সাকিব বলিয়া প্রমাণ করিলেন, তিনিও মানুষ...

উৎপলশুভ্রডটকম

১০ আগস্ট ২০২১

সাকিব বলিয়া প্রমাণ করিলেন, তিনিও মানুষ...

সাকিব আল হাসান: আরও একবার। ছবি: বিসিবি

আগের ওভারে পাঁচ ছয় খাওয়ার দুঃস্মৃতি ভুলে পরের ম্যাচেই ৯ রানে ৪ উইকেট। বারবার এমন দুর্দান্ত ফিরে আসা বিস্ময়মিশ্রিত যে প্রশ্ন তুলে দেয় সবার মনে, সাকিব জবাব দিলেন হাসতে হাসতে, ` অবশ্যই আমি মানুষ..।`

এ নিয়ে ঠিক কতবার সাকিব?

আগের ম্যাচটা তাঁকে দিয়েছিল ভুলে যাওয়ার মতো এক অভিজ্ঞতা। ব্যাট হাতে রীতিমতো সংগ্রাম করে তুলেছিলেন ২৬ বলে ১৫। পরে বল হাতে ৪ ওভারে বিলিয়েছেন ৫০ রান, যার মধ্যে ছিল ড্যান ক্রিস্টিয়ানের ব্যাটে এক ওভারেই ৫ ছক্কার মহা আলোচিত ঘটনাও। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে প্রথম বোলার হিসেবে দুই বার ওভারে ৩০ বা এর বেশি রান দেওয়ার বিব্রতকর রেকর্ডেও সাকিবের নাম জড়িয়ে গিয়েছিল আগের ম্যাচেই।

একদিনের ব্যবধানে সেখান থেকেই সাকিব ফিরলেন স্বরূপে। ব্যাট হাতে রান কর‍তে পারেননি এদিনও (২০ বলে ১১), তবে পুষিয়ে দেওয়ার জন্য বল তো ছিল। ৪ ওভার বল করে রান খরচ করলেন মাত্র ৯, সঙ্গে তুললেন ৪ উইকেট। অস্ট্রেলিয়া যে গুটিয়ে গেল নিজেদের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের সর্বনিম্ন রানে, তার মূলে তো সাকিবের বোলিংই।

শুরুর প্রশ্নটা তাই সে কারণেই। অমন অতলে তলিয়ে যাওয়ার পরই ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠার উদাহরণ তো সাকিবের ক্যারিয়ারে অজস্র। সঙ্গে তাই সম্পূরক প্রশ্নও জাগছে, জাগতিক চাপ-তাপের কিছুই যাঁকে ছুঁতে পারছে না, তাঁকে মানুষ ভেবে ভুলই কি করা হচ্ছে?

৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে সাকিবই ধসিয়ে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়াকে। ছবি: বিসিবি

আরও একবার দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন শেষে সাকিবকে দিতে হলো এই প্রশ্নের উত্তরই। হাসতে হাসতে সাকিব জানালেন, তাঁর মানবসত্তা নিয়ে প্রশ্ন নেই৷ নিজের পরিবেশটাই এমন করে গড়ে নিয়েছেন যে, তিনি চাপে পড়েন না কখনোই, 'অবশ্যই আমি মানুষ। অনেকে আক্রান্ত হয়, অনেকে হয় না। আমি হয়তো নিজেকে সেভাবে তৈরি করে নিতে পেরেছি। আমার চারপাশ এমনই যে, এসব (চাপ) আমাকে আক্রান্ত করার সম্ভাবনা অনেক কম থাকে। এদিক থেকে আমি অনেক ভাগ্যবান।’

এ দিনেই গড়লেন নতুন এক রেকর্ডও। টি-টোয়েন্টিতে ১০০ উইকেট নেওয়া মাত্র দ্বিতীয় বোলার তিনি। তবে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ১০০০ রান আর ১০০ উইকেটের ডাবলে সাকিবই প্রথম। ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের আগে মাঠে পুরস্কার বিতরণীতে দাঁড়িয়ে একবার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এসেছেন। সেখানে মজার একটা ঘটনাও ঘটেছে। টিভি ধারাভাষ্যকার আঞ্জুম চোপড়া যখন বললেন, বাংলাদেশের পক্ষে সাকিবের প্রথম ১০০০ রান ও ১০০ উইকেট, সাকিব পাল্টা প্রশ্ন করলেন, 'আর কেউ কি তা করেছে?' 'লাসিথ মালিঙ্গা' জবাব পেয়ে সাকিব বললেন, 'আমার মনে হয় ও ১০০০ রান করেনি।' আঞ্জুম চোপড়া যখন বললেন, তার মানে তো ভালোই রেকর্ডের খোঁজখবর রাখা হয়, সাকিব হেসে বললেন, 'কখনো কখনো তা রাখি বৈকি।'

পরে একই কীর্তি সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অবশ্য কৃতিত্ব ভাগ করে দিলেন সবার মাঝে, 'অবশ্যই ভালো লাগে এরকম কোনো অর্জন যখন হয়। ব্যক্তিগত অর্জনগুলো অবশ্যই অনুপ্রাণিত করে দলের হয়ে ভালো খেলার জন্য। তবে এ যাবৎকালে যত সতীর্থের সঙ্গে খেলেছি, তাদের সাপোর্ট না পেলে এটা কখনোই সম্ভবত হতো না। তাদের সাপোর্ট, কোচিং স্টাফ-দর্শক, সবার সাপোর্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।'

সিরিজে ১১৪ রান আর ৭ উইকেট পেয়ে সিরিজ-সেরার পুরস্কারটাও উঠেছে সাকিবের হাতেই। এ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজে চারবার সিরিজের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতলেন, একমাত্র বিরাট কোহলিই জিতেছেন তাঁর চেয়ে বেশি। তবে নিজের অবদানের চেয়ে জয়টা সাকিবের কাছে দলগত পারফরম্যান্সটাই ধরা দিচ্ছে বড় হয়ে, 'জিম্বাবুয়ে ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুই সিরিজেই আমরা দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলেছি। হ্যাঁ, উইকেট কঠিন ছিল। কিন্তু আমরা স্নায়ু ধরে রেখে দলগত পারফর্ম করেছি।’

ব্যাটিংয়ে খুব বেশি ভালো না করেও সিরিজে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সাকিবের। ছবি: বিসিবি

সাকিবকে উত্তর দিতে হলো একটু আগে শেষ হয়ে যাওয়া ম্যাচ নিয়েও। স্কোরবোর্ডে যখন দাঁড় করানো গেল মাত্র ১২২, তখনও কি আশা ধরে রাখা গিয়েছিল? সাকিব বলছেন, আগের ম্যাচগুলোর অভিজ্ঞতাই তাঁদের সাহায্য করেছে, ‘গত ম্যাচে আমরা ১০৪ রান করলেও ম্যাচ প্রায় শেষ ওভারে চলে গিয়েছিল। আমরা জানতাম, আজ ১২০-১৩০ রান করলেই ম্যাচে টিকে থাকব। ব্যাট হাতে ভালো শুরুর পর মোমেন্টাম ছিল। ব্যাটসম্যানদের জন্য সহজ ছিল না, তবে পুরো সিরিজ জুড়ে বোলাররা দারুণ করেছে।’

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়ের মানেটাও জানতে চাওয়া হয়েছিল সাকিবের কাছে। নামে-ভারে বড় দলগুলো বাংলাদেশে খুব বেশি সফর করে না বলে বাড়তি একটা অনুপ্রেরণার কথাও বললেন সাকিব, ‘যখন বড় বড় দলের সঙ্গে খেলা হয়, বাড়তি একটা অনুপ্রেরণা তো থাকেই। যে দলগুলো সাধারণত আমাদের দেশে খুব বেশি আসে না, তাদের সঙ্গে খেলা হলে তো আরও বেশি। যেহেতু আমাদের জিম্বাবুয়েতে একটা ভালো সিরিজ গেছে, সবাই খুব অনুপ্রাণিত ছিল যে এই সিরিজটাও আমাদের ভালো করতে হবে। যেহেতু আমরা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কখনো সিরিজ জিতিনি এবং এটা একটা সুযোগ ছিল, তাই আমরা সবাই চেয়েছিলাম যেন দলগতভাবে ভালো করতে পারি। সেটাই হয়েছে।’

অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে এমন একটা সাফল্য এসেছে তামিম-মুশফিক-লিটনকে ছাড়াই। এটাকেও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে সাকিবের। নতুন কয়েকজন ক্রিকেটার পারফর্ম করে নজর কেড়েছেন বলে দলের মধ্যে সুস্থ একটা প্রতিযোগিতাও গড়ে উঠেছে বলেও জানালেন। বড় দল হয়ে ওঠার জন্য যে প্রতিযোগিতা থাকাটা খুব জরুরি বলেই মনে হয় তাঁর।

পারফরম্যান্সের এমন প্রতিযোগিতা যদি আগামী সিরিজগুলোতেও অব্যাহত থাকে, সাকিবের মতো আরও কয়েকজন 'মানুষ নামের অতিমানুষ' হয়তো বেরিয়ে আসবে এই সুযোগেই।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×