আবারও যে বলতে ইচ্ছা করছে, `ক্রিকেট, লাভলি ক্রিকেট`!
উৎপল শুভ্র
৮ আগস্ট ২০২১
টি-টোয়েন্টিতে চার-ছক্কা যেখানে মুড়িমুড়কির রূপ নেয়, রানের ফোয়ারা নথিবদ্ধ রাখতে নাভিশ্বাস ওঠে যায় স্কোরারের, সেখানে এই সিরিজে ‘রান’ বস্তুটা যেন হীরা-জহরতের মতোই দামি। স্বাভাবিক টি-টোয়েন্টির নিয়মরীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে চলেছে। ‘ক্রিকেট, লাভলি ক্রিকেট’ কথাটাও তাই বলতে ইচ্ছা করছে আবারও।
এই টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচ নিয়ে লেখাটা যদি পড়ে থাকেন, আশা করি হেডিংটাও আপনার মনে আছে। কথাটা এমন সুন্দর যে, তা ভোলার কথা নয়। ক্রিকেট, লাভলি ক্রিকেট! কেন মনে হয়েছিল এমন? বলের ওপর ব্যাটের দৌরাত্ম্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত দুই চোখ ব্যাট-বলের তীব্র লড়াই দেখে বড়ই প্রীত হওয়াতে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যা বেরিয়ে এসেছিল। এটাও অবশ্য মেনে নেওয়া উচিত বলে মনে হচ্ছে যে, মাত্র ১৩১ রান করেই বাংলাদেশের জয় কিছুটা হলেও ভূমিকা তো রেখেছিলই ক্রিকেটকে অমন ‘লাভলি’ মনে করানোয়।
তখন কে জানত, চার ম্যাচ পরও এই ১৩১-ই সিরিজের সর্বোচ্চ রান হয়ে থাকবে! দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথমে ব্যাটিং করা দল করবে আরও ১০ রান কম। তৃতীয় ম্যাচেও তা থাকবে ৪ রান দূরত্বে। টি-টোয়েন্টিতে চার-ছক্কা যেখানে মুড়িমুড়কির রূপ নেয়, রানের ফোয়ারা নথিবদ্ধ রাখতে নাভিশ্বাস ওঠে যায় স্কোরারের, সেখানে এই সিরিজে ‘রান’ বস্তুটা যেন হীরা-জহরতের মতোই দামি। ‘ক্রিকেট, লাভলি ক্রিকেট’ কথাটা তাই আবারও বলতে ইচ্ছা করছে। হাই স্কোরিং টি-টোয়েন্টি অনেক দেখেছি, সামনে আরও অনেকই দেখতে হবে; একটা সিরিজ তার ব্যতিক্রমই হোক না কেন! স্বাদ বদলেরও দরকার আছে। অতি ভোজনে অমৃতেও যেখানে অরুচি ধরে যায়; ম্যাচের পর ম্যাচে ব্যাটের গদা হয়ে যাওয়া আর ক্রিকেটের বেসবলে রূপ নেওয়া দেখতে কাহাতক আর ভালো লাগে! আপনার কেমন লাগছে জানি না, তবে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সিরিজটা আমি খুব এনজয় করছি।
এমনকি সিরিজে বাংলাদেশকে প্রথম পরাজয়ের হতাশায় ডোবানো ম্যাচটা ভাবতে গিয়েও ওই 'এনজয়' শব্দটা চলে আসছে। সোয়েপসনের লেগ স্পিন-জাদুতে বাংলাদেশ মাত্র ১০৪ রানে আটকে যাওয়ার পরও তো তাতে কত নাটক! চতুর্থ ওভারে ড্যান ক্রিস্টিয়ানের ওই প্রলয় নাচনের পর অস্ট্রেলিয়া ১ উইকেটে ৪৫। এই ম্যাচের আগে টানা আটটি ম্যাচে চেজ করতে গিয়ে ব্যর্থ অস্ট্রেলিয়ানরা ইনিংসের এক পঞ্চমাংশ শেষেই তো প্রায় অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে...এটা একেবারেই একতরফা একটা ম্যাচ না হয়ে যায়ই না!
এখান থেকে এক লাফে যদি ৬.২ ওভার এগিয়ে যাই, আবারও ‘ক্রিকেট, লাভলি ক্রিকেট’ কথাটা মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসতে বাধ্য। অস্ট্রেলিয়ার স্কোর ৬ উইকেটে ৬৫, স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানদের সবাই ততক্ষণে অতীতকালে রূপান্তরিত। প্রথম ম্যাচে সবচেয়ে কম রান ডিফেন্ড করার নতুন রেকর্ড গড়ে প্রথম সুযোগেই আবার তা ভেঙে ফেলেছে বাংলাদেশ আগের দিন। অস্ট্রেলিয়ার জয়খরা কাটানোর চেয়ে আবারও তা ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনাই তো তখন বেশি বলে মনে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি, এটার মূল কারণ তো অবশ্যই দুই ‘অ্যাস্টন’ –অ্যাগার ও টার্নারের ৩৪ রানের জুটি। এমনিতে টি-টোয়েন্টিতে ৩৪ রানের জুটি বলার মতো কোনো ব্যাপারই নয়, কিন্তু এই সিরিজ তো আর দশটা টি-টোয়েন্টি সিরিজের মতো নয়। ৩৪ রানের জুটিই এখানে ‘কী একটা দারুণ পার্টনারশিপই না হয়েছে’ ভেবে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার উপলক্ষ।
এমনিতে ১০৪ রান করার পর কোনো দলের জয়ের আশা করাটাও যেমন অস্বাভাবিক। একই রকম অস্বাভাবিক হারার পর বোলিং বা অধিনায়কত্ব নিয়ে কোনো ময়না তদন্তের প্রয়োজন দেখা দেওয়া। কিন্তু ওই যে বললাম, এই সিরিজে যা হচ্ছে, তা স্বাভাবিক টি-টোয়েন্টির নিয়মনীতিকে নিত্য বুড়ো আঙুল দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়। যে কারণে ব্যাটিংয়েই হেরে বসা ম্যাচেও প্রশ্ন উঠছে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে। ৬ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার যখন ২৩ রান চাই, হাতে ‘অফুরন্ত’ বল, ম্যাচে বাংলাদেশের একমাত্র আশা তো উইকেট তুলে নেওয়ায়। স্বাভাবিক ক্রিকেট বুদ্ধিতে যেকোনো অধিনায়কই তখন তাঁর তুরুপের তাসটা খেলবেন। প্রথম দুই ওভারে মাত্র ২ রান দিয়ে ২ উইকেট তুলে নেওয়া বোলারের হাতে বল দিয়ে বলবেন, ‘শুধু রান আটকালেই হবে না, আমার উইকেট চাই’। একটা উইকেট বেশির ভাগ সময়ই তো আরেকটা উইকেটের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। তা যদি না-ও হতো, ওই ওভারে একটা উইকেট এই জবুথবু, ভীত-সন্ত্রস্ত অস্ট্রেলিয়ার টেল এন্ডারদের মনে নিশ্চিতভাবেই বইয়ে দিত ভয়ের একটা শীতল স্রোত।
কিন্তু কী ভেবে যে মোস্তাফিজকে না ডেকে মাহমুদউল্লাহ নিজেই সেই ওভারটি করার সিদ্ধান্ত নিলেন, অনেক ভেবেও এর মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। মাত্র ৩ রানই দিয়েছেন, যাতে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের সমীকরণ দাঁড়িয়েছে ৫ ওভারে ২০ রান। পরের ওভারেও বোলারের নাম মোস্তাফিজ নন, এক ওভারেই ৩০ রান দিয়ে ফেলা বাঁহাতি স্পিনার। ম্যাচ শুরুর সময় যাঁর সামনে ছিল বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে এক শ উইকেট নেওয়ার মাইলফলক ছোঁয়ার হাতছানি, ম্যাচশেষে তাঁর নামের পাশে কিনা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে একমাত্র বোলার হিসেবে ্ দুবার এক ওভারে ৩০ বা এর বেশি রান দেওয়ার অগৌরবের রেকর্ড। নামটা আপনি জানেন।
শেষ পর্যন্ত মোস্তাফিজ যখন বল হাতে পেলেন, তখন বাংলাদেশকে জিততে অলৌকিক কিছু ঘটতে হতো। ৪ ওভারে দরকার ১০ রান। শেষ দুই ম্যাচের মোস্তাফিজ অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের এমনই মায়াজালে বেঁধেছেন যে, এই চার ওভারই যদি তিনি করতে পারতেন, কে জানে, অস্ট্রেলিয়ার হয়তো আর জয় পাওয়া হয় না। কিন্তু ক্রিকেটে তো এমন নিয়ম নেই। অস্ট্রেলিয়া তাই এক ওভার বাকি থাকতেই মহা কাঙ্ক্ষিত এক জয়ের বন্দরে। এর আগে বাংলাদেশের ইনিংসে আফিফ হোসেনের আউট হওয়ার মাধ্যমে ৭৮ রানে ষষ্ঠ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর অদৃষ্টপূর্ব এক ঘটনা ঘটেছে। ম্যাথু ওয়েডকে হাসতে দেখা গেছে। অদৃষ্টপূর্ব যেহেতু বলাই হয়েছে, এই সিরিজে সহাস্য ওয়েড দর্শন যে এই প্রথম–তা তো বলার প্রয়োজন পড়ছে না। ম্যাচ জয়ের পর মাঠের পাশে বসে থাকা অস্ট্রেলিয়ানদের ধরল ক্যামেরা। ম্যাথু ্ওয়েডের মুখে এবারের হাসিটা যেন বিশ্বকাপ জয়ের।
সিরিজ শুরুর আগে যদি কেউ এমন বলতেন, তাহলে তাঁকে কেমন নিগ্রহের শিকার হতে হতো, একবার ভাবুন তো! বাংলাদেশের বিপক্ষে একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ জেতার পর অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কের হাসি দেখে মনে হচ্ছে, তিনি বিশ্ব জয় করে ফেলেছেন–এমন অভাবনীয় ঘটনার জন্ম দেয় যে সিরিজ, সেই সিরিজকে আপনি আর দশটা সিরিজের সঙ্গে কিভাবে মেলাবেন!
ক্রিকেট, লাভলি ক্রিকেট!