কথাটা ক্রিকেটের অমর উক্তির একটি, 'চাইলে ও দুই হাতেও বল করতে পারে।' যা মনে করিয়ে দেওয়ায় হানিফ শুধু হাসলেন।

১৯৫৮ সালের জানুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হানিফ মোহাম্মদের ওই ৩৩৭। পরের বছর জানুয়ারিতে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ডটি করার পরও একটা আক্ষেপ ঠিকই সঙ্গী হয়েছিল তাঁর। ৪৯৯ রানে রান আউট হয়ে গেলে কার না আক্ষেপ হবে! অন্তত ওই মুহূর্তের জন্য ৪৯৯ রান করার তৃপ্তির চেয়ে আর ১ রান করতে না পারার দুঃখই তো বড় হয়ে ওঠার কথা। হানিফের দুঃখ আরও বেড়ে গিয়েছিল একটা ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছিলেন বলে। সে কথায় একটু পরে আসি।

করাচি পার্সি ইনস্টিটিউট মাঠে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে ৩০০ করার পর বড় ভাই ওয়াজির মোহাম্মদ হানিফকে বলেছিলেন, 'তোমাকে বিশ্ব রেকর্ড ভাঙতে হবে।' ক্রিকেটের সব আইন আর রেকর্ড মুখস্থ থাকার কারণে যে ওয়াজিরকে পাকিস্তান দলের সবাই ডাকত ‘উইজডেন’ বলে, তিনিও সেই ম্যাচে একই দলে খেলছেন। ‘বিশ্ব রেকর্ডটা কত’ জিজ্ঞেস করে হানিফ জবাব পেলেন, ‘মাত্র ৪৫২'। হানিফ বড় ভাইয়ের মুখে 'মাত্র' শুনে হেসে ফেললেন, 'আপনি নিশ্চয়ই রসিকতা করছেন। আমার মাত্র ৩০০ হয়েছে, তা ছাড়া আমি এখনই খুব ক্লান্ত।’ বড় ভাই তাতেও দমলেন না, 'আজ রাতে আমি তোমাকে দারুণ একটা ম্যাসাজ করে দেব। এরপর ভালো একটা ঘুম দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।'

বড় ভাই ওয়াজির মোহাম্মদের সঙ্গে ব্যাটিং করতে নামছেন হানিফ

ঠিক হয়েও ছিল। পরদিন হানিফ রেকর্ড তো ভাঙলেনই; পরে ব্রায়ান লারা যা করেছেন, প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে সেই ৫০০ রান করার গৌরব থেকে তাঁকে বঞ্চিত করল শুধুই দুর্ভাগ্য। সে ঘটনা বলতে গিয়ে এত বছর পরও হানিফের কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল আক্ষেপ, ‘দিনের শেষ ওভার শুরুর সময় আমি ছিলাম ৪৯০-এর ঘরে। দুই বল বাকি থাকতে আমি দেখলাম, স্কোরবোর্ডে আমার রান ৪৯৬। পঞ্চম বলটিকে ডিপ এক্সট্রা কাভারে পাঠিয়ে সেখানে মিসফিল্ড হওয়ায় আমি স্ট্রাইক ধরে রাখতে দ্বিতীয় রানটি নিতে গিয়ে রান আউট হয়ে যাই । অথচ আউট হয়ে ফেরার সময় দেখি আমার রান ৪৯৯। আমি তো অবাক। পরে জানলাম, স্কোরবোর্ডে কাজ করছিল যে ছেলেটি, সে ঠিক অংকটি খুঁজে না পাওয়ায় দেৱি করেছিল আমার রানটা বসাতে, আসলে দুই বল বাকি থাকতে আমার রান ছিল ৪৯৮। এটা জানার পর আমার খুব মন খারাপ হলো। তখন আমি এত সেট ছিলাম যে, রান ৪৯৮ জানলে পঞ্চম বলটিতে ঝুঁকি না নিয়ে ২ রান নেওয়ার জন্য শেষ বলটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম।'

হয়তো সেই দুঃখে সান্ত্বনা দিতেই কে একজন এসে তাকে বলেছিল, 'ভালোই হয়েছে। ৫০০ করলে তোমাকে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে হতো। আর কাউকে সঙ্গে পেতে না তুমি।' এই ভয়ে ভীত না হয়ে ব্রায়ান লারা ঠিকই পাঁচ শ করে ফেলেছেন। ১৯৯৪ সালে ৫০১ রান করে তাঁর রেকর্ড ভাঙার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই লারাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন হানিফ মোহাম্মদ। ছোট ভাই মুশতাক ছিলেন সেখানে, তিনিই ফোনে ধরিয়ে দেন লারাকে। রেকর্ড হারানোর দুঃখ থাকলেও একটাই সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন হানিফ মোহাম্মদ। লারা স্যার গ্যারি সোবার্সের দেশের লোক।' সোবার্স শুধু হানিফ মোহাম্মদের অল-টাইম ফেবারিট ক্রিকেটারই ছিলেন না, এই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অলরাউন্ডারের মতো কাউকে যে ক্রিকেট বিশ্ব আর দেখতে পাবে না–এ নিয়েও কোনো সন্দেহ ছিল না তাঁর মনে।

করাচির পার্সি ইনস্টিটিউট মাঠে হানিফ মোহাম্মদের ৪৯৯ রানের বিশ্ব রেকর্ডের স্মারক

বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম একটি আলাদা দেশে পরিণত হওয়ার পর আর এখানে আসা হয়নি হানিফ মোহাম্মদের। তবে আসতে ইচ্ছে হয়েছে অনেকবারই, বিশেষ করে ঢাকায়। ঢাকার প্রতি তার বাড়তি ভালোবাসাটা ফুটে বেরিয়েছিল অনেকবারই। হানিফ মোহাম্মদের টেস্ট সেঞ্চুরির তালিকায় চোখে বুলালে এটিকে অবশ্য খুবই স্বাভাবিক বলেই মনে হবে। তার ১২টি টেস্ট সেঞ্চুরির ৩টিই এই ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম), এর মধ্যে দুটি আবার একই টেস্টে।

১৯৫৫-৫৬ সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঢাকাতে ১০৩ রান ছিল হানিফ মোহাম্মদের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরি। সেই সুখস্মৃতি অবশ্য গৌণ হয়ে যায় বছর পাঁচেক পর ১৯৬০-৬১ তে টেড ডেক্সটারের ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।  সেই টেস্টের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করে পাকিস্তানের পক্ষে জোড়া সেঞ্চুরির প্রথম কীর্তিটি গড়েন হানিফ মোহাম্মদ। ঢাকায় হানিফ মোহাম্মদের আরেকটি ফার্স্ট ক্লাস সেঞ্চুরি আছে, তবে তা টেস্টে নয়।১৯৬৬-৬৭ মৌসুমে সেই সেঞ্চুরির প্রতিপক্ষ হিসেবে তিনি যে 'সিলোন'-এর কথা বললেন, সেটি এখন শ্রীলঙ্কা নামে পরিচিত। যেখানে তাঁর এত সাফল্য, সেই ঢাকার প্রসঙ্গ উঠতেই হানিফ মোহাম্মদের কণ্ঠে যে তাই আবেগ ফুটে বেরোবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! ‘ঢাকা আমার খুব লাকি মাঠ। ওখানে খেলাটা আমি সব সময়ই খুব এনজয় করেছি। আমি ঢাকায় খেলেছি, চট্টগ্রামেও গেছি, আসলে বাংলাদেশে মাঠের বাইরেও আমার সময়টা খুব ভালো কাটত। আমার বয়স তখন কম, তা ছাড়া আমি দেখতেও খুব ছোটখাটো, ও কারণে সবাই আমাকে খুব ভালোবাসত। লোকজন আমার জন্য বাসা থেকে খাবার তৈরি করে নিয়ে আসত।' 

হানিফ মোহাম্মদ: পাকিস্তানের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে জোড়া সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েছিলেন এই ঢাকায়

৩৩৭ রানের ওই রেকর্ড ভাঙা কীর্তিই টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে স্মরণীয় ইনিংস হতে পারে, তবে সেটিকেই তাঁর সেরা ইনিংস মনে করতেন না হানিফ মোহাম্মদ। সেই মর্যাদা ১৯৬৭ সালে লর্ডসে অপরাজিত ১৮৭ রানের। নয় ঘণ্টারও বেশি সময়ব্যাপী ৫৫৬ মিনিটের ওই ইনিংসের সময় ইংল্যান্ডের একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, 'অনলি দ্য পুলিশ ক্যান রিমুভ হানিফ’, সঙ্গে ছাপা হয়েছিল একটি কার্টুন–দুজন পুলিশ উইকেট থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে হানিফ মোহাম্মদকে। এই গল্প বলার সময় পাশে বসা হানিফ মোহাম্মদের নাতি শেহজার অবাক হয়ে দাদুকে জিজ্ঞেস করল, “সত্যিই কি তোমাকে পুলিশে ধরেছিল নাকি?'

আদর করে শেহজারের মাথার চুল এলেমেলো করে দিতে দিতে হানিফ বলেছিলেন, “লর্ডসের ওই ইনিংসের মতো ১৯৬০-৬১তে বোম্বের ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামে রান আউট হওয়ার আগে ১৬১ রানের ইনিংসটিও একটি আলাদা জায়গা নিয়ে আছে হানিফ মোহাম্মদের মনে। তেমনি ১৯৫৪ সালে নটিংহামের ট্রেন্ট ব্রিজে ৫১ রানও। কারণটাও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছিলেন, 'আমার অনেক সেঞ্চুরির চেয়েও ওই ইনিংসটিকে এগিয়ে রাখি আমি। এই টেস্টেই ইংল্যান্ডের পক্ষে ডেনিস কম্পটন ২৭৮ করেছিল। আমরা ব্যাট করার আগে বৃষ্টি হয়েছিল, তখন তো আর উইকেট ঢেকে রাখার নিয়ম ছিল না। বৃষ্টিভেজা সেই উইকেটে ট্রুম্যান ও স্ট্যাথামকে খেলাটা ছিল দারুণ এক চ্যালেঞ্জ। আমি আউট হয়েছিলাম অ্যালেক বেডসারের বলে, স্পিনারদের বলে উইকেটকিপার যেমন দাঁড়ায়, বেডসারের বলেও তেমনি স্টাম্পের ঠিক পেছনে দাঁড়ানো গডফ্রে ইভান্স ডাইভ দিয়ে অসাধারণ এক ক্যাচ নিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিল আমায়। ইভান্সের ওই ক্যাচ নেওয়ার ছবিটি আমি এখনো রেখে দিয়েছি।'

অবধারিত প্রশ্নটা করতেই হলো, 'তাহলে গডফ্রে ইভান্সই আপনার দেখা সেরা উইকেটকিপার?

চলবে...

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×