নারাইন ভাবতেই পারেন, ‘এই জন্মে কেন সাকিব হলাম না!’
রিজওয়ান রেহমান সাদিদ
১৩ অক্টোবর ২০২১
বল হাতে ৪ ওভারে ২৪ রান আর ব্যাটে নেমে ৬ বলে ৯ রান, কলকাতাকে ২০২১ আইপিএলের কোয়ালিফায়ারে তুলে দিতে সাকিব বেশ বড় ভূমিকাই রেখেছেন। তবুও সাকিব পার্শ্বনায়কই, কেননা এ ম্যাচেই সুনীল নারাইন উপহার দিয়েছেন চূড়ান্ত এক অলরাউন্ড পারফরম্যান্স। অথচ এই নারাইনের সঙ্গেই সাকিবকে যেভাবে লড়াইতে নামাতে চান সাকিবের ভক্ত-সমর্থকেরা, নারাইনের তাতে মনে হতেই পারে, `বিধাতা আমাকে কেন সাকিব বানালেন না!`
ধরা যাক, ফেসবুকে আপনার আসা-যাওয়া বেশ সীমিত হয়ে পড়েছে গত কিছুদিনে। ক্রিকেটের সঙ্গে এক কালে আপনার দারুণ সখ্য থাকলেও ইতোমধ্যেই গুটিয়ে নিয়েছেন সেই জাল। আপনার কাছে ক্রিকেট মানে এখনও শচীন টেন্ডুলকারের স্ট্রেট ড্রাইভ কিংবা রিকি পন্টিংয়ের হুক-পুল; এবি ডি ভিলিয়ার্সের ৩৬০ ডিগ্রি হয়ে ওঠার খবর যদিও কিছু কিছু কানে আসে এখনো, তবে নিকোলাস পুরান কিংবা ঋষভ পন্তরা সে দুনিয়ায় ভিড় করতে পারেননি।
তো হঠাৎ করেই গতকাল ফেসবুকে ঢুকে দেখলেন, সাকিব আল হাসানকে ঘিরে বয়ে যাচ্ছে আনন্দের বন্যা। 'সাকিব, দ্য কিং!' 'নবাব বোঝালেন তাঁর মহিমা'-জাতীয় স্ট্যাটাসে ভেসে যাচ্ছে আপনার নিউজ ফিড। যা দেখে-টেখে আপনার মনে হতেই পারে, নোবেল পুরস্কারের বিজয়ী ঘোষণার এই সময়টায় সাকিব আল হাসান যদি সে জিনিস না-ও জিতে থাকেন, অন্তত আইসিসির বর্ষসেরা পুরস্কারের কোনো একটা নির্ঘাত তাঁর হাতে উঠেছে।
এবং একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতেই জানতে পারলেন, সাকিব আল হাসানকে ঘিরে ওই উচ্ছ্বাসের কারণের সঙ্গে আপনার ভাবনার বিন্দুবিসর্গও মিল নেই। আইপিএলের এক এলিমিনেটর ম্যাচে চার ওভার বল করে বলপ্রতি এক রান দিয়েছেন তিনি, পরে ব্যাট হাতে নেমেছেন আট নম্বরে। সেখানে ৬ বলে ৯ রান করে কলকাতাকে তুলেছেন দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে। সামান্যতেই তৃপ্ত হওয়ার অভ্যাস না থাকলে আপনি তখন মেজাজ হারিয়ে বলে বসতেই পারেন, 'এই ছাতার মাথা দেখার জন্য এমবি ঢুকাই?'
তবে আপনার প্রতিক্রিয়া এমন হলেও এতটুকুতেই উচ্ছ্বসিত হওয়ার অভ্যাস যে অনেকেরই আছে, তা তো বুঝতেই পারছেন। যার প্রমাণ সাকিবের কল্যাণেই অনেকবার মিলেছে। মোস্তাফিজুর রহমান গত কয়েক বছর ধরেই আইপিএলের নিয়মিত মুখ, ভারতের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ তাই অনেক বাংলাদেশির কাছেই এখন 'ওই চার ওভার!' তবে মোস্তাফিজের বহু আগে থেকেই আইপিএল মানে বাংলাদেশিদের কাছে ওই প্রশ্নটা, 'সাকিব খেলছেন, নাকি খেলছেন না?' যার সঙ্গে খুব নিবিড়ভাবে জুড়ে যায়, ষড়যন্ত্র আর বঞ্চনা শব্দ দুটি।
যদি ভেবে থাকেন, সাকিবকে দলে রাখলেই শব্দ দুটির অবতারণা হয় না, তো সে ভাবনাতে বেশ ভালোই গলদ আছে। উদাহরণ চান তো, কদিন আগের কলকাতা নাইট রাইডার্স-রাজস্থান রয়্যালসের ম্যাচটাই একটু ফিরে দেখুন না! আন্দ্রে রাসেল পায়ের পেশির চোটে ছিটকে গিয়েছিলেন আগেই, মাঝের দুই ম্যাচে সুযোগ পেয়ে টিম সাউদি দাগ কাটতে পারেননি তেমন। সেদিন তাই সাকিবকে রাখা হয়েছিল একাদশে। ব্যাটিং না পেলেও কলকাতার বোলিং শুরু হয়েছিল তাঁর হাতেই। শুরুর ওভারেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন যশস্বী জওসওয়ালকে। টিম ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনার কারণেই হোক, কিংবা অন্য কিছু…পরে আর বল করতে হয়নি তাঁকে। আর এখান থেকেই প্রশ্ন মোড় নিল দিগ্বিদিকে, 'খেলাল? তা কত ওভার খেলাল? ব্যাট পেয়েছে? ও, পায়নি! তা বল করেছে নিশ্চয়ই? কী বললি, মাত্র এক ওভার! সব ওই সাদা চামড়া মরগানের চাল। ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগছে। ব্যাট হাতে রান করতে পারছে না, এখন সাকিব ভালো খেলে ফেললে ওর দলে জায়গা নিয়ে টান পড়বে, সে কারণে সাকিবকে আর বলই দিল না!' ওই ইংরেজি শব্দবন্ধে এসে আপনি হেসেও ফেলতে পারেন, যদি জানা থাকে, এউইন মরগানের নেতৃত্বেই আইপিএলের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হওয়ার পর কলকাতা তাদের আট ম্যাচের ছয়টিতেই জিতেছে।
সাকিবকে না খেলালেই তাই বরং ভালো একদিক থেকে। খেলাটা যে শুধুই খেলা নয়, বরং জাতীয়তাবাদেরই এক বিরাট অংশ, উপমহাদেশীয় সমর্থকেরা এই কথার যথার্থতা অনেকবারই প্রমাণ করেছেন। ইডেন গার্ডেনের গ্যালারিতে আগুন জ্বলেছে এই জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকেই, বাংলাদেশিরাও যে সাকিবের না খেলার সঙ্গে মাঠের পারফরম্যান্স ছাপিয়ে মাঠের বাইরের নানা কিছু দিব্যচক্ষে দেখে ফেলেন, তার পেছনেও ওই জাতীয়তাবাদ উৎসারিত আবেগই। 'সাকিব ষড়যন্ত্রের শিকার', 'বাংলাদেশি বলেই সাকিবকে অবহেলা', 'সব অবহেলা দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেব' গোছের লাইনে তখন সয়লাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। যারা এসব লেখেন, তাদেরও অবশ্য খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না। কারণটা চন্দ্রিল ভট্টাচার্য বহু আগেই বলে গিয়েছেন, বাঙালি মাত্রই 'ভগবানও আমাদের বঞ্চিত করেছেন' ভাবতেই ভালোবাসেন। আর উসকে দেওয়ার জন্য আকাশ চোপড়ারা তো খাড়াই থাকেন এক পায়ে, 'ইশ, সাকিব যদি আজ কিউই হতো!'
তবে নির্মোহ বিশ্লেষণে গেলে কি সাকিব বঞ্চনার শিকার বলে সরলীকরণ করে ফেলা যাচ্ছে? আর সব ভুলে এই মৌসুমেই নজর দিন না! এমনিতে আইপিএল 'হল অব ফেম'-গোছের বানালে সুনীল নারাইনের জায়গাটা সেখানে অবধারিতই। তবে গত মৌসুমটা তাঁর ভালো যায়নি মোটেই। ৭.৯৫ ইকোনমি রেটে বল করে উইকেট নিয়েছিলেন মাত্র ৫টি। ২০২১ আইপিএলের শুরুতে তাই জায়গা হারিয়েছিলেন কলকাতার মূল একাদশ থেকে। হ্যাঁ, সাকিব আল হাসানের কাছেই।
সাধারণ ধারণা বলে, কোনো টুর্নামেন্টের শুরুর ম্যাচে যে একাদশটা নামানো হচ্ছে, কাগজে-কলমে ওই দলটাকেই নিজেদের সেরা বলে মনে করছে টিম ম্যানেজমেন্ট। সেই হিসাব-নিকাশে গেলে সাকিবকে যে এবার কলকাতা তাদের সেরা একাদশের একজন বলেই ভেবেছিল, তেমনটাই তো মনে হওয়ার কথা।
সাকিব কি শুরুতে পাওয়া সুযোগটা কাজে লাগাতে পেরেছিলেন? উত্তরটা নেতিবাচকই। প্রথম তিন ম্যাচে খেলে সাকিব ৩৯ বলে রান করেছিলেন ৩৮; বোলিংয়ে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট, ৮.১০ ইকোনমি রেটটাও তাঁর বিপক্ষেই সাক্ষ্য দিচ্ছিল।
নারাইনের তাই দলে ডাক পড়েছিল ফের। সুযোগটা তিনি দুহাত ভরেই লুফে নিয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত ৪৮ ওভার বল করে ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন মাত্র ৬.৪২। নিয়েছেন ১৪ উইকেটও। স্পিনারদের মধ্যে ইনিংসের শেষ পাঁচ ওভারে তাঁর চেয়ে বেশি বল করেননি কেউ, ওই পর্যায়ে ৬ ওভার বল করে রান দিয়েছেন মাত্র ৪২, উইকেট নিয়েছেন ৪টি। ব্যাট হাতে সেই ২০১৭ কিংবা ২০১৮ মৌসুমের নারাইন তিনি আর নেই, তবে দিল্লি ক্যাপিটালসের বিপক্ষে ১০ বলে ২১ রানের এক ছোট্ট ঝড়ে ঠিকই বুঝিয়েছিলেন, ক্যামিও খেলার অভ্যাসটা এখনো ভুলে যাননি। এমন পারফরম্যান্সের পর সাকিবের আর সুযোগ মেলে কিভাবে?
তবে এসব ক্রিকেটীয় যুক্তি মানার দিব্যি সমর্থকদের কে দিয়েছে? মোস্তাফিজ যতই বলুন, 'ওদের (কলকাতা) দুই-তিনটা স্পিনার আছে তো, এ কারণেই ভাইয়ের (সাকিব) একাদশে জায়গা পেতে একটু সময় লেগেছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে অনেক বিষয় থাকে। দলের সমন্বয়ের ব্যাপার থাকে। যারা খেলতে এসেছে, তারা সবাই ভালো, তাই না?', ভক্ত-আশেকানরা সাকিব দলে না থাকলে ওই ষড়যন্ত্র-তত্ত্বই সামনে দাঁড় করাচ্ছেন। আর রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে ম্যাচটায় নারাইন ৪ ওভারে ৩০ রান দিতেই তো শুরু হয়ে গেল, 'কলকাতা একাদশ থেকে নারাইন হটাও কর্মসূচি'।
তবে পরিহাসটা হচ্ছে, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে যে ম্যাচে সাকিবের পারফরম্যান্স ঘিরে ফেসবুকটা উৎসবময় হয়ে গেল, ঠিক ওই ম্যাচেই সুনীল নারাইনের পারফরম্যান্সটা মোটা দাগে এমন: বোলিংয়ে ৪ উইকেট, যার মধ্যে তিনটা আবার বিরাট কোহলি, এবি ডি ভিলিয়ার্স আর গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের (যে কৃতিত্ব এর আগে দেখিয়েছিলেন কেবল হারপ্রীত ব্রার); পরে ব্যাটিংয়ে নেমে প্রথম তিন বলেই মারা তিন ছক্কায় ম্যাচের ভাগ্য থেকে অনিশ্চয়তার ছায়া একরকম মুছেই দিয়েছেন। রবীন্দ্র জাদেজা এই আইপিএলের ১৯তম ম্যাচে ২২১.৪২ স্ট্রাইক রেটে ৬২ রান আর ৩-১৩ বোলিং ফিগারে বেঁধে দিয়েছিলেন আইপিএলে অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের বেঞ্চমার্ক; ওই পারফরম্যান্সকে ছুঁতে না পারলেও নারাইনের গতকালের পারফরম্যান্সে সেটার ধারেকাছে তো যাবেই। সাকিবের পারফরম্যান্সকে কোনোভাবেই খারাপ বলার সুযোগ নেই সত্যি, কিন্তু ব্যাটে-বলে এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের পাশে সাকিবের তো টিম টিম করেই জ্বলার কথা।
এত সবের মধ্যেই টুইটারে কে যেন লিখলেন, 'সাকিব যদি আর দশ কি.মি পশ্চিমে জন্মাতেন, তবেই আর (সৌরভ) গাঙ্গুলীর প্রাসঙ্গিকতা থাকত না।'
সুনীল নারাইন খুব সম্ভবত টুইটটা দেখেননি। নয়তো তাঁর মনে হতেই পারত, ভারতের পশ্চিমে না পাঠিয়ে স্রষ্টা তাঁকে কেন ভারতের পূর্বের দেশটায় পাঠালেন না!