নিউজিল্যান্ডের পাকিস্তান ট্যুর বাতিল
সেবার তো বোমা ফেটেছিল, এবার কী হয়েছে?
উৎপল শুভ্র
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১
নিউজিল্যান্ডের পাকিস্তান ট্যুর বাতিল করার সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে আনছে ২০০২ সালের স্মৃতি। পার্থক্য বলতে সেবার সিরিজের প্রায় ৯০ শতাংশ খেলা হয়ে গিয়েছিল, এবার তা শুরুই হতে পারেনি। পরের বছর নিউজিল্যান্ড যে আবার পাকিস্তানে গিয়েছিল, তাতে পরোক্ষ ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের।
চাইলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলতেই পারেন। ম্যাচ শুরুর কিছুক্ষণ আগে সফরই বাতিল! বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে উল্টো দেশে ফেরার জন্য নিউজিল্যান্ড দলের 'ফার্স্ট অ্যাভেইলেবল ফ্লাইট'-এর জন্য অপেক্ষা। ২০০২ সালে নিউজিল্যান্ডের পাকিস্তান সফরের সেই ঘটনাই যেন আবার ফিরে এলো প্রায় ১৯ বছর পর। পার্থক্য বলতে সেবার সিরিজের প্রায় ৯০ শতাংশই খেলা হয়ে গিয়েছিল, এবার তা শুরুই হতে পারল না।
বাংলাদেশে পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলে এখান থেকেই পাকিস্তান সফরে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড দল। রাওয়ালপিন্ডিতে ওয়ানডে দিয়ে আজই শুরু হওয়ার কথা ছিল এই সিরিজ। যাতে তিনটি ওয়ানডে খেলার পর নির্ধারিত ছিল পাঁচটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। অথচ প্রথম ম্যাচ শুরুর কিছুক্ষণ আগে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সফর বাতিলের ঘোষণা এলো নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের তরফ থেকে।
দুই দলের যখন মাঠে থাকার কথা, তখনো তারা হোটেলে। মাঠেও দর্শক ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। এসব থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিল, কোথাও কোনো একটা ঝামেলা বেঁধেছে। কিন্তু সেটি দেড় যুগ পর নিউজিল্যান্ড দলের পাকিস্তান সফর শুরু হওয়ার আগেই শেষ করে দেবে, এটা কারও কল্পনা করারও কথা নয়। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের এক বিবৃতি জানিয়ে দিল সেই অকল্পনীয় সিদ্ধান্তই। বঙ্গানুবাদ করলে যেটি এমন দাঁড়ায়, ‘পাকিস্তানের জন্য প্রযোজ্য নিউজিল্যান্ড সরকারের ‘হুমকির মাত্রা’ বেড়ে যাওয়া এবং মাঠে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্ল্যাকক্যাপসের এই সফর চালিয়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের প্রধান নির্বাহী ডেভিড হোয়াইট বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমি বুঝতে পারছি, পিসিবির জন্য বড় একটা ধাক্কা। তারা স্বাগতিক হিসেবে দারুণ ছিল। কিন্তু খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা সবার আগে এবং আমাদের বিশ্বাস, সেই দায়িত্বের জায়গা থেকে এ ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না।’
পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড এই সিদ্ধান্তে তাদের অসন্তোষের কথা গোপন রাখেনি। সিদ্ধান্তটা যে একপাক্ষিক, তা তো জানিয়ে দিয়েছেই; সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছে, নিউজিল্যান্ড দলের জন্য ‘নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা’র ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সঙ্গে এ-ও জানিয়েছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (ইমরান খান) স্বয়ং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছেন।
এসবে যে কাজ হয়নি, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে অনেক বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য ‘নিষিদ্ধ ভূমি’ হয়ে থাকতে হয়েছে। একটু-একটু করে যখন আবার পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, সেই সময়ে এই ঘটনায় আবারও আঁধার ঘনিয়ে এসেছে পাকিস্তানের ক্রিকেটাকাশে। আগামী মাসে ইংল্যান্ডের পুরুষ ও মহিলা দলের পাকিস্তান সফর করার কথা। নিউজিল্যান্ড সফর বাতিল করার পর ইসিবি জানিয়েছে, ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ওই ট্যুরের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে তারা। আগামী বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চে প্রায় ২০ বছর পর পাকিস্তান সফরে আসার কথা ছিল অস্ট্রেলিয়া দলের। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং নিউজিল্যান্ডের মহিলা দলের ট্যুরও আগামী কিছুদিনের ব্যস্ত সূচির অন্তর্ভূক্ত। সবই এখন সংশয়ের মেঘে ঢাকা পড়ে গেল।
মাত্রই পিসিবির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়া রমিজ রাজা রেগেমেগে টুইট করেছেন, 'কী পাগুলে একটা দিন! আমাদের সমর্থক ও খেলোয়াড়দের জন্য দুঃখ হচ্ছে। নিরাপত্তার হুমকির কথা বলে এককভাবে কোনো সফর বাতিল করাটা খুব হতাশাজনক। বিশেষ করে যখন তা আগে জানানোও হয় না! নিউজিল্যান্ড কোন দুনিয়ায় বাস করে! আইসিসিতে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে কথা হবে।'
নিরাপত্তা নিয়ে নিউজিল্যান্ড সরকার কী ধরনের হুমকি দেখেছে, রীতি অনুযায়ী তা সবিস্তারে হয়তো কখনোই জানানো হবে না। তবে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট আর ইসিবির নিরাপত্তা পরামর্শক সংস্থা একই, এই তথ্যটা নিশ্চিতভাবেই পিসিবির উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেবে।
লেখার শুরুতে ২০০২ সালে নিউজিল্যান্ডের পাকিস্তান সফরের কথা বলছিলাম। ১৯ বছর আগের সেই নিউজিল্যান্ড দলের কারও এই দলে থাকার কথা নয়। নেই-ও। তবে রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথম ওয়ানডে শুরুর কিছুক্ষণ আগে নিউজিল্যান্ডের পাকিস্তান সফর বাতিল হয়ে যাওয়াটা ফিরিয়ে আনছে সেই ট্যুরের স্মৃতি। সেবার তিন ওয়ানডে আর দুই টেস্ট খেলতে পাকিস্তান সফরে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। ট্যুরটা হওয়ার কথা ছিল আগের বছর। কিন্তু টুইন টাওয়ারে হামলার পর বদলে যাওয়া বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে যা পিছিয়ে যায়।
Crazy day it has been! Feel so sorry for the fans and our players. Walking out of the tour by taking a unilateral approach on a security threat is very frustrating. Especially when it’s not shared!! Which world is NZ living in??NZ will hear us at ICC.
— Ramiz Raja (@iramizraja) September 17, 2021
করাচিতে প্রথম ওয়ানডের সময় গ্যালারি থেকে মাঠে নুড়ি পাথর ছোঁড়ার বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা বাদ দিলে ভালোমতোই শেষ হয়েছিল তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। লাহোরে প্রথম টেস্টও ভালোয় ভালোয় শেষ হওয়ার পর করাচিতে দ্বিতীয় টেস্ট শুরুর দিন সকালেই ঘটে দুর্ঘটনা। টিম হোটেল পার্ল কন্টিনেন্টালের উল্টো দিকের রাস্তায় পার্ক করা গাড়িতে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। টার্গেট অবশ্য নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট টিম ছিল না। টার্গেট ছিল একটা সাবমেরিন প্রকল্পে কর্মরত ফরাসি নৌবাহিনীর একটা দল। বোমা বিস্ফোরণে তাৎক্ষণিকভাবেই ১০ জন ফরাসি নাগরিকের মৃত্যু ঘটে। আহত হয় আরও অনেকে।
পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ড দুই দলই তখন হোটেলে ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই টিম বাস রওনা হওয়ার কথা মাঠের উদ্দেশে। উল্টো সঙ্গে সঙ্গেই সফর বাতিল করে দেশে ফিরে যায় নিউজিল্যান্ড দল। পরের বছর পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ সিরিজ খেলতে পাকিস্তানে গিয়েছিল তারা। এবারের আগে সেটাই ছিল পাকিস্তানে নিউজিল্যান্ডের সর্বশেষ সফর। ২০০২ সালে শেষ টেস্ট না খেলেই নিউজিল্যান্ডের দেশে ফিরে যাওয়া এবং পরের বছর আবার টেস্টের বদলে ওয়ানডে খেলতে পাকিস্তানে যাওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের একটা পরোক্ষ ভূমিকা আছে।
করাচির ওই বোমা হামলার পরই প্রথমবারের মতো পাকিস্তানকে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে খেলার ব্যবস্থা করতে হয়। নিউজিল্যান্ড সফর শেষ হওয়ার কিছুদিন পরই অস্ট্রেলিয়া দলের পাকিস্তান সফর করার কথা ছিল। কিন্তু তারা পাকিস্তান যেতে রাজি না হওয়ায় সিরিজের দুটি টেস্ট আয়োজন করতে হয় কলম্বো এবং শারজায়। ১৯৯৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের কথা বাদ দিলে কলম্বোর ওই টেস্ট ম্যাচটি ছিল ১৯১২ সালে ইংল্যান্ডে ট্রায়াঙ্গুলার টেস্ট সিরিজের পর নিরপেক্ষ ভেন্যুতে দুই দলের প্রথম টেস্ট ম্যাচ। শ্রীলঙ্কা দলের ওপর হামলার পর তো যা পাকিস্তান ক্রিকেটের নিয়তিই হয়ে যায়।
তা এখানে বাংলাদেশ আসছে কোথায়? বাংলাদেশ আসছে, কারণ পাকিস্তানে আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেরানোয় বড় ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের। যখন কোনো দল পাকিস্তানে যেতে রাজি নয়, তখন বাংলাদেশ পাকিস্তান সফরে গিয়েছিল। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিন টেস্ট আর পাঁচ ওয়ানডের লম্বা একটা সিরিজ খেলার সুযোগও পেয়েছিল বাংলাদেশ এ কারণেই। বাংলাদেশের সিরিজটা ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছিল বলেই কিছুদিন পর আবার পাকিস্তান যেতে রাজি হয়েছিল নিউজিল্যান্ড।
২০০২ সালে নিউজিল্যান্ডের পাকিস্তান ট্যুর যেখানে শেষ হয়ে গিয়েছিল, ২০০৩ সালে বাংলাদেশের ট্যুর শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দুই দলই সেই পার্ল কন্টিনেন্টাল হোটেলেই ছিল। ওই ট্যুর কাভার করতে গিয়ে আমিও সেখানেই উঠেছিলাম। গভীর রাতে হোটেলে পৌঁছানোয় আশেপাশের কিছু চোখে পড়েনি। পরদিন সকালে হোটেলের এক কর্মীকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, বোমা বিস্ফোরণটা ঠিক কোথায় হয়েছিল। ঘটনাস্থল হোটেল থেকে এতটাই কাছে যে, নিউজিল্যান্ড দলের ট্যুর বাতিল করার কারণটাও বুঝতে পেরেছিলাম পরিষ্কার। এবার যা এখনো বুঝতে পারছি না।
ইনটেলিজেন্স নিশ্চয়ই এমন কোনো তথ্যই পেয়েছে, যাতে পাকিস্তান সরকারের ‘নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা’র ব্যবস্থাও নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের নিশ্চিত সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট বলে মনে হয়নি। নইলে কি আর একটা দেশে গিয়ে কয়েক দিন কাটানোর পর খেলা শুরুর ঠিক আগে ট্যুর বাতিল করে দেওয়া হয় নাকি!
পুরো ঘটনা জানতে অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। অবশ্য অপেক্ষা করেও যে জানা যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা আছে নাকি!