সাকিব-তামিমের কীর্তি এবং সোহান-মিঠুন
জিম্বাবুয়ে জয়ের অন্য মহিমা
উৎপল শুভ্র
২১ জুলাই ২০২১
এই সিরিজের আগেই জিম্বাবুয়েকে পাঁচবার হোয়াইটওয়াশ করা হয়ে গেছে। তারপরও এবারের জিম্বাবুয়ে ট্যুরের ৩-০ কিভাবে দেখা দিচ্ছে অন্য মহিমা নিয়ে? কারণগুলো তো বলছিই, সঙ্গে থাকছে কিছু সংযোজনও। যার অন্যতম নুরুল হাসান সোহান ও মোহাম্মদ মিঠুন।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয় অনেক দিনই কোনো আলোড়ন তোলে না এ দেশের ক্রিকেটে। এমনকি হোয়াইটওয়াশও নয়। কেন নয় প্রশ্ন করলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে হয়তো বলে দেবেন, এ আর নতুন কি! বাংলাদেশ তো সবচেয়ে বেশিবার হোয়াইটওয়াশ করেছে জিম্বাবুয়েকেই।
তা ঠিক। এই সিরিজের আগেই পাঁচবার হয়ে গেছে হোয়াইটওয়াশ। তারপরও এবারের জিম্বাবুয়ে ট্যুরের ৩-০ দেখা দিচ্ছে অন্য মহিমা নিয়ে। সেগুলোকেই যদি আলাদা আলাদা করে বলি, সঙ্গে থাকে একটু সংযোজনও!
এই হোয়াইটওয়াশ যেখানে আলাদা
জিম্বাবুয়েকে এর আগে যে পাঁচবার হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ, সেই পাঁচবারই জিম্বাবুয়েকে আতিথ্য দিয়ে। অর্থাৎ নিজেদের দেশে খেলে। জিম্বাবুয়েতে গিয়ে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ এবারই প্রথম। এটির মহিমা শুধু এই তথ্যটা দিয়ে বোঝানো যাচ্ছে না। তা বোঝাতে হোয়াইটওয়াশে জেতা সিরিজগুলোকে ‘দেশে এবং দেশের বাইরে’ ক্যাটাগরিতে ভাগ করতে হয়।
এবারের আগে বাংলাদেশ যে ১৪টি ওয়ানডে সিরিজে প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করেছে; তাতে পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো ‘বড়’ দলও আছে। এর মধ্যে শেষ দুটি, অর্থাৎ নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে একাধিকবার। সুনির্দিষ্ট করে বললে দুই বার। তবে ১৪টি হোয়াইটওয়াশের মধ্যে ১৩টিই বাংলাদেশে।
এরপর অংকটা খুবই সহজ। এর আগে মাত্র একবারই পরভূমে গিয়ে স্বাগতিক দলকে হোয়াইটওয়াশ করতে পেরেছে বাংলাদেশ।
এক যুগ আগে ও পরে
সেই একবার ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করার সেই কৃতিত্বে অবশ্য সব সময়ই একটা টীকা জুড়ে দিতে হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ডের সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে ঝামেলায় ক্রিস গেইলরা ওই সিরিজ না খেলায় তড়িঘড়ি করে যে দলটা দাঁড় করানো হয়েছিল, তা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘বি’ টিম। সেদিক থেকে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই সাফল্যকে একটু এগিয়েই রাখতে হয়। ক্রেইগ আরভিন ও শন উইলিয়ামস না থাকায় জিম্বাবুয়ে একটু দুর্বল হয়েছে সত্যি, কিন্তু তাই বলে এটাকে কেউ জিম্বাবুয়ের ‘বি’ টিম বলবে না। বাংলাদেশও তো এই সিরিজে মুশফিকুর রহিমকে পায়নি, প্রথম দুই ম্যাচে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সেরা বোলার মোস্তাফিজুরকেও না।
এই প্রথম টানা তিন
জিম্বাবুয়েতে এর আগেও সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে প্রথম, দুই বছর পর ওই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে সরাসরি গিয়ে দ্বিতীয়বার। তবে জিম্বাবুয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টানা তিন ম্যাচে জয় এবারই প্রথম। আগের দুটি সিরিজ জয়েই টানা দুটি জয় ছিল। ২০০৯ সালে তা দুইবার। পাঁচ ম্যাচ সিরিজের ঠিক মাঝের ম্যাচটি হেরে এর আগে-পরের দুটি-দুটি চারটি ম্যাচই জিতেছিল বাংলাদেশ। টানা দুই ম্যাচ জিতেছিল আরও একবার। তবে তা প্রথম তিন ম্যাচেই হেরে সিরিজ পরাজয় সম্পন্ন হওয়ার পর। ২০১১ সালের সেই সিরিজে আবার পরিষ্কার দুটি ভাগ। হারারতে সিরিজের প্রথম তিন ম্যাচেই জিতেছিল জিম্বাবুয়ে। বুলাওয়েতে শেষ দুই ম্যাচে বাংলাদেশ।
সাকিবের 'ফেরা'
এই শিরোনাম ব্যবহৃত হতে হতে অনেক জীর্ণ হয়ে গেছে। কতবারই তো ফিরেছেন সাকিব! যখনই তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তখনই এমন কিছু করে জবাব দিয়েছেন যে, সব ফিসফাস তো বন্ধ হয়ে গেছেই, উল্টো শুরু হয়ে গেছে সাকিব-বন্দনা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ বছর হয়ে গেছে, বয়সও হয়েছে, গত কিছুদিনের ম্লান সাকিবকে দেখে সেটিকে ‘শেষের শুরু’ বলেও ভাবতে শুরু করেছিলেন কেউ কেউ।
২০১৯ বিশ্বকাপে অমন অতিমানবীয় পারফরম্যান্সও একটা সমস্যার কারণই হয়েছিল। সাকিবের এর পরের পারফরম্যান্সকে সব সময়ই বিচার করা হয়েছে সেটির সঙ্গে তুলনা করে। অথচ বিশ্বকাপের মধুচন্দ্রিমার পরপরই এই সময়টাই ছিল সাকিবের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ। নিধেধাজ্ঞা, ইনজুরি, পারিবারিক দায়িত্ব, আইপিএল..একেক সময় একেক কারণ, বেশির ভাগ সময় বিতর্কে মিস করেছেন অনেক সিরিজ।
বিশ্বকাপের পর পুরো সিরিজ খেলছেন এই প্রথম। কখনো বোলিংয়ে, কখনো ব্যাটিংয়ে আলো ছড়িয়ে ম্যান অব দ্য সিরিজ। ওয়ানডেতে সপ্তমবারের মতো। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫তম বার। শুধু বিরাট কোহলি আর শচীন টেন্ডুলকারই যেখানে তাঁর সামনে।
তামিমের ‘প্রথম’
ওয়ানডেতে তাঁর ১৪টি সেঞ্চুরি, টেস্টে ৯টি, একটা সেঞ্চুরি আছে টি-টোয়েন্টিতেও। এই ২৪টি সেঞ্চুরির অনেকগুলোই ভিন্ন ভিন্ন কারণে স্পেশাল। এই তালিকায় অবশ্য অবশ্যই ঢুকে গেছে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে সর্বশেষ সেঞ্চুরিটা। আপত্তি জানাতে থাকা হাঁটুকে বিশ্রাম দিতে প্রায় দুই মাস খেলা থেকে দূরে সরে যাওয়ার আগে শেষ ম্যাচে সেঞ্চুরি, এটা তো অবশ্যই একটা কারণ।
এর চেয়েও বড় কারণ, অধিনায়ক হিসেবে এটা তামিম ইকবালের প্রথম সেঞ্চুরি। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কা সফরে যে অধিনায়ক-জীবন শুরু হয়েছিল শূন্য দিয়ে। এই সিরিজেও প্রথম ম্যাচে শূন্য। দ্বিতীয় ম্যাচে করেছেন মাত্র ২০। তিনি তো আর সাকিব নন যে, একটাতে ব্যর্থ হলে আরেকটাতে পুষিয়ে দেবেন। ব্যাটিংয়ে ব্যর্থ মানে ম্যাচেই ব্যর্থ। শেষ ম্যাচটায় যখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল জিম্বাবুয়ে, তখনই তামিম দেখা দিলেন স্বরূপে। ‘স্বরূপে’ বলছি, কিন্তু এই রূপে তাঁকে দেখা যায় না বলেই না গত কিছুদিন এত সমালোচনা, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, হালের ফ্যাশন ট্রল...। তামিমের স্ট্রাইক রেট নিয়ে এত কথা! সেখানে কি না এই ‘বুড়ো’ বয়সে এসে ওয়ানডেতে নিজের দ্রুততম সেঞ্চুরি! এই সেঞ্চুরির স্পেশাল না হয়ে উপায় কি!
তিনটি স্পেশাল ইনিংস
প্রতিটি ওয়ানডেতেই এক বা একাধিক ভালো ইনিংস থাকে। কিন্তু সব কি আর মনে রাখার মতো হয়! জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজটা এখানেই ব্যতিক্রম। তিনটি ম্যাচেই বাংলাদেশের তিন ব্যাটসম্যানের ব্যাট থেকে এমন তিনটি ইনিংস এসেছে, যার প্রতিটিকেই ‘স্পেশাল’ বলে মানতে হয়।
প্রথম ম্যাচে লিটনের ১০২, দ্বিতীয় ম্যাচে সাকিবের অপরাজিত ৯৬, তৃতীয় ম্যাচে তামিমের ১১২...পরপর তিন ম্যাচে এমন স্মরণীয় তিনটি ইনিংসের দেখা সব সিরিজে মেলে না। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে তো আর না। এমনই ইনিংস যে, ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচনের জন্য অ্যাজুডিকেটরের কোনো প্রয়োজনই ছিল না।
সোহানের ফেরা
এই ফেরা সাকিবের ফেরার মতো নয়। আক্ষরিক অর্থেই ফেরা। নুরুল হাসান সোহান সর্বশেষ ওয়ানডে খেলেছেন সাড়ে চার বছরেরও বেশি আগে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নেলসনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ৩৯ বলে ৪৪ রান করেও যে বাদ পড়লেন; বাদ তো বাদই।
উইকেটকিপার হিসেবে তর্কাতীতভাবে দেশের সেরা, কিন্তু ব্যাটিংয়ে মুশফিক ও লিটন অনেক এগিয়ে থাকায় ‘ভুল সময়ে জন্মানো’র দুঃখ নিয়েই দিন কাটে তাঁর। ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচেও তালগোলেই সুযোগ পেয়েছিলেন, কারণ নির্বাচক বা টিম ম্যানেজমেন্টের প্রাথমিক ওয়ানডে প্ল্যানে তিনি ছিলেন না।
ওয়ানডে সিরিজটা টেস্ট আর টি-টোয়েন্টি সিরিজের মাঝখানে পড়েছে বলেই তিন ফরম্যাটের স্কোয়াডেই রাখতে হয়েছিল তাঁকে। টেস্ট স্কোয়াডে ছিলেন বিকল্প উইকেটকিপার হিসেবে, টি-টোয়েন্টিতে খেলানোর প্ল্যান...মাঝখানে ওয়ানডে সিরিজটার সময় তো তাহলে তাঁকে জিম্বাবুয়েতেই রেখে দিতে হয়। এ কারণেই থাকলেন সোহান এবং মিরাজের ইনজুরির কারণে খেলেও ফেললেন।
সেই সুযোগটাকে এর চেয়ে ভালোভাবে আর কাজে লাগাতে পারতেন না। দীর্ঘ বিরতির পর নেমেছেন হ্যাটট্রিক-বল সামলাতে। সেই বলে চার মেরে শুরুটাই অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়। বুঝিয়ে দিয়েছে পরের ৫টি বাউন্ডারিও। দারুণ রিস্ট ওয়ার্কে যার একটা তো এখনো চোখে লেগে আছে। ৩৯ বলে অপরাজিত ৪৫ করে যেভাবে ম্যাচ শেষ করে বেরিয়েছেন, তাতে নিজের দাবিটা জোরালোভাবেই তুলে ধরেছেন। পরের ওয়ানডে খেলতে সোহানকে আবার সাড়ে চার বছর অপেক্ষা করতে হলে তা একটু অস্বাভাবিকই হবে।
এবং মোহাম্মদ মিঠুন
সিরিজে ব্যর্থতার খতিয়ান করতে বসলে আরও দু’একটা নাম হয়তো আসবে, তবে জনমত জরিপে কোন নামটা বেশি আসবে, তা অনুমান করা একটুও কঠিন নয়। বছরের শুরুর দিকে ক্রাইস্টচার্চে অপরাজিত ৭৩ রানের যে ইনিংসটি খেলেছিলেন মিঠুন, তা বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডে ম্যাচই জিতিয়ে দিয়েছিল প্রায়। কিন্তু এর আগের ইনিংসে ৯ আর পরের ইনিংসে ৬ তা প্রায় ভুলিয়েই দিয়েছে অনেককে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে প্রথম বলেই জঘন্য এক শট খেলে আউট হওয়ার পর বাদ পড়েছিলেন পরের দুই ম্যাচে।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজটা তাই তাঁর জন্যও ছিল ‘ফেরা’। মুশফিক চলে আসায় মিডল অর্ডারের নির্ভরতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা সুযোগও। তিন ম্যাচে ৫১ রান করে তা নষ্ট করেছেন বললে কিছুই বলা হয় না। কারণ এই রানসংখ্যা তাঁর ব্যাটিং করার এবং আউট হওয়ার ধরনটা একটুও বোঝাতে পারছে না। প্রথম দুই ম্যাচেই খুবই বাজে শট খেলে আউট, তৃতীয় ম্যাচটা শেষ করে বেরিয়ে আসার সুযোগ একটা ‘লাইফ’ পাওয়ার পরও যেভাবে নষ্ট করেছেন, তাতে মিঠুনকে নিয়ে প্রশ্নটা আরও বড় হয়ে উঠেছে।