সৌম্য খেলবেন, সৌম্য খেলবেন না
উৎপল শুভ্র
৯ আগস্ট ২০২১
প্রথম চার ম্যাচে ১২ রান। এরপরও কি সৌম্য সরকার সিরিজের শেষ ম্যাচে খেলবেন, নাকি খেলবেন না? না খেলার পক্ষে তো সহজ যুক্তি, খেলার পক্ষেও কি কোনো যুক্তি আছে তেমন!
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অভিষেকে কোনো বল খেলার আগেই রান আউট হয়ে গিয়েছিলেন সৌম্য সরকার। ভুতুড়ে আউট...সৌম্যর টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের দিকে ফিরে তাকালে সেটিকেও একই রকম ভুতুড়ে মনে হয়।
এমনিতে তাঁর ব্যাটিংটা যেন টি-টোয়েন্টির জন্য অর্ডার দিয়ে বানানো। স্ট্রোক খেলতে ভালোবাসেন, স্ট্রোক খেলতেও পারেন...বাংলাদেশের এই দলে অনায়াস ছক্কা মারার সামর্থ্যের কথা বললে তাঁর নামটাই হয়তো প্রথমে আসবে। প্রমাণ আছে পরিসংখ্যানেও। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই সিরিজের চার ম্যাচে রীতিমতো দুঃস্বপ্নের পরও যা বলছে, টি-টোয়েন্টিতে ৬০ ইনিংসে ৪২টি ছক্কা মেরেছেন সৌম্য। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তাঁর চেয়ে বেশি ছক্কা শুধু মাহমুদউল্লাহর। তবে তা শুধু সংখ্যার হিসাবেই। নইলে সৌম্যর চেয়ে ৮টি ছক্কা বেশি মারতে মাহমুদউল্লাহকে তো খেলতে হয়েছে ২৮ ইনিংস বেশি।
বাকিদের হিসাবটা জানতে যদি আপনার কৌতূহল হয়, সেটিও দিয়ে দিচ্ছি। তামিম ইকবাল: ৭৮ ইনিংসে ৪৫টি ছক্কা, সাকিব আল হাসান: ৮২ ইনিংসে ৩৫, মুশফিকুর রহিম ৭৭ ইনিংসে ৩৩। ছক্কার সঙ্গে যদি চার-ও যোগ করে নেন, বাউন্ডারিতে সবচেয়ে বেশি রানও সম্ভবত সৌম্যরই হবে। ৪২টি ছক্কার সঙ্গে ১০৮টি চার। মোট রানের ৬৩.৮০ শতাংশই সীমানা পেরোনো শট থেকে।
২, ০, ২, ৮
সংখ্যাগুলো কীসের, তা কি আপনি বুঝে ফেলেছেন? সেই সম্ভাবনাই বেশি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই সিরিজের চার ম্যাচে সৌম্যর রান নিয়ে কম রসিকতা তো আর হয়নি। তিন ম্যাচ পরই যেটির শুরু। চতুর্থ ম্যাচের আগে এক সাংবাদিক মজা করে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন, আজ ১ রান করলে এখন যে ‘২০২১’ সাল চলছে, এটা সবাইকে মনে করিয়ে দেবেন সৌম্য। ৭ রান বেশি করে ফেলার পর কোথায় যেন দেখলাম, চার ম্যাচের রান পাশাপাশি রেখে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ যে ২০২৮ সালে বিশ্বকাপ জিতবে, সৌম্যর এই স্কোরগুলোতে সেই ঘোষণা।
এসব রসিকতা সৌম্যর ভালো লাগার কোনো কারণ নেই। ধারাবাহিকতার অভাব তাঁর অনেক পুরোনো সমস্যা। এই চার ম্যাচে যদিও অন্য অর্থে ধারাবাহিক। সাফল্যকে ধারাবাহিকতার মানদন্ড ধরলে ব্যর্থতারও তো ধারাবাহিকতা থাকতে পারে। সেই ‘ধারাবাহিকতা’র দিক থেকেও সৌম্য ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকে। ক্যারিয়ারে এই প্রথম টানা চার ম্যাচে এক অঙ্কের রান। পঞ্চম ম্যাচে এটি ‘টানা পাঁচ’ বানিয়ে ফেলবেন, না এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসবেন, এটাই এখন বড় প্রশ্ন। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, সৌম্য কি আজ খেলবেন?
৬৮, ৮, ৫০, ১০, ৫১, ৫, ২০*, ৬২*
এই সংখ্যাগুলো কীসের, এটাও কি আপনি বুঝে ফেলেছেন? তা হলে তো ভালোই। না বুঝে থাকলে বলে দিই, এই সিরিজের আগে টি-টোয়েন্টিতে ৮ ইনিংসে সৌম্যর রান। টি-টোয়েন্টিতে তাঁর ৫টি হাফ সেঞ্চুরির ৪টিই এই সময়ে। যার ৩টিই বাংলাদেশকে ম্যাচ জিতিয়েছে। ম্যাচ-সেরার ট্রফি হাতে নেওয়ার মাধ্যমে সেই স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো যখন তাঁকে রান করায় ধারাবাহিক বলে মনে হচ্ছে, তখনই সৌম্য উল্টো ডুবে গেছেন ব্যর্থতার ধারাবাহিকতায়। তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তাঁকে কি আরেকটি সুযোগ দেওয়া উচিত, নাকি ‘অনেক হয়েছে’ সিদ্ধান্ত নিয়ে আজ সৌম্যকে বাদ দেওয়াই উচিত?
সৌম্য খেলবেন, সৌম্য খেলবেন না
এই সিরিজটাকে যদি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ধরা হয়, উইকেটের কারণে সেই প্রস্তুতি কতটা হচ্ছে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। রান করা এই সিরিজে সবচেয়ে কঠিন কাজ। তা দুই দলের ব্যাটসম্যানদের জন্যই। তবে শুনতে একটু অদ্ভুতই শোনাবে, সৌম্যর সমস্যাটা অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের সমস্যার সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। বল ভালোভাবে ব্যাটে আসে, এমন শক্ত উইকেটেই সৌম্যর ব্যাটিং সব পাপড়ি মেলে ফুল হয়ে ফোটে। যেখানে এই উইকেট ইচ্ছামতো স্ট্রোক খেলে রান করার নয় (ড্যান ক্রিস্টিয়ান আর সাকিব প্রসঙ্গ তুলবেন না, ওটা ব্যতিক্রম), এখানে রান করতে হবে খেটেখুটে, জায়গামতো বল পেয়ে তবেই চার-ছয়। সৌম্যর ব্যাটসম্যানশিপে এই আরেকটা মাত্রা যোগ করা খুব জরুরি। তাহলেই শুধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভালো ব্যাটসম্যানের স্বীকৃতি পেতে উইকেটের চরিত্র অনুযায়ী খেলাটা একটু বদলে ফেলার ক্ষমতা তো থাকতেই হবে।
পঞ্চম ম্যাচের উইকেটও প্রথম চার ম্যাচের মতোই হবে ধরে নিয়েই লেখাটা লিখছি। তাই যদি হয়, তাহলে তো আজ সৌম্যকে বাইরে রাখাই ভালো, এটাই কি মনে হচ্ছে আপনার? সহজ হিসাব এমনই বলে। কিন্তু আমি সৌম্যকে খেলানোর পক্ষে। প্রথম কারণ, সিরিজ তো জেতা হয়েই গেছে, এই ম্যাচে জয়-পরাজয়ে তাই খুব বেশি কিছু আসে যায় না। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিশ্চিত, এমন খেলোয়াড়দের তাই যত বেশি সম্ভব সুযোগ দেওয়া উচিত। বাংলাদেশ দলের বিকল্প কোনো ওপেনার নেই বলে সৌম্যর বদলে অন্য কাউকে সুযোগ দিলে তিনি হবেন মেক-শিফট ওপেনার। দীর্ঘ মেয়াদে যেটির কোনো সুফল নেই। তাহলে সৌম্যই খেলুন না আরেকটা ম্যাচ!
টানা চার ব্যর্থতার পরও সৌম্যকে দলে দেখতে চাওয়ায় যদি বিস্মিত হয়ে থাকেন, তা চাওয়ার কারণও ওই টানা চার ব্যর্থতা। যেহেতু সিরিজের জয়-পরাজয় এখন মীমাংসিত রহস্য, টানা চার ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সৌম্য আজ কীভাবে ব্যাটিং করেন, তা দেখতে যে খুব কৌতূহল হচ্ছে। এমনিতেই সৌম্যর ব্যাটিংয়ের সময় চোখ ফেরানো যায় না (অবশ্যই যখন রান করেন), এই বাড়তি কৌতূহল যোগ হওয়ায় আজ আরও বেশি অপেক্ষায় আছি সৌম্যকে দেখতে।
তাহলে সিদ্ধান্ত কী? সৌম্য কি খেলবেন, নাকি খেলবেন না?
এটা তো আর আমার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে না। যদি করত, তাহলে সেই সিদ্ধান্ত কী হতো, তা তো বলেই দিয়েছি।