মাইকেল কলিন কাউড্রে না বলে এমসিসি নামেই ডাকুন
উৎপল শুভ্র
২৪ ডিসেম্বর ২০২১
ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ বাবা ছেলের নাম রেখেছিলেন মাইকেল কলিন কাউড্রে, যাতে নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে এমসিসি হয়। এমসিসি মানে ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরোনো ক্লাব মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব। কী আশ্চর্য, এমসিসির দ্বিশতবার্ষিকীতে সেই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট কিনা মাইকেল কলিন কাউড্রেই। এক শ টেস্ট খেলার প্রথম কীর্তি যাঁর, প্রথম সাত হাজার রান করারও। খেলা ছাড়ার সময় সবচেয়ে বেশি টেস্ট-রান-ক্যাচের রেকর্ডও ছিল তাঁরই।
আর্নেস্ট আর্থার কাউড্রে ক্রিকেটপ্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এক মানুষ। নিজেও খেলতেন। একেবারে আহামরি কিছু নয়। তারপরও তালেগোলে একটা ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলে ফেলেছেন। জাতিতে ইংরেজ, তবে জন্ম ব্রিটিশ রাজের অধীন ভারতবর্ষে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে কলকাতায়।
একমাত্র ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচটি তালেগোলে খেলে ফেলা বলছি, কারণ তা খেলতে পেরেছিলেন তখন তিনি ভারতে ছিলেন বলেই। ১৯২৬-২৭ মৌসুমে ভারতে শুভেচ্ছা সফরে এসেছে এমসিসি দল। সেই দলের বিপক্ষে মাদ্রাজে ইউরোপিয়ান একাদশের হয়ে খেলেন আর্নেস্ট কাউড্রে। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৪২ রানও এসেছিল তাঁর ব্যাট থেকেই।
আর্থার কাউড্রের একমাত্র ছেলের জন্মও ভারতে। তখন তাঁর বাস অধুনা চেন্নাই আর সে সময়ের মাদ্রাজের কাছের পর্যটন শহর উটিতে, নিজের টি এস্টেটে। ক্রিকেটপ্রেম থেকে ছেলের এমন একটা নাম রাখলেন, যেন সেই নামের আদ্যক্ষর মিলে এমসিসি হয়। এমসিসি মানে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব। যে ক্লাবকে বলতে পারেন ক্রিকেটের জনক। এখনো ক্রিকেটে কোনো আইন বদলাতে হলে যে ক্লাবের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলও অনেক অনেক বছর এমসিসি নামেই খেলেছে।
তো আদ্যক্ষর এমসিসি রাখতে ছেলের নাম রাখা হলো মাইকেল কলিন কাউড্রে। এটা তো না বললেও চলছে যে, পদবীর প্রথম অক্ষর ‘সি’ না হলে বাবার চাওয়া পূরণ হতো না। ছেলের যখন এমসিসির অর্থ ভালো করে বোঝার বয়সও হয়নি, তখনই তার জন্য এমসিসির সদস্য পদ চেয়ে আবেদনও করে দিলেন আর্থার কাউড্রে।
এসব গল্প আমরা জানতেও পারতাম না, যদি না সেই ছেলে একদিন ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন হতেন। এমসিসি নিয়ে এত কথা বলার আসল কারণ যদিও এটা নয়। কী বিস্ময়কর দেখুন, এমসিসি আদ্যক্ষরের সেই ছেলেটিই মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব অর্থাৎ এমসিসির দ্বিশতবার্ষিকীতে সেই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট! বাবা নামটা রাখার সময় নিশ্চয়ই এতটা ভাবেননি। কেই-বা ভাবতে পারে এমন!
ছেলে ক্রিকেটার হবে, এই স্বপ্ন তো দেখেছিলেনই। তাই বলে আর্নেস্ট আর্থার কাউড্রের স্বপ্ন নিশ্চয়ই এত দূর বিস্তৃত হয়নি যে, তিনি ভাববেন ছেলে একদিন প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে টেস্ট খেলার সেঞ্চুরি করবে। টেস্টে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডটি একদিন তাঁর হবে, সবচেয়ে বেশি ক্যাচের রেকর্ডও। খেলা ছাড়ার সময় সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলার রেকর্ড, ইংল্যান্ডের পক্ষে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি। নিদারুণ এক ট্র্যাজেডিই বলতে হয়, নিজের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাওয়া এমন কীর্তিমান ছেলের টেস্ট অভিষেকটাও বাবা দেখে যেতে পারেননি মাত্র মাস দুয়েকের জন্য।
এই দুই রেকর্ডের কোনোটাই যে এখন আর কলিন কাউড্রের নয়, এটা তো মনে হয় আপনি জানেনই। ১০০ টেস্ট খেলাও অনেকদিন ধরেই তেমন কোনো ব্যাপার নয়। শচীন টেন্ডুলকার ২০০ টেস্ট খেলে ফেলার পর তো আরও নয়। তবে কাউড্রে যখন শততম টেস্ট খেলতে নামেন, তা সত্যিকার অর্থেই ছিল এক বিস্ময়। কলিন কাউড্রে তা উদযাপন করেছিলেন সেঞ্চুরি করে। সেই সেঞ্চুরিতেও মজার একটা ব্যাপার আছে। হাফ সেঞ্চুরি করার পরই পায়ের পেশিতে টান পড়েছিল। ক্রিকেটে তো তখন রানার নেয়া যেত, সেঞ্চুরি করতে তাই সমস্যা হয়নি। আউট হয়ে যাওয়া ব্যাটসম্যানই শুধু রানার হতে পারতেন, সেই ইনিংসে তখন পর্যন্ত আউট হয়েছিলেন শুধু জিওফ বয়কট। নিজেকে ছাড়া কিছু বোঝেন না, সারা জীবন এই অপবাদ বয়ে বেড়ানো বয়কটকে তাই দৌড়ে যেতে হয়েছে কাউড্রের রানের জন্য। প্রসঙ্গটা উঠতই না, যদি ঘটনাচক্রে ১০০ টেস্ট খেলার দ্বিতীয় কীর্তিটা এই বয়কটই করে না ফেলতেন।
এমসিসির দ্বিশতবার্ষিকীতে ক্লাবের চেয়ারম্যানের নাম এমসিসি, প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে শততম টেস্ট খেলার সময় কাউড্রের রানারের এই কীর্তিতে দ্বিতীয় জন হয়ে যাওয়া- এ সব তো অবশ্যই কাকতালীয়। ক্রিকেটে এমন কাকতালীয় ঘটনা আরও অনেক আছে। এই লেখায় তাতে আর না যাই। আমরা কলিন কাউড্রে নিয়েই থাকি। তা হঠাৎ করে আজ তাঁকে নিয়ে লেখারও তো একটা কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়। সেই কারণ হলো, আজ কলিন কাউড্রের জন্মদিন। নিজে তা পালন করছেন কি না, তা জানার উপায় নেই। কারণ স্বর্গে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ আছে কি না, আমরা তা জানি না। এক ডিসেম্বরে পৃথিবীতে এসেছিলেন, ৬৭ বছর পর ২০০০ সালের আরেক ডিসেম্বরে কলিন কাউড্রে চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে।
কাউড্রের জন্মদিনের সঙ্গে মেলানো যায়, এমন কাকতালীয় আরেকটা ঘটনাও তাহলে বলেই ফেলি। কৈশোর থেকেই কাউড্রের ব্যাটিং যাঁকে মনে করিয়ে দিত, সেই ওয়ালি হ্যামন্ডকে ছাড়িয়ে গিয়েই টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডটা করেছিলেন। সবচেয়ে বেশি ক্যাচের রেকর্ডটাও হ্যামন্ডের কাছ থেকেই ছিনিয়ে নেওয়া। কী আশ্চর্য, সেই হ্যামন্ডের টেস্ট অভিষেক কি না কলিন কাউড্রের জন্মদিনেই। তারিখ অনুযায়ী 'জন্মদিন' কথাটাতে কোনো ভুল নেই। তবে হ্যামন্ডের টেস্ট অভিষেক কাউড্রের জন্মের ঠিক পাঁচ বছর আগের এক ২৪ ডিসেম্বরে।
কথায় কথা আসে। হ্যামন্ডের টেস্ট অভিষেকের কথা বলতে গিয়েই যেমন আরেকটি কাকতালীয় মিলের কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। ১৯২৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর জোহানেসবার্গে হ্যামন্ডের টেস্ট ক্রিকেটে পদার্পণ। এগার বছর পর একই দিনে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে ছয় হাজার রান করার কীর্তি। এখানেও শেষ হলে কথা ছিল। মিলটা শুধু দিনেই না, প্রতিপক্ষও সেই দক্ষিণ আফ্রিকা, ভেন্যুও সেই জোহানেসবার্গ। পরিসংখ্যানবিদরা বলতে পারবেন, প্রবাবিলিটির বিচারে ব্যাপারটা কতটা অবিশ্বাস্য!
বিষয় কলিন কাউড্রে হলেও এই লেখাটা কিছু কাকতালীয় মিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হচ্ছে। কারণ কলিন কাউড্রের বর্ণাঢ্য এবং নাটকীয় ক্যারিয়ার আরও অনেক বিস্তৃত পরিসর দাবি করে। তারপরও লেখাটা শেষ করার আগে কিছু ব্যাপার একটু ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাই। টেস্টে প্রথম সাত হাজার রান কলিন কাউড্রের। 'প্রথম' কিছু চিরদিনই প্রথম হয়ে থাকলেও সেই কীর্তিমানদের দলটা জনাকীর্ণ হয়ে পড়লে তা আর সেভাবে মনে থাকে না। তবে টেস্ট সংখ্যা-রান-ক্যাচের মতো অনেক রেকর্ডের মালিকানা হারিয়ে ফেললেও একটা রেকর্ড এখনো কলিন কাউড্রেরই আছে। যে রেকর্ডটি একাই লড়ে যাওয়ার বীরত্বব্যঞ্জক। কমপক্ষে তিন ইনিংস খেলা হয়েছে, এমন টেস্ট ম্যাচে কাউড্রেই একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান, এমন হয়েছে নয়বার। এই রেকর্ডে যিনি সবচেয়ে কাছাকাছি (৮ বার), তাঁর নামটা এই লেখাতে আগেও এসেছে। শততম টেস্টে কলিন কাউড্রের রানার জিওফ বয়কট।
বীরত্বসূচক কোনো একটা রেকর্ডে কাউড্রের নাম থাকাটাকে একটু প্রতীকি বলেই মনে হয়। সাহসের প্রমাণ তো আর কম দেননি। ১৯৬৩ সালে লর্ডস টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলার ওয়েস হলের বাউন্সারে হাত ভেঙে গেল। পরদিন ইংল্যান্ডের যখন নবম উইকেট পড়ল, ম্যাচে সম্ভাব্য চারটি ফলই হতে পারে। ইংল্যান্ডের ৬ রান দরকার, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১ উইকেট। নবম উইকেট ফেলে দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা যখন জিতে গেছি বলে ভাবছে, বাঁহাতে প্লাস্টার নিয়ে মাঠে নেমে এলেন কাউড্রে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে একটি বলও খেলতে হয়নি। কিন্তু খেলতে হতে পারে ভেবেই তো নেমেছিলেন এবং না নামলে ইংল্যান্ড টেস্টটা হেরে যায়।
ক্যারিয়ারের শেষটা তো আরও দুর্জয় সাহসের প্রদর্শনী। ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে ব্রিসবেনে প্রথম টেস্টে ডেনিস লিলি আর জেফ টমসনের আগুনে গোলায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা। চোট পেয়েছেন দলের মূল দুই ব্যাটসম্যান। ইংল্যান্ডের নির্বাচকেরা উদ্ধারকর্তা হিসাবে শরণাপন্ন হলেন কলিন কাউড্রের। অথচ কাউড্রের বয়স তখন ৪২ ছুঁইছুঁই এবং প্রায় চার বছর তিনি কোনো টেস্ট খেলেননি। কাউড্রে যে 'না' বলে দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিক ব্যাপারটাই ঘটল না। কাউড্রে উড়ে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায় এবং ৪৭ ঘণ্টার বিমানযাত্রার শেষে পার্থে পৌাছানোর পরদিনই বিশ্বের দ্রুততম পিচে তিন নম্বরে ব্যাটিং করতে নেমে গেলেন। তখন বোলিং করছেন জেফ টমসন, যাঁর মুখোমুখি হলে ব্যাটসম্যানদের শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত নেমে যায়। সেই স্রোতধারাকে আরও শিরশিরে করে তুলতে যিনি উইকেটে রক্ত দেখতে ভালোবাসেন বলেও ঘোষণা করে দিয়েছেন। কাউড্রে উইকেটে গিয়েই সেই টমসনকে হাসি মুখে সম্ভাষণ জানালেন, "গুড মর্নিং, মাই নেম ইজ কলিন কাউড্রে।"
টমসন তাতে পুলকিত হয়েছেন বলে জানা যায় না। শুধু ব্যাটে নয়, শরীরেও বল নিয়ে সেই টেস্টের দুই ইনিংসে ২২ ও ৪১ রান। এরপর থেকেই স্কোর নিম্নমুখী, কিন্তু শুধু রান দিয়ে কি আর সেই সিরিজের কাউড্রেকে বোঝানো যায়! সিরিজটা যে শেষ করেই ফিরেছিলেন, আসল মহিমাটা তো ওখানে। জেনেবুঝে ওই অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দেওয়ার কারণ হিসাবে পরে বলেছিলেন, "কারণ একটাই- চ্যালেঞ্জ। ওটা নেওয়ার লোভটা সামলাতে পারিনি।"
এমসিসির চেয়ারম্যান হওয়ার কথা তো বলা হয়েছে আগেই। চেয়ারম্যান হয়েছিলেন আইসিসিরও। ক্রিকেটে টিভি আম্পায়ার ও ম্যাচ রেফারির প্রবর্তন তাঁর সময়েই। মাঠে ও মাঠের বাইরে এমনই এক খেলোয়াড়ি চেতনার ধারক ছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পরের বছর থেকেই এমসিসির স্পিরিট অব ক্রিকেট লেকচারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর নাম। এমসিসির সঙ্গে মিল রেখে যে ছেলের নাম রেখেছিলেন বাবা, তাঁর নামটা তাই প্রতি বছরই নিয়ম করে উচ্চারিত হয় এমসিসিতে।
শুভ জন্মদিন, মাইকেল কলিন কাউড্রে! স্যরি, স্যরি! শুভ জন্মদিন, এমসিসি!
* লেখাটা গত বছর সামান্য পরিবর্তিত রূপে নিউজ বাংলা ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিল।