বাংলাদেশ হারিয়া প্রমাণ করিল...
উৎপল শুভ্র
২৪ জুলাই ২০২১
টি-টোয়েন্টি সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে হারিয়া বাংলাদেশও প্রমাণ করিল যে, জিম্বাবুয়ে একেবারে খারাপ দল নয়। তাহারাও জিতিতে পারে। টেস্ট ম্যাচের পর ওয়ানডে সিরিজ, ওয়ানডে সিরিজের পর প্রথম টি-টোয়েন্টি...বাংলাদেশ জিতেই যাচ্ছিল। সেই জয়রথ থামল সাড়ে পাঁচ বছর পর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে পরাজয়ে।
রবীন্দ্রনাথের গল্পে কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিয়াছিল যে, সে মরে নাই। টি-টোয়েন্টি সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে হারিয়া বাংলাদেশও প্রমাণ করিল যে, জিম্বাবুয়ে একেবারে খারাপ দল নয়। তাহারাও জিতিতে পারে।
'জীবিত ও মৃত' গল্পে যেমন অতিপ্রাকৃত ব্যাপার-স্যাপার ছিল, হারারের এই ম্যাচেও তা-ই। সে কথায় পরে আসি।
একমাত্র টেস্ট ম্যাচের পর ওয়ানডে সিরিজের তিন ম্যাচ শেষে ৪-০ হয়েছিল। এরপর প্রথম টি-টোয়েন্টিতে সহজ জয় স্কোরলাইন শুধু ৫-০-ই করেনি, দুই দলের খেলার ধরন দেখে মনে হয়েছিল, পরের দুই ম্যাচে বাঁয়ের সংখ্যাটা এক-এক করে দুই বাড়বে, ডানে বোধ হয় শূন্যই থাকবে।
বাংলাদেশ দলও এমনই ভেবে নিয়েছিল কি না, এই প্রশ্ন মনে জাগছেই। আমি-আপনি ভাবতেই পারি, কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো দল এমন ভেবে নিলেই মহাবিপদ! সেই ‘মহাবিপদ’টা কী, এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে ২৩ রানের পরাজয়। যে কারণে টি-টোয়েন্টি সিরিজ এখন ১-১। আগামী রোববারের শেষ ম্যাচটা আর নিছকই আনুষ্ঠানিকতা নয়, সিরিজ জয়ের লড়াই।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে খুশি হওয়ার মতোই ব্যাপার। কিন্তু এখানে ‘নিরপেক্ষ’ থাকার সুযোগ কই! পরাজয়ে-পরাজয়ে প্রতিপক্ষ যখন বিপর্যস্ত, তখন কেন তাদেরকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া? বাংলাদেশ তো সেটাই দিল।
তা খেলায় তো এমন হতেই পারে। সব কিছু পূর্ব অনুমিত পথে চললে তো খেলার মূল আকর্ষণটাই হারিয়ে যায়। এসবই খুব ভালো ভালো কথা। সত্যিও বটে। তবে পরাজয়ের পর কি আর তা ভেবে বসে থাকলে চলে? ময়না তদন্তের একটা আবশ্যিকতা থেকেই যায়। তা কোথায় হারল বাংলাদেশ?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে ম্যাচটা কি একটু আবার পাখির চোখে দেখে নেব? মনে করিয়ে দেব স্কোরকার্ডটা? জিম্বাবুয়ের ব্যাটিংয়ে বলার মতো একটাই ইনিংস। ওয়েসলি মাধেভেরের ৫৭ বলে ৭৩। ম্যাচসেরার পুরস্কারটাও তাঁর হাতেই উঠেছে। মাধেভেরে ওই ইনিংসটা না খেললে জিম্বাবুয়ে ১৬৬ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর করতে পারে না। কথাটা অবশ্য গৎবাঁধা হয়ে গেল। মাধেভেরেকে সবার ওপরে রেখে আবার যদি স্কোরকার্ডটা দেখেন,পরিষ্কার বুঝতে পারবেন পার্থক্যটা আসলে গড়ে দিয়েছে রায়ান বার্লের ১৯ বলে ৩৪ রানের ইনিংসটি।
তারপরও ম্যাচে সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসটা কিন্তু বার্ল খেলেননি। খেলেছেন এই ম্যাচেই অভিষিক্ত এক তরুণ। রানসংখ্যায় ৫ কম, কিন্তু স্ট্রাইক রেটে বার্লের চেয়ে প্রায় ৪৫ বেশি। সমস্যা হলো, বার্লের ইনিংসটিকে অর্থবহ করে তুলতে একজন মাধেভেরে ছিলেন। কিন্তু শামীম হোসেন এমন কাউকে পাননি। তাঁর ১৩ বলে ২৯ রানের ইনিংসটি তাই মরণ কামড়ের বেশি কিছু হতে পারেনি। প্রায় ডুবে যাওয়া জাহাজ (নামার সময়ই তো ৬ উইকেটে ৬৮) কূলে ভেড়াতে এই ভয়ডরহীন ব্যাটিং আরও অন্তত দশ-বারো বল স্থায়ী হতে হতো। তা হয়নি ভুতুড়ে এই দিন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য অবাক এক পাণ্ডুলিপি লিখে রাখায়।
ম্যাচের সময়ই চোখে লাগছিল। ম্যাচ শেষে বাংলাদেশের ইনিংসের হাইলাইটস্ দেখার সময় যা আরও বেশি। একটু ভুতুড়েও লাগল। একের পর এক ব্যাটসম্যান যেভাবে সোজা ফিল্ডারের হাতে বল তুলে দিয়ে আউট হলেন, তাতে মনে হলো, কোনো ম্যাচ নয়, হাই ক্যাচিং প্র্যাকটিস সেশনের কোনো ভিডিও ক্লিপিংস্ দেখছি। ক্যাচিং প্র্যাকটিসের সময়ও ফিল্ডারদের একটু দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। এখানে তো তা-ও করতে হলো না। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা অবিশ্বাস্য দক্ষতায় সরাসরি ফিল্ডারের হাতেই বল পাঠিয়ে দিলেন। বেশির ভাগ সময়ই তো একটু নড়াচড়া পর্যন্ত করতে হলো না।
দুর্ভাগ্য বলতে পারেন, ব্যাটসম্যানদের দুষতেও পারেন, তবে এক ম্যাচে এতবার এমন হতে কিন্তু কমই দেখা যায়। আর বাংলাদেশের ইনিংসের শেষ দিকে যা হলো, তা কখনোই দেখা যায় না। সাইফউদ্দিন ব্যাটিং করার সময় হঠাৎই স্টাম্পের ওপর থেকে বেল পড়ে গেল। অথচ তিনি স্টাম্পের ধারেকাছেও নেই। জিম্বাবুইয়ানরা হিট উইকেট আবেদনে অনুকূল সাড়া না পেয়ে অসন্তোষও প্রকাশ করলেন। রিপ্লেটা দেখলে তা তো করতেনই না, বরং বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যেতেন তাঁরাও।
পাড়ার ক্রিকেটে হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় বেল পড়ে যাওয়ার ঘটনা আকছারই ঘটে, তাই বলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে? ওয়েলিংটনের মতো ‘উইন্ডি সিটি’তে কখনো কখনো যে এমন হয়নি, তা নয়।কিন্তু এদিন তো শুধু বেলই পড়েনি, নিজে নিজেই একটা স্টাম্প পরিষ্কার নড়ে উঠল। সেই নড়ে ওঠাও এমন নয় যে, তা খুব সুক্ষ্ম চোখে খেয়াল করতে বুঝতে হবে। একটা স্টাম্প রীতিমতো পেছন দিকে হেলে গেল। কমেন্টটর সিকান্দার বখত্ বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ফিল্ডার খুঁজে নেওয়ার সঙ্গে এটিকে মিলিয়ে খুব সুন্দর বললেন, ‘জিম্বাবুয়ে ১২ জন নিয়ে খেলছে। অদৃশ্য কেউ একজন আছে এই ম্যাচে।’
বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যে ফিল্ডার খুঁজে নিয়েছেন বললাম, তিন-তিনবার তা একই ফিল্ডার। ওয়েলিংটন মাসাকাদজা। তিন ক্যাচের সঙ্গে তাঁর তিন উইকেটও। সেই উইকেট তিনটিও খুব দামি। দুটি তো বাংলাদেশের ইনিংসের সবচেয়ে দামি। সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ। সাত বলের মধ্যে মাত্র ২ রান খরচে এই দুজনের সঙ্গে যোগ করেছেন ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পেয়ে তিনে নামা শেখ মাহেদীর উইকেটটিও। ২ উইকেটে ৪৫ থেকে বাংলাদেশকে ৫ উইকেটে ৫৩ বানিয়ে দেওয়ার নায়ককেও অনায়াসেই ম্যাচসেরার পুরস্কারটা দেওয়া যেত।
তাহলে দারুণ একটা ব্যাপার হতো। কেন, তা বোঝাতে লেখার শুরুতে জিম্বাবুয়ের জয় পাওয়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনীকে টেনে আনার কারণটা বলতে হয়। টি-টোয়েন্টিতে জিম্বাবুয়ের কাছে বাংলাদেশের সর্বশেষ পরাজয় সাড়ে পাঁচ বছর আগে। ২০১৬ সালের ২২ জানুয়ারি খুলনায়। এরপর বাংলাদেশ জিতেছে টানা পাঁচ ম্যাচ। সাড়ে পাঁচ বছর আগে-পরে জিম্বাবুয়ের দুটি জয়ে কী মিল?
দুটিতেই 'মাসাকাদজা' আছেন। হারারেতে ওয়েলিংটন মাসাকাদজার ভূমিকা তো সবিস্তারেই বললাম। খুলনার ওই ম্যাচেও জিম্বাবুয়েকে জিতিয়েছিলেন আরেক মাসাকাদজা। ৫৮ বলে অপরাজিত ৯৩ রানের ইনিংস খেলে যিনি পেয়েছিলেন ম্যাচসেরার স্বীকৃতিও। ওয়েলিংটনের বড় ভাই হ্যামিল্টন মাসাকাদজা।