ল্যান্স ক্লুজনার: আশ্চর্য এক অভিষেক
উৎপল শুভ্র
৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
যে অভিষেক ঘিরে কেটেছিল অনেক নির্ঘুম রাত, সেই অভিষেকটা হয়ে যেতে বসেছিল দুঃস্বপ্নের আরেক নাম। মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের কাছে প্রথম ইনিংসে মার খেয়েছিলেন বেধড়ক। দ্বিতীয় ইনিংসে ল্যান্স ক্লুজনার ফিরেছিলেন স্বরূপে। ইতিহাসের তৃতীয় বোলার হিসেবে টেস্ট অভিষেকে নিয়েছিলেন ইনিংসে ৮ উইকেট।
প্রথম প্রকাশ: ২ ডিসেম্বর ১৯৯৬। ভোরের কাগজ।
এমন বর্ণময়, এমন নাটকীয় অভিষেকের তুলনা খুঁজে পাওয়া কঠিন। একেবারে খুঁজে না পাওয়ার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছর জন্ম নেওয়া ল্যান্স ক্লুজনারকে কলকাতা টেস্টের দলে নেওয়া নিয়েই অনেকের ভুরু কপালে উঠে গিয়েছিল। কারণ সে জন্য বাদ দিতে হয়েছিল ফানি ডি ভিলিয়ার্সকে। বব উলমার যত বড় ক্রিকেট বিজ্ঞানীই হোক না কেন, তিনি যে ভুল করেছেন, ভারতের প্রথম ইনিংসের পর এই বিশ্বাসে সবাই মোটামুটি নিঃসংশয়। ১৪ ওভারে ৭৫ রান দিয়ে উইকেট নেই। তার ওপর আজহারের হাতে ওই বেধড়ক মার।
টানা পাঁচটি বল বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কতটা শক্ত জায়গা, তার একটা পরিষ্কার ছবি এঁকে দিয়েছিলেন আজহার। মাত্র দু'দিন পর স্বীকার করতেই হচ্ছে, সেই ছবিটা মনে গেঁথে নিয়েছিলেন ক্লজনার। বারবার তা দেখেছেন এবং মুষড়ে পড়ার পরিবর্তে ওরকম ছবির চিত্রকর হয়ে ওঠার প্রতিজ্ঞায় অনুপ্রাণিত করেছেন নিজেকে। এখন আর বলার প্রয়োজন নেই যে, নাটালের এই ২৫ বছর বয়সী ফাস্ট বোলার পুরোপুরি সফল।
প্রথম ইনিংসে তাঁর দুঃস্বপ্নের স্রষ্টা মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনকে আউট করেছেন দ্বিতীয় ইনিংসে। ৮ উইকেটের মধ্যে এটাকেই সবচেয়ে স্মরণীয় বলার কারণ ছিল। কিন্তু ল্যান্স ক্লুজনার জানালেন, 'আজহারের উইকেটটি নিশ্চয়ই অন্য রকম একটা তৃপ্তি। তবে সবচেয়ে স্মরণীয় উইকেট নয়ন মঙ্গিয়ারটিই।'
কেন?
'আরে, ওটাই তো আমার প্রথম টেস্ট উইকেট।'
সেই প্রথম উইকেটটি আসতে এত দেরি হয়েছে বলেই তা আরও বেশি স্মরণীয়। প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুটাও ছিল শুধুই হতাশার। অধিনায়ক হানসি ক্রনিয়ে জানালেন, '৫ ওভার পর ও আমার কাছে এসে এক রকম ভেঙেই পড়েছিল। বলছিল, "এই দিনটির জন্য এত অপেক্ষা, অথচ যেদিন টেস্ট অভিষেক হলো, কোনো কিছুই আমার পক্ষে যাচ্ছে না"।' যোগ্য অধিনায়কের মতো ক্রনিয়ে তাঁকে সাহস দিয়ে ছিলেন। এরপর দ্বিতীয় স্পেলে দ্বিতীয় ওভারেই পুরস্কার, টেস্টে প্রথম উইকেট পেলেন ক্লুজনার। এরপর থেকে যেন হয়ে গেলেন অন্য বোলার। দ্বিতীয় ইনিংসে অ্যালান ডোনাল্ড নেই জেনেই বিরাট এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। ল্যান্স ক্লুজনারকে তাঁরা পাত্তাই দেননি। অথচ খেলা শেষে দু'দলের অধিনায়ক ও ম্যানেজার ছাড়া একমাত্র যাঁকে প্রেস কনফারেন্সে আসতে হলো, তিনি ল্যান্স ক্লুজনার।
ইডেন গার্ডেনসে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডের চেয়েও বড় ব্যাপার, টেস্ট অভিষেকেই ইনিংসে ৮ উইকেট নেওয়া মাত্র তৃতীয় বোলার তিনি। এর আগে যে দুজন এই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, তাঁদের একজন খেলেছেন এই টেস্টে। নরেন্দ্র হিরওয়ানি। ১৯৮৭-৮৮ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাদ্রাজে টেস্ট অভিষেকে দুই ইনিংসেই ৮টি করে উইকেট নিয়েছিলেন হিরওয়ানি (৮/৫১ ও ৮/৭৫)। ১৩৬ রানে ১৬ উইকেট টেস্ট অভিষেকে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। অভিষেক টেস্টে ইনিংসে ৮ উইকেট নেওয়া অন্য বোলারও দুই ইনিংসেই দেখিয়েছিলেন এই কৃতিত্ব। বব ম্যাসি ১৯৭২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে তাঁর ১৬ উইকেট এসেছিল ১৩৭ রানে (৮/৮৪ ও ৮/৫৩)।
প্রথম ইনিংসের দুঃস্বপ্নের পরই ক্লুজনার জানিয়েছিলেন, 'অ্যালান ডোনান্ড ও ফানি ডি ভিলিয়ার্সের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে।' পরামর্শ নিয়েছেন এবং তা কাজেও এসেছে। অ্যালান ডোনাল্ড তাঁর আদর্শ। ক্লুজনারের 'আইডল' ডোনাল্ড ছাড়া আর মাত্র দুজন দক্ষিণ আফ্ৰিকান বোলারের ইনিংসে ৮ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব আছে। এরা দুজন হিউ টেফিল্ড (৯-১১৩ বিপক্ষ ইংল্যান্ড, জোহানেসবার্গ, ১৯৫৬-৫৭) ও এসি স্নুক (৮-৭০, বিপক্ষ ইংল্যান্ড, জোহানেসবার্গ ১৯০৫-০৬)।
ডোনাল্ডের ইনিংসে ৮ উইকেট এসেছে গত বছর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে। এমন একটা অভিষেক স্বপ্নেও ভাবেননি ক্লুজনার। 'ভারতে আসার আগে জানতাম, এখানে ভালো করাটা খুব কঠিন হবে, কারণ এই দেশ ফাস্ট বোলারদের জন্য নয়। এরপর প্ৰথম ইনিংসে আমি টের পেলাম, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আসলে কী! বিশ্বমানের ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে বোলিং করাটা কত কঠিন। এসবের পর এই পারফরম্যান্সের অনুভূতি সত্যিই বলে বোঝা যাবে না'-- বললেন তিনি। এর আগে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে একবারই ইনিংসে ৮ উইকেট নেওয়ার তৃপ্তি পেয়েছিলেন ক্লুজনার। এমন একটা অভিষেকের পরও তাঁর কাছ থেকে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার ছিনিয়ে নেওয়া গ্যারি কারস্টেনের দল ওয়েস্টার্ন প্রভিন্সের বিপক্ষে ৩১ রানে ৮ উইকেট। দক্ষিণ আফ্রিকা 'এ' দলের পক্ষে নিয়মিত সাফল্যের পুরস্কার ছিল ক্লুজনারের টেস্ট দলে জায়গা পাওয়া।
টাইটান কাপে ব্যাট হাতে তার সামর্থ্যেরও প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। তারপরও মূলত বোলিংকেই ধ্যানজ্ঞান করে রাখতে চান, নিজেকে অলরাউন্ডার হিসেবে দাবি করতে হলে ব্যাটিংয়ের পেছনে আরও পরিশ্রম করতে হবে, এটা তাঁরই কথা। তবে অলরাউন্ডার হিসেবে না হলেও একটা ব্যাপার এখন নিশ্চিত। সে কথাটি সবার হয়ে বলে দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকান কোচ বব উপমার, 'এই ছেলেটি অনেক দূর যাবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দারুণ এক ক্যারিয়ার অপেক্ষা করছে ওর জন্য।'
আরও পড়ুন:
এ দিনটি কীভাবে ভুলবেন ক্লুজনার!
বিশ্বকাপের ট্র্যাজিক হিরো