বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া টি-টোয়েন্টি সিরিজ
কোন ছবিটা চোখে ভাসে আপনার?
উৎপল শুভ্র
১০ আগস্ট ২০২১
শুধু বাংলাদেশ জিতেছে বলেই নয়, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে আরও অনেক কারণেই। ঘটনার ঘনঘটা, বিচিত্র সব রেকর্ড, স্মরণীয় ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স..এসবের মধ্যে প্রথম কোনটি মনে পড়ে আপনার?
অবিশ্বাস্য এক সিরিজ! তা শুধু বাংলাদেশ ৪-১ ম্যাচে জিতেছে বলেই নয়। বাংলাদেশ হারলেও তা অবিশ্বাস্যই থাকত। অবিশ্বাসের মাত্রাটাতে একটু হেরফের হতো, এই যা!
এমন টি-টোয়েন্টি সিরিজ ক্রিকেট আসলেই আগে কখনো দেখেনি। যেখানে প্রথমে ব্যাটিং করা দল যেকোনো একটা স্কোর করেও জয়ের আশা করতে পারে। মহা নাটকীয় পাঁচ ম্যাচের এই সিরিজের দিকে ফিরে তাকালে কী কী মনে পড়ছে আপনার? মনে করতে একটু সাহায্য করি।
রানের জন্য হাহাকার
টি-টোয়েন্টি সিরিজে রান এমন মহামূল্য হয়ে যায়নি আগে কোনোদিন। প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ১৩১ রান করার পর যেমন কল্পনাও করা যায়নি যে, এটাই হয়ে থাকবে সিরিজের সর্বোচ্চ স্কোর। পাঁচ ম্যাচের ১০ ইনিংসের রান যোগ করলে হয় ১০৬২। টেস্ট খেলুড়ে দুটি দলের মধ্যে পাঁচ ম্যাচের দ্বিপক্ষীয় সিরিজে যা সবচেয়ে কম রানের রেকর্ড। মাত্র মাস দেড়েক পুরনো রেকর্ডটা গড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ-দক্ষিণ আফ্রিকা। তা রেকর্ড ভাঙারও তো একটা ধরন থাকে। রানমন্দার ওই সিরিজকেও এখন যেমন অনেক রান-প্রসবা বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সিরিজের চেয়ে তো ৪২৬ রান বেশি হয়েছিল গ্রেনাডায়। বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ওভার প্রতি রান ৫.৮৫, শুধু পাঁচ ম্যাচের সিরিজই নয়; তিন বা এর বেশি ম্যাচের যে কোনো টি-টোয়েন্টি সিরিজেই যা সবচেয়ে কম।
ডিফেন্ড করায় হ্যাটট্রিক
যেকোনো স্কোর করেই জয়ের আশা করা যায় বলেছিলাম। প্রমাণ তো ম্যাচে ম্যাচেই। সবচেয়ে কম রান করে তা ডিফেন্ড করার রেকর্ড এক সিরিজেই তিনবার ভেঙেছে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে ১৩১ ভেঙে দিয়েছিল ২০১৬ এশিয়া কাপে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ১৩৫ ডিফেন্ড করার রেকর্ড। মাঝখানে এক ম্যাচ পর, প্রথম সুযোগেই সেই রেকর্ডকে ১২৭ রানে নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। শেষ ম্যাচে আরও ৫ রান কমে এখন যা ১২২। যে একটা ম্যাচেই বাংলাদেশ হেরেছে, সেটিতে ১০৪ রান করার পরও এক সময় মনে হচ্ছিল, এটাই হয়তো জয়ের জন্য যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হতে পারে।
ব্যাটিং-বোলিংয়েও সিরিজের স্কোর লাইন
মজার ব্যাপারই বলতে হবে, যে সিরিজে বাংলাদেশের ৪-১ ম্যাচে জয়, সেই সিরিজে সর্বোচ্চ রান ও উইকেট দুটিই কি না দুই অস্ট্রেলিয়ানের! ব্যাটিংয়ে মিচেল মার্শ, বোলিংয়ে শেষ ম্যাচে না খেলেও হ্যাজলউড, যদিও তাঁর সঙ্গী হয়েছেন নাছুম আহমেদও। সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যান-বোলারের তালিকায় মার্শ-হ্যাজলউড ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার আর কেউই নেই। তার মানে এখানেও স্কোরলাইন বাংলাদেশ ৪-অস্ট্রেলিয়া ১! কিসের সঙ্গে মেলাচ্ছি, বুঝতে পারছেন আশা করি। সিরিজের রেজাল্ট নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দিতে হবে না।
অভিষেকেই হ্যাটট্রিকে 'প্রথম'
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা এই সিরিজটা ভুলে যেতে পারলেই বাঁচেন। তবে নাথান এলিস তাতে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি অভিষেকে হ্যাটট্রিক করার প্রথম কীর্তি গড়ার পর কিভাবে তা ভুলে যান! যদিও ম্যাচটা না জেতায় সেই এলিসের আনন্দ পরিপূর্ণ রূপ পায়নি। তৃতীয় ম্যাচে হ্যাটট্রিকের পর চতুর্থ ম্যাচে বাদও পড়েছেন দল থেকে। ইনিংসের শেষ তিন বলে তিন উইকেট নিয়ে হ্যাটট্রিক করেছেন ঠিকই, কিন্তু এর আগের ৩.৩ ওভার? তাতেই যে ৩৪ রান দিয়ে ফেলেছেন। তারপরও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট-সংস্কৃতির একটা পরিচয় আছে এখানে। উপমহাদেশের কোনো দলের কোনো বোলার হ্যাটট্রিক করলে, তা যত রান খরুচেই তিনি হন, পরের ম্যাচে কখনোই বাদ পড়তেন না বলেই অনুমান করি।
মোস্তাফিজ-ম্যাজিক
প্রথম দুই ম্যাচেও খারাপ করেননি। প্রথমটিতে ৪ ওভারে ১৬ রান দিয়ে ২ উইকেট, দ্বিতীয়টিতে ২৩ রানে ৩। তবে এই সিরিজের মোস্তাফিজের কথা ভাবলেই চোখে ভেসে ওঠে তৃতীয় ও চতুর্থ ম্যাচে মোস্তাফিজের ওই জাদুকরী বোলিং। তাঁর স্লোয়ার আর কাটারের মায়াজালে জড়িয়ে যেন বিবশ অস্ট্রেলিয়ানরা। দুই ম্যাচেই ৪ ওভারে মাত্র ৯ রান। চতুর্থ ম্যাচে ২ উইকেট, ডট বলের সংখ্যাও বেশি। তারপরও উইকেটের দেখা না পাওয়া তৃতীয় ম্যাচেই মোস্তাফিজ যেন সবচেয়ে ভয়ংকর। ২৪টা বলের কোনোটা থেকে সিঙ্গেলের বেশি নিতে পারেননি অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানরা। এতেও আসলে সবটা বোঝানো যাচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের জলে তোলা মাছের মতো খাবি খাওয়াটা আপনি সংখ্যায় কীভাবে বোঝাবেন!
ক্রিস্টিয়ানের পাঁচ ছক্কা
যে সিরিজে চার-ছক্কা রীতিমতো মহার্ঘ্য, সেটিতেই কি না এক ব্যাটসম্যান এক ওভারে পাঁচটি ছক্কা মেরে বসলেন! ওভারে পাঁচ ছক্কা যে কোনো ম্যাচেই বলার মতো ঘটনা আর এই সিরিজে তো তা রীতিমতো অনাসৃষ্টি। যে অনাসৃষ্টির নায়ক ব্যাটিং অর্ডারে প্রোমোশন পাওয়া ড্যান ক্রিস্টিয়েন। চতুর্থ ম্যাচে মাত্র ১০৪ রান তাড়া করতে অস্ট্রেলিয়ান থিংক ট্যাংক একটা ফাটকাই খেলেছিল তাঁকে নিয়ে। তা কাজে লেগে যায়। পরে ম্যাচের দোদুল্যমান অবস্থায় আরও বড় হয়ে ওঠে ৩০ রানের ওই ওভার।
সাকিবের ‘জোড়া ৩০’
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ওভারের ছয় বলেই ছয় ছক্কাও হয়েছে দুবার। চার-ছয়-এক-দু্ই যেভাবেই হোক, ওভারে ৩০ বা এর বেশি রান ওঠার ঘটনা মোট ১৪টি। ঘটনা ১৪টি, তবে এই বিব্রতকর অভিজ্ঞতা হয়েছে ১৩ জন বোলারের। একমাত্র সাকিব আল হাসানেরই দুবার। বছর দুয়েক আগে জিম্বাবুয়ের রায়ান বার্লও একই যন্ত্রণা দিয়েছিলেন সাকিবকে।
টানা চার ম্যাচে একই দল
চতুর্থ ম্যাচে হেরে যাওয়ার পর শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের একাদশে দুটি পরিবর্তন হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত খেলে গেছে একই একাদশ। কোনো টি-টোয়েন্টি সিরিজে টানা চার ম্যাচে একই দল খেলে যাওয়ার প্রথম উদাহরণটিও বাংলাদেশেরই গড়া।
অস্ট্রেলিয়ার দুঃস্বপ্নের শেষ
এমনিতেই এই সিরিজটা ভুলতে পারত না অস্ট্রেলিয়া, এখন তো আরও পারবে না। রেকর্ড বই প্রতিনিয়তই মনে করিয়ে দেবে সিরিজের শেষ ম্যাচের কথা। মাত্র ৬২ রানে অলআউট হয়ে টি-টোয়েন্টিতে নিজেদের সর্বনিম্ন স্কোর করাই বিব্রত হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। বেরসিক পরিসংখ্যানবিদরা আরও খুঁজে বের করেছেন, কোনো ধরনের ক্রিকেটেই অস্ট্রেলিয়া নামে কোনো দল এর আগে কখনো এত কম ওভারে (১৩.৪) অলআউট হয়নি। ম্যাচশেষে মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে সরাসরি এয়ারপোর্টে গিয়ে দেশে যাওয়ার চার্টার্ড বিমানে চড়ে বসা নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করছিলেন, তা জানতে খুব কৌতূহল হচ্ছে! ঢাকায় নামার সময় তো তাঁদের কল্পনাতেও ছিল না যে, ফিরতি যাত্রাটা এমন হবে।