উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

`ফ্যাব ফোর`-কে `ফ্যাব ফাইভ` বানাতে পারবেন বাবর আজম?

ইফতেখার নিলয়

১৬ অক্টোবর ২০২১

`ফ্যাব ফোর`-কে `ফ্যাব ফাইভ` বানাতে পারবেন বাবর আজম?

বাবর আজম

ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ে তিনি বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান, টি-টোয়েন্টি র‍্যাঙ্কিংয়ে দুই। টেস্ট ক্রিকেটে সাত নম্বরে থাকলেও বাবর আজমের ব্যাটিং দেখলেই যে কেউ বুঝে যাবেন, এটা তাঁর সামর্থ্যের প্রতিফলক নয়। এটাও বুঝে যাবেন, বিশ্ব ক্রিকেট দাপিয়ে বেড়ানো `ফ্যাব ফোর` কোহলি-স্মিথ-উইলিয়ামসন-রুটের দলে ঢুকে সেটিকে `ফ্যাব ফাইভ` বানিয়ে ফেলার ক্ষমতা তাঁর আছে।

বাবর আজমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শুরু বছর ছয়েক আগে। প্রথম অভিষেকটা রঙিন জার্সিতে ওয়ানডে ক্রিকেটে। আবির্ভাবে বাবরকে নিয়ে উন্মাদনা শুধুমাত্র পাকিস্তান ক্রিকেটের অন্দরমহল ও সমর্থকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দিনে দিনে নিজেকে নিয়ে সেই আলোচনা ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটে।

এর আগেও আলোচনাটা শুধু পাকিস্তান ক্রিকেটের অন্দরমহলেই ছিল বললে অবশ্য ভুল হবে। ২০১০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়া বন্ধুকে ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে জিজ্ঞেস করেছিলেন, নতুন কোনো খেলোয়াড় এসেছে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো? হার্শার বন্ধু উত্তরে বলেছিল, ‘চলে এসেছে একজন। নাম বাবর আজম।‘

সেই ঘটনার এক দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর হার্শা ভোগলের বন্ধুর উক্তির সার্থকতার প্রমাণ মিলেছে। টানা ৪১ সপ্তাহ ওয়ানডে ব্যাটিং র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ স্থানে থাকা বিরাট কোহলির মসনদে হানা দিয়ে সেই আসন দখল করেছেন বাবর আজম। বর্তমানে ২৯ রেটিং পয়েন্টে কোহলি পিছিয়ে বাবরের চেয়ে।

কোহলির কথা বললেই চলে আসে আরও তিনটি নাম। স্টিভ স্মিথ, কেন উইলিয়ামসন আর জো রুট। 'ফ্যাব ফোর' নামে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া এই চারজন অনেক দিন ধরেই রাজত্ব করে যাচ্ছেন ক্রিকেট বিশ্বে। তর্কের খাতিরে একেকজনের কাছে একেকজন সেরা হলেও পারফরম্যান্সে আসলে কেউই কারও চেয়ে কম যান না। এই চারের সঙ্গে কি যোগ হবে বাবর আজমের নামও? এখনই তো অনেকে এমন বলতে শুরু করেছেন। তবে সত্যি এটাই যে, 'ফ্যাব ফোর'কে 'ফ্যাব ফাইভ' বানাতে এখনো বেশ কিছুটা পথ পেরোতে হবে বাবরকে।

বিরাট কোহলির কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থান। টি-টোয়েন্টিতে বাবর আজম আছেন দুই নম্বরে

ওয়ানডেতে র‍্যাঙ্কিং বলছে, এরই মধ্যে সবাইকে টপকে গেছেন তিনি। কিন্তু গ্রেটনেস তো আর এক/দুই দিনের ব্যাপার নয়। ধারাবাহিকতাটা জরুরি, জরুরি র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে স্থায়িত্ব। ওয়ানডেতে যদিও এমন কীর্তি আছে বাবরের, যা বাকি তিনজনের নেই। টানা তিন ম্যাচে সেঞ্চুরি। টি-টোয়েন্টিতেও বাবর আজম প্রমাণ করে ফেলেছেন নিজেকে। প্রশ্ন যদি কিছু থাকে, তবে সেটি টেস্ট ক্রিকেটে পারফরম্যান্স নিয়ে। যা দিয়েই আসলে বিচার হয় সত্যিকার ক্রিকেটীয় গ্রেটনেসের।

সেই টেস্ট পারফরম্যান্সে অনেক উত্থান-পতন। তবে তখনো বাবর আজমের ব্যাটিং দেখে বুঝতে অসুবিধা হতো না, ব্যাটসম্যান হিসেবে স্পেশাল একজনই এসেছেন বিশ্ব ক্রিকেটে। ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে ব্যাটিং দেখার পর রিকি পন্টিংই যেমন বলেছিলেন, ‘অসাধারণ একজন ক্রিকেটার। কাভার ড্রাইভ ও ডাউন দ্য গ্রাউন্ড শটগুলো এমন দারুণ! আবার শর্ট পিচ বলেও স্বচ্ছন্দ। তার টেস্ট গড় এখন মাত্র ৩৫ হলেও আমি বিশ্বাস করি, এটা বাড়তে বেশি সময় লাগবে না।'

রিকি পন্টিংয়ের কথা বাবরের কানে পৌঁছেছিল কি না, কে জানে! তবে বাবর সেই সিরিজেই দুই টেস্টে ১০২ ও ৯৭ রানের ইনিংসের পর শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের বিপক্ষে টানা তিন শতকে এক লাফে ৪৫-এ নিয়ে যান টেস্ট ব্যাটিং গড়। করোনার দীর্ঘ বিরতিতে খেলা বন্ধ থাকাটা বাবরের ব্যাটিংয়ে একটু ছন্দপতন ঘটানোতেই কি না এখন তা কমে হয়েছে ৪২।

করোনার কারণে থমকে যাওয়ার আগে নিরবিচ্ছিন্ন ক্রিকেট হয়েছে বলে ২০১৯ সালটাকে যদি কেস স্টাডি হিসেবে নেওয়া হয়, দেখা যাবে, 'ফ্যাব ফোর'-এর মধ্যে একমাত্র বিরাট কোহলিই বেশি রান করেছেন বাবর আজমের চেয়ে। তবে কোহলি ম্যাচও খেলেছেন ৬টি বেশি। ব্যাটিং গড়ে কিন্তু দশমিকের ব্যবধানে বাবর আজমই এগিয়ে। 

টেস্ট ক্রিকেটেও বাবরের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বলা যায় ২০১৯ সালকে। ব্যাটিং গড়ে পেছনে ফেলেছেন 'ফ্যাব ফোর'-এর তিনজনকে। বাবরের গড় ছিল ৬৮.৪৪। কোহলি, রুট আর উইলিয়ামসনের যথাক্রমে ৬৮, ৩৭ আর ৫১। ৭৪ ব্যাটিং গড় নিয়ে সবার উপরে ছিলেন স্টিভ স্মিথ।

তার মানে 'ফ্যাব ফোর'কে 'ফ্যাব ফাইভ' বানানোর পথে যাত্রা শুরু করে দিয়েছিলেন বাবর আজম। একটা পার্থক্য অবশ্য মনে রাখা দরকার। ওই চারজন ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ এরই মধ্যে পেছনে ফেলে এসেছেন। বাবর আজমের ক্যারিয়ার যেখানে মাত্রই ফুল হয়ে ফুটতে শুরু করেছে। হাতে তাঁর অনেক সময়।

বাবর আজমের ক্ল্যাসিকাল ড্রাইভ

তবে একটা তুলনা তো হতেই পারে। বাবরের সমান ৩৫ টেস্ট খেলার পর কেমন ছিল ওই চারজনের রেকর্ড? সেই তুলনায় যাওয়ার আগে বাবর আজমের রান আর সেঞ্চুরি সংখ্যাটা আগে জেনে নেওয়া ভালো। রান করেছেন ২৩৬২, সেঞ্চুরি ৫টি। ওই চারজনই কিন্তু এগিয়ে ছিলেন বাবরের তুলনায়। মাত্র ৬২ রান বেশি করে উইলিয়ামসন ছিলেন বাবরের সবচেয়ে কাছাকাছি। বিরাট কোহলির রান ছিল ২৬৬৭, সেঞ্চুরি ১১টি। রুট আর স্মিথ তো ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তিন হাজার রানের মাইলফলকও। সবচেয়ে বেশি, ৩৩০৯ রান ছিল স্টিভ স্মিথের।

এই বিচারে বাবর বাকি চারজনের তুলনায় পিছিয়েই আছেন। তবে বাবরের সাম্প্রতিক ফর্ম বলছে, টেস্টেও হয়তো তাঁর দিন আসছে। ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর, টি-টোয়েন্টিতে দুই, শুধু টেস্ট ক্রিকেটেই এখনো বাবরের সেভাবে নিজেকে প্রমাণ করতে বাকি। তারপরও সাত নম্বরে উঠে এসেছেন ঠিকই। সাম্প্রতিক বাজে ফর্ম বিরাট কোহলিকে নামিয়ে এনেছে ছয় নম্বরে। শীর্ষ তিন কিন্তু 'ফ্যাব ফোর'-এর বাকি তিনজনের দখলেই। ক্রমটা এরকম: জো রুট, কেন উইলিয়ামসন, স্টিভ স্মিথ। এই তিনজন আর কোহলি-বাবর আজমের মাঝে ঢুকে গেছেন মারনাস লাবুশেন ও রোহিত শর্মা।

র‍্যাঙ্কিং সাম্প্রতিক ফর্মের একটা ধারণা দেয়। তবে ব্যাটসম্যানশিপের পুরো মাহাত্ম্য তুলে ধরার সাধ্য কি তার! বাবর আজমের ব্যাটিংয়ে ওই বাড়তি ব্যাপারটা আছে। একটু দেখলেই যা নিঃসন্দেহ করে দেয়, পাকিস্তান ক্রিকেটের পরবর্তী ব্যাটিং গ্রেট হতেই আবির্ভাব তাঁর। পাকিস্তানের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব ক্রিকেটেরই বা নয় কেন!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×