শচীনের মুখে শচীনের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির গল্প
শচীন টেন্ডুলকার
১৫ আগস্ট ২০২১
সেঞ্চুরি এক সময় মুড়িমুড়কির মতোই হয়ে গিয়েছিল তাঁর কাছে। তারপরও `প্রথম`-এর একটা আলাদা মহিমা চিরদিনই থাকে। শচীন টেন্ডুলকারের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরিটি এসেছিল ১৯৯০ সালের এই দিনে। ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্ট বাঁচানো ওই সেঞ্চুরি নিয়ে আত্মজীবনীতে কী লিখেছেন তিনি? শুনুন শচীনের মুখেই।
মনোজ প্রভাকর যখন ক্রিজে আমার সঙ্গে যোগ দিল, ম্যাচ বাঁচানোর জন্য আমাদের তখন একটা জুটির খুব প্রয়োজন। ওই ইনিংসের শুরুতে ভাগ্যের সহায়তাও আমি পেয়েছিলাম। একটা অন ড্রাইভ খেলতে চেয়েছিলাম, বাইরের কানায় লেগে ক্যাচমতো উঠে গিয়েছিল। ভাগ্য ভালো, এডি হেমিংস বলটা হাতে জমাতে পারেনি। আমি সে মুহূর্তেই পণ করি, আর কোনো বল ওপরে তুলে খেলব না। সঙ্গে অবশ্য এই সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম, খোলসে ঢুকে না গিয়ে শট খেলব। কেননা, অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক হয়ে গেলে ইংল্যান্ড আমার ব্যাটের আশেপাশে ফিল্ডারের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে। রান করতে থাকলেই বরং ফিল্ডারদের দূরে রাখা সহজ হবে।
বেশির ভাগ সময়ই আমি পাঞ্চ শটে রান করতে চেয়েছি, যেহেতু এই শটটা সবচেয়ে কম ঝুঁকিতে খেলা যায়। রক্ষণ আর আক্রমণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষাও জরুরি ছিল, এ জন্য প্রতিটা বল আমাকে অখণ্ড মনোযোগে খেলতে হচ্ছিল। খেলতে খেলতে ফিফটিতে পৌঁছালেও সেটা আমার মাঝে কোনো ভাবান্তর ঘটায়নি। কেননা, ম্যাচ বাঁচানো তখনও বহু দূরের পথ, আর সেটাকেই আমি লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে ফেলেছি।
অন্য প্রান্তে প্রভাকরও বেশ ভালোই খেলছিল। আর কিছু সময় পরেই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম, আমাদের প্রথম মিশন সফল, ইংলিশ বোলাররা হতাশায় পড়ে গেছে। ম্যাচ বাঁচানোর ক্ষেত্রে এমন ছোট ছোট টার্গেট বেঁধে নেওয়াটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ্যটা হতে পারে পরবর্তী পাঁচ ওভার, কিংবা এক ঘণ্টা বা পরবর্তী সেশনটা ব্যাট করার।
এক সেশনের কাছাকাছি সময় ধরে যদি উইকেট না দেওয়া যায়, ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ যতই প্রতিপক্ষের হাতে থাকুক না কেন, তারা চাপ অনুভব করতে বাধ্য। সময় ফুরিয়ে আসছিল বলে ইংলিশদের মাঝে অস্থিরতাও বাড়ছিল ক্রমশ।
যখন ৯০ রান অতিক্রম করলাম, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই সেঞ্চুরির ভাবনা মাথায় ভর করতে শুরু করেছিল। হাজার হোক, এটা আমার প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি হবে, আর দর্শকরাও তেমন কিছুরই প্রত্যাশা করতে শুরু করে দিয়েছিল। সব দেখে-টেখে নিউজিল্যান্ডে যে ভুলটা করেছি (এর মাস ছয়েক আগে নেপিয়ারে ৮৮ রানে আউট হয়ে গিয়েছিলেন শচীন), সেটা নিজেকে মনে করিয়ে দিলাম, এবং ওই ভুলের পুনরাবৃত্তি না করার সংকল্পও নিলাম। দিনের খেলা শেষ হতে তখনও বেশ কিছুটা সময় বাকি ছিল এবং আমি যদি তখন আউট হয়ে যেতাম, তো ইংল্যান্ড আবারও জয়ের জন্য ঝাঁপাতে পারত।
মধ্য-নব্বইয়ে অ্যাঙ্গাস ফ্রেজারের বলে আমি আরও একবার ভাগ্যের আনুকূল্য পাই। ও একটা বাউন্সার ছুড়েছিল, আমি ডাক করলেও ব্যাটটাকে মাথার ওপরে পেরিস্কোপের মতো করে তুলে রেখেছিলাম। বলটা ব্যাটে লেগে ফাইন লেগের দিকে চলে যায়, কিন্তু সেদিন ভাগ্য খারাপ হলে ক্লোজ-ইন পজিশনে দাঁড়ানো যেকোনো ফিল্ডারের হাতেই বলটা জমতে পারত। ওল্ড ট্রাফোর্ডে ভাগ্য আমাকে এভাবে বারেবারেই সাহায্য করেছে। ভাগ্যের এমন দয়াদাক্ষিণ্য পাচ্ছিলাম বলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদও জানাচ্ছিলাম।
আর ইনিংস জুড়েই আমি ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে ব্যাট করেছি। ৯৮-তে দাঁড়িয়ে অ্যাঙ্গাস ফ্রেজারের বলটা মিড অফ দিয়ে পাঞ্চ করি আমি, ক্রিস লুইস বলটা বাউন্ডারিতে পৌঁছানোর আগেই থামানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করে সফলও হয়েছিল। তবে এর আগেই তিন রান নিয়ে ফেলেছিলাম আমরা। দর্শকরা আমাকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন, কিন্তু তাদের আমি কিভাবে জবাব দেব, তা জানা ছিল না বলে খুব অস্বস্তিতে ভুগছিলাম। এরকম অবস্থায় আমি এর আগে কখনো পড়িনি, তাই ব্যাট তুলতেও আমার প্রচণ্ড সংকোচ হচ্ছিল।
যতবার ওল্ড ট্রাফোর্ডে সেঞ্চুরির পরের ছবিটা আমার সামনে আসে, আমি বুঝতে পারি, উদযাপন ব্যাপারটা আমার সহজাত নয়। তবে সময় যত গড়িয়েছে, ক্রিজে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার ব্যাপারে আমি আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়েছি। ক্রিজে থাকা এক জিনিস, তবে মানুষকে নিজের উপস্থিতি বোঝানোটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকতে হলে নিজের উপস্থিতি বোঝানোটা খুব জরুরি। এটা হলো শরীরী ভাষার মাধ্যমে চতুর্দিকে আত্মবিশ্বাস ছড়ানো। ভিভ রিচার্ডসের দিকে তাকালে যেটা আপনি টের পাবেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আরও কয়েক বছর কাটিয়ে, আরও কিছু সেঞ্চুরির পরে আমার মধ্যেও সেই ব্যাপারটা আসতে শুরু করে। নিজের উপস্থিতির ব্যাপারে আমিও যখন অনেক বেশি বিশ্বাসী হতে শুরু করি, নিজের একটা `সিগনেচার সেলিব্রেশন`-ও আমি তৈরি করে নিই। তখনই ড্রেসিংরুমের দিকে ব্যাট উঁচিয়ে আমি উদযাপন শুরু করি। বেশির ভাগ ক্রিকেটারই উদযাপনের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব স্টাইলটা ফুটিয়ে তুলতে চায়। যেমন, শেন ওয়ার্ন বা গ্লেন ম্যাকগ্রা ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেওয়ার পর বলটা দর্শকদের দিকে দেখিয়ে উদযাপন করত।
ওল্ড ট্রাফোর্ডের ইনিংসে যদি ফিরি, সেঞ্চুরি করেও আমি দায়িত্ব শেষ ভাবিনি। এভাবে প্রতিটা ওভার পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাচের সম্ভাব্য ফলের খাতায় আরও বেশি করে ড্র লেখা হতে শুরু করে। ম্যাচটা যখন শেষমেশ ড্র ঘোষণা করা হলো, তখনো বাধ্যতামূলক দুই ওভারের খেলা বাকি ছিল। ততক্ষণে আমরা আর কোনো উইকেট না হারিয়ে ৩৪৩ রানে পৌঁছেছি, প্রভাকর আর আমার জুটিটাও ১৬০ রান ছুঁয়েছে বলে ইংলিশরা কোটা পূরণের আগেই হাল ছেড়ে দেয়।
মনে আছে, প্যাভিলিয়নে ফেরার পথটায় দর্শকরা দাঁড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন। ম্যাচের দুই আম্পায়ার, জন হ্যাম্পশায়ার ও জন হোল্ডার, সেঞ্চুরিতে পৌঁছানোর পর আমাকে অভিবাদন জানিয়েছিলেন। ইংলিশ ক্রিকেটাররাও আমাকে ভালো ভালো কথা বলে যাচ্ছিল। ড্রেসিংরুমে পৌঁছেও সতীর্থদের করতালির বৃষ্টিতে সিক্ত হই আমি। শুধু প্রথম সেঞ্চুরিই তো নয়, সারাদিন ব্যাট করে দলকে পরাজয়ের হাত থেকেও বাঁচিয়েছিলাম। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো পুরো এক দিন ব্যাট করেছিলাম আমি। তবে প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বারেই বেশি তৃপ্তি পেয়েছিলাম। কারণ, পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটায় আমি সহযোগীর ভূমিকায় থাকলেও এখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রেই আমাকে খেলতে হয়েছিল।
একটা ক্লান্তিকর দিন কাটিয়ে যখন আমি বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছি, আমাকে জানানো হলো, মিডিয়ার মুখোমুখি হতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে হাজির হওয়াটা আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক অনুভূতি ছিল। আমাদের ম্যানেজার মাধব মন্ত্রীকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, `সংবাদ সম্মেলনে হাজির হওয়াটা বাধ্যতামূলক নাকি এটা এড়িয়ে গেলেও পারি?` উনি ১৯৫০ সালে ভারতীয় দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফর করেছিলেন, অভিজ্ঞতা থেকেই আমাকে নিশ্চিত করলেন যে, এটা রুটিন ব্যাপার। কেবল ম্যাচ আর পারফরম্যান্স নিয়েই সাংবাদিকরা আমাকে কিছু প্রশ্ন করবেন। সতীর্থরা যদিও আমাকে ভয় দেখাতে শুরু করল। বলল, সাংবাদিকরা নাকি এমন এমন প্রশ্ন করবে যে, আমি বিপাকেই পড়ে যাব। আমি অবশ্য ম্যানেজারের কথাই শুনেছিলাম, আর অভিজ্ঞতাটা উপভোগও করেছিলাম। শুরুতে যদিও ইতস্তত বোধ হচ্ছিল, তবে ব্যাপারটা খুবই সহজ। নিজের ভাবনা শেয়ার করা তো খুব কঠিন কোনো কাজ নয়, তাই না? আর প্রখ্যাত ক্রিকেট-লেখকদের কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েও বেশ ভালো লাগছিল।
এর আগেই আমাকে প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ ঘোষণা করা হয়। সংবাদ সম্মেলন সামলানোর মতো এই পুরস্কারটাও আমাকে প্রথমের স্বাদ দিয়েছিল। একই সঙ্গে, আমি আরও একবার হতবুদ্ধিকর অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলাম। পুরস্কার হিসেবে শ্যাম্পেনের বোতল পেয়েছিলাম, কিন্তু তখনো আঠারো হইনি বলে সেটা পানের অনুমতি ছিল না। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে আমি কেবল সৌজন্যতাটুকু সমাপ্তির ক্ষণ গুনছিলাম আর ড্রেসিংরুমে যত দ্রুত সম্ভব ফেরত যেতে চাইছিলাম। ওই শ্যাম্পেনের বোতলটা আমি ড্রেসিংরুমেও খুলিনি। বোতলটা বিলেত থেকে মুম্বাই পর্যন্ত বয়ে এনে আমার মেয়ে সারার প্রথম জন্মদিনে খুলি, ততদিনে ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৯৯৮ সাল চলে এসেছে।
ম্যাচ শেষে হোটেলে ফিরে আমি বাড়ির ফোন পাই। মনে আছে, প্রায় ৩০/৪০ জন লোকের সঙ্গে এক নাগাড়ে কথা বলতে হয়েছিল আমাকে। আমার বন্ধু-বান্ধবরা নিজে থেকেই আমার এক প্রতিবেশীর বাড়িতে আমার সেঞ্চুরি উদযাপন করতে জড়ো হয়েছিল। অস্বীকার করব না, পুরো পাড়া আমার অর্জনে উল্লসিত শুনে বেশ রোমাঞ্চিত অনুভব করেছিলাম। কেউ কেউ তো রসিকতা করতেও ছাড়েনি, `তুমি এখনো আঠারো হওনি বলে শ্যাম্পেনের স্বাদ নিতে পারছ না, আমরাই তোমার হয়ে সেই স্বাদ নিচ্ছি।`
তিনজন মানুষের কথা আলাদা করে বলাটা জরুরি মনে হচ্ছে। প্রথম দুজন আমার বাবা-মা, আমার পারফরম্যান্সে তাঁরা খুব খুব খুশি হয়েছিলেন। আর তৃতীয়জন আমার ভাই অজিত, আমার সাফল্যটা তো তাঁরও অর্জন ছিল।
* শচীন টেন্ডুলকারের আত্মজীবনী `প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে` থেকে ভাষান্তর: রিজওয়ান রেহমান সাদিদ