কোহলির এই ভারত যেখানে আলাদা
উৎপল শুভ্র
৭ সেপ্টেম্বর ২০২১
এমন দারুণ এক সিরিজ খেলছে ভারত-ইংল্যান্ড, টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা যা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। টেস্টপ্রেমী দুই অধিনায়কের যাতে বড় ভূমিকা। আইপিএল যুগের ক্রিকেটার হয়েও বিরাট কোহলি টেস্ট ক্রিকেটকে সবার উপরে তুলে রাখায় সবচেয়ে অগ্রণী। আর তাঁর দলও এমন হৃদয় দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটটা খেলে যে, মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না।
চরিত্রবিরুদ্ধ ব্যাটিং করে রোহিত শর্মার দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির কথা বলব, শার্দুল ঠাকুরের নামের যথার্থতা প্রমাণ করা, নাকি শেষ দিন লাঞ্চের পর জসপ্রীত বুমরার রিভার্স সুইংয়ের ওই দুর্দান্ত প্রদর্শনী..একটা দেখি আরেকটাকে ছাপিয়ে যেতে চায়! শেষের স্মৃতিই বেশি থাকে বলেই হয়তো শেষ পর্যন্ত বুমরার ৬ ওভারের জাদুকরী স্পেলটাই ঘুরে ফিরে চোখের সামনে আসছে। গেমচেঞ্জার তো ওই স্পেলটাই।
ওভাল টেস্ট শেষ হওয়ার বেশ কয়েক ঘণ্টা পর গভীর রাতে এই লেখাটা লিখতে বসেও তৃপ্তির একটা রেশ টের পাচ্ছি। ভারতের জয়ের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ইংল্যান্ড এভাবে জিতলেও একই রকম অনুভুতি হতো। ভারত-ইংল্যান্ড নিমিত্ত মাত্র, এই সিরিজে তো আসলে নিয়তই ঘোষিত হচ্ছে তৃতীয় পক্ষের জয়। ধন্দে পড়ে গেলেন? সেই তৃতীয় পক্ষের নাম টেস্ট ক্রিকেট। যা দেখতে দেখতে নতুন করে যার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। কী দারুণ একটা সিরিজই না হচ্ছে! চার টেস্ট শেষে স্কোরলাইন ২-১। পাঁচ টেস্ট সিরিজের সমাপ্তির জন্য আদর্শ এক মঞ্চ সাজিয়ে ডাকছে এখন ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডের শেষ টেস্ট। আহা, টেস্ট সিরিজ তো এমনই হওয়া উচিত।
চার টেস্টের শেষ তিনটিতেই রেজাল্ট হয়েছে। বৃষ্টি বাগড়া না দিলে নটিংহামে প্রথম টেস্টেও হয়তো হতো। বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া শেষ দিনের খেলা শুরুর আগে ভারতই ছিল ফেবারিট। লিখতে গিয়েই মনে হলো, এই সিরিজ কি এসব পূর্ব অনুমিত ফেবারিট-টেবারিটের ধার ধারছে নাকি! মনে করে দেখুন তো, ওভাল টেস্টের শেষ দিনে কে ফেবারিট ছিল? ৩৬৮ রান তাড়া করে টেস্ট জেতা সহজ ব্যাপার নয়, টেস্ট ইতিহাসে মাত্র নয়বার চতুর্থ ইনিংসে এত রান করে জয়ের হাসি হাসতে পেরেছে কোনো দল। তারপরও সূর্যস্নাত ওভালের উইকেট এমনই ব্যাটিংবান্ধব ছিল যে, সংখ্যাটা দুই অঙ্ক ছুঁয়ে ফেলাটা মোটেই অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল না। ইংল্যান্ডের ওপেনিং জুটিতেই সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়ার পর তো আরও না। অথচ শেষ পর্যন্ত কী হলে? ইংল্যান্ড হারল, এটাই শেষ কথা নয়। পরাজয়ের ব্যবধানটাও তো তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো।
লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্টের কথাও একটু মনে করে দেখুন না! শেষ দিনে তথাকথিত ফেবারিট ছিল কোন দল? নিজেকে হারিয়ে খোঁজা ঋষভ পন্ত আর বোলারদের চার উইকেট হাতে নিয়ে ভারত মাত্র ১৫৪ রানে এগিয়ে। কাগজে-কলমে ওই টেস্টে ইংল্যান্ডেরই জেতার সম্ভাবনাই কি বেশি ছিল না? মোহাম্মদ শামি আর জসপ্রীত বুমরাহ নবম উইকেটে ৮৯ রান করে ফেলবেন, বিরাট কোহলি ইংল্যান্ডকে অলআউট করার জন্য দুই সেশনই যথেষ্ট মনে করে ইনিংস ঘোষণা করতে ‘দেরি’ করবেন এবং বেশ কয়েকটা ওভার হাতে রেখেই জয়ের আনন্দে ভোঁ দৌড় দেবেন, দিনের শুরুতে কে ভেবেছিল অমন! এ কারণেই সেই টেস্ট ম্যাচ শেষে সুনীল গাভাস্কার যখন বললেন, জো রুট ব্যাটিং করার সময়টুকু ছাড়া এই টেস্টে ভারতের একচ্ছত্র প্রাধান্য ছিল, কথাটা খট করে কানে লেগেছিল। কানে লেগেছিল সিরিজ ৪-০ ভবিষ্যদ্বাণী করার সময় তা বলার ধরনটাও। লিডসে পরের টেস্টে ইংল্যান্ডের জয়ের পথে যাত্রা দেখে তাই এখন কী বলবেন সুনীল গাভাস্কার প্রশ্নটা না করে পারিনি।
এই সিরিজ টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি চিরন্তন প্রেম আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলেছিলাম না, তাতে বিরাট কোহলির এই ভারতীয় দলেরও বড় অবদান। ক্রিকেটের গ্রেট দলগুলোর দিকে যদি ফিরে তাকান, একটা জিনিস কমন পাবেন। যেকোনো পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। শুধু খেলোয়াড়ি দক্ষতাই যেটির একমাত্র পূর্বশর্ত নয়, মানসিক দৃঢ়তার ভূমিকা সম্ভবত এতে আরও বড়। কোহলির এই দল বারবারই তা দেখিয়ে আসছে। এই সিরিজেই তো একাধিকবার। লর্ডস টেস্টের কথা একটু আগেই বললাম। আর ওভালের স্মৃতি তো টাটকাই। প্রথম ইনিংসে ৯৯ রানে পিছিয়ে পড়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে অমন ব্যাটিং, এরপর বিনা উইকেটে ১০০ থেকে প্রতিপক্ষকে চোখের নিমিষে ৫ উইকেটে ১৪৬ বানিয়ে ফেলা...শেষে তো জয়ই। এটা তো শেষের গল্প। শুরুরটা কি মনে আছে? প্রথম দিন ভারত ৭ উইকেটে ১২৭, সেখান থেকে ১৯১ পর্যন্ত যাওয়াও তো টেস্ট ম্যাচ শেষে তাঁর দলের সবচেয়ে বড় গুণ হিসেবে কোহলির উল্লেখ করা ‘ক্যারেক্টার’-এর প্রমাণ।
এই টেস্টের সীমানা ছাড়িয়ে আরেকটু পিছিয়ে যান। লিডসের হেডিংলিতে এর আগের টেস্টেই তো ৭৮ রানে অলআউট হয়ে ইনিংসে হেরেছে ভারত। সেটি মনে রাখলে ওভালে এমন দুর্দান্তভাবে ফিরে আসায় আরও মহিমা যোগ হয়। সেই ফিরে আসার গল্প লেখাটাকে এই ভারত যেন অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে। কোহলির ভারত-কোহলির ভারত বলছি; কোহলি না থাকার পরও তো ভারত এমন করেছে। গত অস্ট্রেলিয়া ট্যুরের কথা মনে নেই? প্রথম টেস্টে ৩৬ রানে অলআউট হয়ে গেছে ভারত, কোহলি দেশে ফিরে গেছেন, তারপরও ওই ৩৬-এর ধ্বংসস্তুপ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পরের টেস্টেই জয়। সিরিজ শেষ টেস্টে যেতে যেতে অজিঙ্কা রাহানের ভারত ইনজুরিতে বিপর্যস্ত ভাঙাচোরা এক দল। সেই দলেরই ‘অস্ট্রেলিয়ান দূর্গ’ ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে সিরিজ জয় আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা রূপকথা ।
কে জানে, তাতেও হয়তো প্রচ্ছন্নভাবে ছিলেন কোহলি। অধিনায়কের মানসিকতা তো পুরো দলের মধ্যেই সঞ্চারিত হয়। তাঁর শরীরী উপস্থিতি না থাকলেই কি আর তা কর্পূরের মতো উবে যায়! কোহলি তাই না থেকেও ছিলেন। এই সিরিজটা এমন উপভোগ্য হওয়ার পেছনেও নিশ্চিতভাবেই তাঁর বড় অবদান। আইপিএল যুগের ক্রিকেটার হয়েও টেস্ট ক্রিকেটটাকে কোহলি হৃদয়ে ধারণ করেন। টেস্ট ক্রিকেটকে সবার উপরে তুলে ধরার কাজটাও তাঁর চেয়ে বেশি আর কেউ করেন বলে মনে করতে পারছি না। ইংল্যান্ড অধিনায়ক জো রুটও এই একটা ক্ষেত্রে কোহলিভাবাপন্ন। এই সিরিজটা জমে যাওয়ায় দুই অধিনায়কের টেস্টের প্রতি এই ভালোবাসারও হয়তো ভূমিকা আছে। হয়তো কেন, অবশ্যই আছে। ওভাল টেস্টের শেষ দিনের মাঝখানে এসে সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক নাসের হুসেইন যা মনে করিয়ে দিয়েছেন সবাইকে।
এই সিরিজটা দেখতে যে এমন ভালো লাগছে, তার আরেকটা কারণ হিসেবে মাঠের ক্রিকেটের সঙ্গে আবহটাও যোগ করুন। দর্শকে ভরা গ্যালারি, দুর্দান্ত ব্রডকাস্ট, দারুণ কমেন্ট্রি...সব মিলিয়ে টেলিভিশনে এই খেলা দেখাও আনন্দময় এক অভিজ্ঞতা। যে কারণে আমার একটা সমস্যাও হচ্ছে। একই সঙ্গে যখন দুটি খেলা চলে, মিরপুরের ওই ঘ্যানঘ্যানে পিচে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ম্যাচ থেকে চ্যানেল ঘুরিয়ে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট ম্যাচে উঁকি দিতে গেলে আর ফিরে আসতে ইচ্ছা করে না।
আবার একটু খেলায় ফিরি। জসপ্রীত বুমরাহর ওই স্পেলটার কথা তো একটু বলেছিই। তাঁর ২ উইকেটই তো তৈরি করে দিয়েছে ইংল্যান্ডের ৬ রানে ৪ উইকেট হারানোর ক্ষেত্র। এমন ব্যাটিং উইকেটে ২২ ওভারে মাত্র ২৭ রান দেওয়াটাও তো বিশ্বের অষ্টম বিস্ময় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার মতো।
শেষ দিনের টার্নিং পয়েন্ট অবশ্যই বুমরাহর ওই স্পেল। কিন্তু ম্যাচ-সেরা নির্বাচনের সময় তো পাঁচ দিনের বৃহত্তর চিত্রটা দেখতে হয়। তা দেখতে গেলে এই স্বীকৃতি পাওয়া রোহিত শর্মার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার কথা শার্দুল ঠাকুরের। বুমরাহর ২ উইকেট যেমন গেমচেঞ্জার, প্রথম ইনিংসে শার্দুল ঠাকুরের ইনিংসটাও কি তাই নয়! ৩৭ বলে ৫৭ বললেও যা কিছুটা বোঝা যায়। আরও বোঝা যায় ইংল্যান্ডের মাটিতে এটা দ্রুততম (৩১ বলে) টেস্ট হাফ সেঞ্চুরি বললে। ওই ইনিংসটা না হলে ইংল্যান্ডের লিড ১৫০-৬০ হয়, বদলে যায় টেস্টের চেহারা।
দ্বিতীয় ইনিংসে ৭২ বলে ৬০ রানের মহিমাও কম নাকি! যে কারণে দলে নেওয়া হয়েছে তাঁকে, সেই বোলিংয়ে মাত্র ৩ উইকেট। কিন্তু উইকেটগুলো দেখুন না! প্রথম ইনিংসে একমাত্র উইকেটটি ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ স্কোরার ওলি পোপের। দ্বিতীয় ইনিংসের দুই উইকেটের প্রথমটিতে ম্যাচ বের করে নিয়ে যাওয়া ওপেনিং জুটি ভেঙেছে, দ্বিতীয়টিতে ফিরেছেন এই ইংল্যান্ড দলের ব্যাটিংয়ের প্রাণভোমরা জো রুট। সিরিজের আগের তিন টেস্টেই যাঁর সেঞ্চুরি।
ব্যাটে-বলে এমন যাঁর অবদান, মোহাম্মদ শামি ফিট থাকলে তাঁর হয়তো খেলার সুযোগ হয় না। এই যে সুযোগ পেলেই হাত তুলে দাঁড়িয়ে যাওয়া...এটাও মনে হয় এই ভারতীয় দলের আরেকটা ট্রেডমার্ক।