ক্রিকেট, লাভলি ক্রিকেট!

উৎপল শুভ্র

৪ আগস্ট ২০২১

ক্রিকেট, লাভলি ক্রিকেট!

অনেক দিন পর আজ আবার বাংলাদেশের কোনো জয়ের আগে ‘ঐতিহাসিক’ শব্দটা বসিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। নতুন ইতিহাস হলে সেটিকে তো ঐতিহাসিকই বলা উচিত। তা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের প্রথম জয় নতুন ইতিহাস নয় তো কি!

একটা সময় ছিল, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বেশির ভাগ জয়ের আগেই ‘ঐতিহাসিক’ শব্দটা জুড়ে দেওয়া হতো। একেকটা জয় যে আসত মাঝখানে অন্তহীন মনে হওয়া অপেক্ষার পর। অনেক সময় রসিকতা করে আমরা যেটিকে ‘হ্যালির ধুমকেতু’র সঙ্গে তুলনা করতাম।

অনেক দিন পর আজ আবার বাংলাদেশের কোনো জয়ের আগে ‘ঐতিহাসিক’ শব্দটা বসিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। নতুন ইতিহাস হলে সেটিকে তো ঐতিহাসিকই বলা উচিত। তা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের প্রথম জয় নতুন ইতিহাস নয় তো কি!

মিরপুরের এই জয় মনে করিয়ে দিচ্ছে কার্ডিফের স্মৃতিও। ২০০৫ সালের ওই পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আশরাফুলের সেঞ্চুরিধন্য বাংলাদেশের ওই জয় তুলনায় অনেক বেশি অভাবনীয় ছিল। তখন তো অস্ট্রেলিয়া জিতবে ধরে নিয়েই অন্য দলগুলো তাদের বিপক্ষে খেলতে নামত। আর বাংলাদেশ ‘বড়’ দলগুলোর বিপক্ষে খেলতে নামত হারবে ধরে নিয়ে। 

তারপরও মিরপুরে এই খর্বশক্তির অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আজকের জয় কেন কার্ডিফের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে? এর কারণও কার্ডিফ। ২০১৭ সালে এই মিরপুরেই বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে হারিয়েছে। সেই জয়কেও ‘ঐতিহাসিক’-ই বলতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট (এখন পর্যন্ত সর্বশেষও) বলে কথা। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সাদা বলের ক্রিকেটে এতদিন ওই কার্ডিফই হয়ে ছিল বাংলাদেশের সর্বশেষ সুখস্মৃতি। ১৬ বছর কেটে গেছে এরপর, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ১৮টি ম্যাচ...জয়ের দেখা পায়নি বাংলাদেশ। যে একটি মাত্র ম্যাচেই পরাজয় এড়ানো গেছে, তা পুরোপুরিই বৃষ্টির আশীর্বাদ। শুধু টি-টোয়েন্টিতে প্রথম বলেই নয়, এ কারণেও এই জয়টা বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘বিশেষ’ হয়ে থাকবে।

ম্যাচশেষে বাংলাদেশ দলকে অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়দের অভিনন্দন। ছবি: বিসিবি

খর্বশক্তির অস্ট্রেলিয়া বলছিলাম, এই সিরিজে বাংলাদেশের শক্তিও তো রীতিমতো খর্ব। ইন্টারেস্টিং হলো, অস্ট্রেলিয়ার মতো বাংলাদেশেরও ঝড়ঝাপটা যে গেছে, তার পুরোটাই ব্যাটিংয়ের ওপর দিয়ে। অস্ট্রেলিয়া দলে যেমন অ্যারন ফিঞ্চ, স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল নেই; বাংলাদেশ দলেও নেই তামিম ইকবাল, লিটন দাস ও মুশফিকুর রহিম। এই সিরিজে দুই দলই পূর্ণ শক্তির বোলিং নিয়ে নেমেছে। লো স্কোরিং প্রথম ম্যাচটা এখানেই দেখা দিচ্ছে প্রতীকি হয়ে। 

৪০ ওভারে রান হয়েছে ২৩৯, উইকেট পড়েছে ১৭টি...আদর্শ টি-টোয়েন্টি বলতে যা বোঝায়, এটা মোটেই তা নয়। এই 'আদর্শ' শব্দটাতেই আমার আপত্তি। আদর্শ টি-টোয়েন্টি মানেই যেন তাতে চার-ছক্কার ঝড় উঠবে, বয়ে যাবে রানবন্যা, বোলাররা হতাশায় ডুবে যেতে যেতে 'কোন পাপে ব্যাটসম্যান হলাম না' আক্ষেপ করবে। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, হাই স্কোরিং ম্যাচের উত্তেজনার পুরোটাই জমা থাকে শেষ অঙ্কের জন্য। বাকি ম্যাচে সেভাবে তা খুঁজেই পাওয়া যায় না। ব্যাট আর বলের যে লড়াইটা ক্রিকেটের প্রাণভোমরা, সেটিই যে তাতে 'লাশ' হয়ে থাকে।

এর ব্যতিক্রম হয়েছে বলেই আজকের ম্যাচটা আমি খুব এনজয় করেছি। বাংলাদেশ জিতেছে, এটাই কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। একটু আগে যা বললাম, সেটাই তাহলে অন্য ভাষায় বলি। সব সময় বলের ওপর ব্যাটের চরম আধিপত্য দেখতে দেখতে আধুনিক ক্রিকেটকে অনেক সময়ই যেখানে বেসবল বলে মনে হয়, সেখানে কখনো কখনো বোলারদের রাজত্ব দেখতে বড় ভালো লাগে। এটা যদি একটা কারণ হয়, সম্ভবত এর চেয়েও বড় কারণ, স্মরণীয় ম্যাচের সব উপাদানই এটি ছিল। শুধু চার আর ছক্কার বন্যাই যেটির নিশ্চয়তা নয়, লো স্কোরিং ম্যাচ স্মরণীয় হয়ে থাকে অনিশ্চয়তার জন্য, ইনটেনসিটির জন্য। অস্ট্রেলিয়া প্রথম তিন ওভারের মধ্যেই ১১ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলার পরও ইনিংসের ১৫/১৬ ওভার পর্যন্ত ফলাফল নিয়ে অনিশ্চয়তা কিন্তু ছিলই।

৩৬ রান করেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোরার সাকিব আল হাসান। ছবি: বিসিবি

খেলার সবচেয়ে বড় মজা অভাবিত কিছু ঘটতে দেখা। মাত্র ১৩১ রান করেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়কে অভাবিত বলবেন না? এই অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইন আপে যতই বড় নামের অনুপস্থিতি থাকুক, দলটার নাম তো অস্ট্রেলিয়া। ১৩২ রানের টার্গেট তাদের জন্য কোনো ব্যাপার নাকি! এটাই অনেক বড় ব্যাপার থেকে অনর্জনযোগ্য হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের গেম প্ল্যানের বড় ভূমিকা। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের বদলে শেখ মাহেদী হাসানকে দলে নেওয়া থেকেই যার কিছুটা আঁচ পাওয়া গিয়েছিল। তবে বাংলাদেশ নিজেদের মাটিতে এমন স্পিন-ভারি দল নিয়ে তো আগেও নেমেছে। শুরুতেই টানা পাঁচ ওভার স্পিনারদের দিয়ে বল করাতে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। চিন্তাটা যাঁর মাথা থেকেই এসে থাকুক, এখন তো তা রীতিমতো মাস্টার স্ট্রোক বলে প্রমাণিত।

যদি তা এমন ফলপ্রসূ না-ও হতো, তাহলে হয়তো এটিকে মাস্টার স্ট্রোক বলা যেত না, তবে অবশ্যই অভিনব বলে সাধুবাদ জানাতেই হতো। কাগজে-কলমে ফেবারিট কোনো দলের বিপক্ষে জিততে হলে এমন 'আউট অব দ্য বক্স' কিছু ভাবাটা খুব জরুরি। এটা মানছি, প্রথম তিন ওভারেই তিন স্পিনার উইকেট পেয়ে না গেলে হয়তো অস্ট্রেলিয়াকে শুরুতেই টানা স্পিন-পরীক্ষার সামনে পড়তে হতো না।

এমনিতে ম্যাচটার দিকে যদি আবার ফিরে তাকান, বিশেষ করে দুই দলের ব্যাটিংয়ের দিকে, এটা ছিল ভুলে ভরা এক ম্যাচ। দুই দলেরই বেশ কয়েকজন ব্যাটসম্যান অদ্ভুতভাবে আউট হয়েছেন, যেটির ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে অ্যাস্টন অ্যাগারের হিট উইকেট হওয়ায়। ক্রিকেটে বেশির ভাগ আউটেই বোলারের কৃতিত্বের চেয়ে ব্যাটসম্যানের ভুলের বড় ভূমিকা থাকে। টি-টোয়েন্টিতে তো আরও বেশি। তবে আজ হয়তো তা একটু সীমা ছাড়িয়েই গেছে। ম্যাচসেরা নাসুম আহমেদের চার উইকেটের মধ্যেই দুটিই যেমন ভাগ্যপ্রসূত।

সব ম্যাচেই যে দল কম ভুল করে, তাদেরই জয় হয়। লো স্কোরিং ম্যাচের ক্ষেত্রে যা আরও বেশি সত্যি। শেষ পর্যন্ত ম্যাচের নির্ধারক হয়ে গেছে ফিল্ডিংয়ের সময় বাংলাদেশের প্রায় কোনো ভুলই না করা। কম রান করার পরও ম্যাচ জয়ের প্রধান শর্তই তো এটা, সুযোগ এলেই তা লুফে নিতে হবে। বাংলাদেশ ক্যাচের মাধ্যমে তা নিয়েছে, সোহানের দারুণ দুটি স্টাম্পিংয়ের মাধ্যমে, বড় ভূমিকা রেখেছে শুরুতেই ৩ উইকেট পেয়ে যাওয়াও। কম স্কোরকে ডিফেন্ড করার পূর্বশর্তই তো শুরুতে উইকেট তুলে নেওয়া।

জয়টাকে ঐতিহাসিক বলে লেখাটা শুরু করেছিলাম। তা শুধু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে প্রথম জয় বলেই। এটা ভুলে গিয়েও যদি ম্যাচটার দিকে তাকান...এ এমন এক চিত্রনাট্য, ম্যাচের আগে বললে যেটিকে অনেকটাই অবাস্তব বলে মনে হতো। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ১৩১ রান করার পর ফিল্ডিংয়ে নেমে পরপর তিনজন বোলার বোলিং করতে এসেই উইকেট তুলে নিচ্ছেন, শেষ পর্যন্ত জয় আসছে অস্ট্রেলিয়াকে অলআউট করে...এটা ভাবায় একটু কল্পনাবিলাসী মনের প্রমাণ মেলে না? 

তারপরও ক্রিকেট বলেই কোনো কোনো দিন এমন হয়ে যায়। যখন নিছকই একটা টি-টোয়েন্টি দেখার পরও বলতে ইচ্ছা করে: ক্রিকেট, লাভলি ক্রিকেট!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×