বাংলাদেশ-কেনিয়া ফাইনাল-১

ট্রফি আর বাংলাদেশের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন স্টিভ টিকোলো

আইসিসি ট্রফি ১৯৯৭

উৎপল শুভ্র

১২ এপ্রিল ২০২১

ট্রফি আর বাংলাদেশের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন স্টিভ টিকোলো

আইসিসি ট্রফির ফাইনালে দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন স্টিভ টিকোলো

বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেছে। কেনিয়ার বিপক্ষে ফাইনালটি ছিল আইসিসি ট্রফি জিতে সেই আনন্দকে পূর্ণতা দেওয়ার ম্যাচ। কিন্তু স্টিভ টিকোলোর ১৪৭ রানের অসাধারণ এক ইনিংসে ধূসর হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের সেই স্বপ্ন। দ্বিতীয় দিনে গড়ানো ফাইনাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল বড় এক চ্যালেঞ্জের প্রতিশব্দ।

প্রথম প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ১৯৯৭। ভোরের কাগজ।

কেনিয়া: ৫০ ওভারে ২৪১/৭

মরিস ওদুম্বে গতবার যা করেছিলেন, এবার তা করলেন স্টিভ টিকোলো। বিধ্বংসী এক সেঞ্চুরি করে নাইরোবিতে বাংলাদেশের সর্বনাশ করেছিলেন ওদুম্বে। স্টিভ টিকোলোও তা করলেন কি না, তা বোঝা যাবে আজ। তবে কেনিয়াকে প্রথমবারের মতো আইসিসি ট্রফি জয়ের পথে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছেন তিনি। মরিস ওদুম্বে আর স্টিভ টিকোলোই কেনিয়া দলের সেরা দুই ব্যাটসম্যান এবং এঁরা দুজনই কাল বাংলাদেশের স্বপ্নের পথে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালেন।

ফাইনালে উঠেই বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করেছে বাংলাদেশ, পূরণ হয়েছে একটা স্বপ্ন। কিন্তু আইসিসি ট্রফি জয়ের মাধ্যমে সেই স্বপ্নপূরণের আনন্দকে পূর্ণতা দেওয়ার যে নতুন স্বপ্নটা দেখেছিল বাংলাদেশ, তার সঙ্গে মানানসই পারফরম্যান্স দেখা গেল না কাল বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে। আগের ম্যাচগুলোতে ফিল্ডিংয়ে যে দারুণ উন্নতির নমুনা রেখেছিলেন খেলোয়াড়েরা, ফাইনালে দেখা গেল আবার পেছনে হাঁটতে শুরু করেছেন তাঁরা। মালয়েশিয়ার বিপক্ষে শেষ গ্রুপ ম্যাচে বাজে ফিল্ডিং করেছিল বাংলাদেশ দল। দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত, প্রতিপক্ষ দুর্বল–এসব কারণে খেলোয়াড়েরা একটু রিল্যাক্সড ছিলেন বলে সেই ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনামুখর না হলেও চলত। কিন্তু কাল তাঁরা যেভাবে পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খারাপ ফিল্ডিং করলেন, তা নিজের চোখে দেখেও অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। একমাত্র দুর্জয় ছাড়া বাকি কেউই বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন, এমন একটি দলের খেলোয়াড়ের মতো ফিল্ডিং করতে পারেননি। এমনকি দলের অন্যতম সেরা ফিল্ডার হিসেবে বিবেচিত বুলবুল ও মনি পর্যন্ত এই অপরাধে অপরাধী। বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করেই কি তবে ক্রিকেটাররা দায়িত্ব শেষ বলে মনে করলেন?

ক্রিকেটাররা মানছেন না। মানছে না টিম ম্যানেজমেন্টও। হতে পারে, খেলোয়াড়েরা যথেষ্টই সিরিয়াস, কিন্তু গত প্রায় এক মাস ধরে প্রচণ্ড মানসিক চাপ এবং এরপর বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নপূরণ–এই দুটি মিলিয়ে স্বাভাবিকভাবেই যে ক্লান্তি ভর করেছে, সেটাই কালকের বাজে পারফরম্যান্সের কারণ। তারপরও বাংলাদেশের সামনে ২৪১ রানের ছোটখাটো একটা পাহাড় দাঁড়িয়ে যেত না, যদি স্টিভ টিকোলো তাঁর সেরা ফর্মে প্রকাশিত হওয়ার জন্য ফাইনালটিকেই বেছে না নিতেন। ফাইনালের আগে এবারের টুর্নামেন্টে ৯ ম্যাচ খেলে ২টি ফিফটিসহ (সর্বোচ্চ ৯৩) ২৫২ রান করেছেন টিকোলো। কিন্তু যে মানের ব্যাটসম্যান তিনি, তাতে এটাকে হতাশাজনক পারফরম্যান্সই বলেই মনে করছিল কেনিয়া দল। ফাইনালের আগের দিন অধিনায়ক মরিস ওদুম্বে বলছিলেন, ‌‘স্টিভ টিকোলো এবার এখনও সেরা খেলা খেলতে পারেনি। একদিন তো ও ভালো খেলবেই।’

সেই একদিনটি হলো ফাইনাল। স্বপ্নের মতো একটা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের। অথচ দিনশেষে বাংলাদেশ দলকে কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ নিয়ে হোটেলে ফেরত পাঠিয়েছেন স্টিভ টিকোলো একাই। ১৫ রানে ২ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ব্যাট করতে নেমেছিলেন টিকোলো, ১৯তম ওভারে স্কোর পরিণত হয় ৩ উইকেটে ৫৮ রানে। সেখান থেকে কেনিয়াকে বেশ নিশ্চিন্ত একটা অবস্থানে নিয়ে গেছে স্টিভ টিকোলোর ব্যাট। অধিনায়ক মরিস ওদুম্বের সঙ্গে চতুর্থ উইকেট জুটিতে ১৩৮ রান তুলে ম্যাচের চেহারা বদলে দেওয়ার মূলেও তাঁর প্রায় একক ভূমিকা। ফাইনালের আগে ৯ ম্যাচে ৪৫০ রান করা মরিস ওদুম্বেকে কালই প্রথম ম্লান মনে হলো। তিনি খারাপ খেলেছেন, তা নয়। কিন্তু স্টিভ টিকোলোর ব্যাটের ছটা এমনই উজ্জ্বল ছিল যে, ম্লান মনে হয়েছে ওদুম্বেকে।

লং অফে সাইফুলকে ক্যাচ দেওয়ার মাধ্যমে শেষ হয়েছে স্টিভ টিকোলোর ১৪৭ রানের ইনিংসটি। উইকেটের চারপাশে প্রায় সব শট খেলেছেন। ১২টি বাউন্ডারি মেরেছেন, মেরেছেন ৩টি ছক্কাও। ছক্কা তিনটি দুর্জয়, রফিক ও সাইফুলের বলে। দুর্জয়কে মেরেছেন স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে। রফিকেরটি সোজা মাথার ওপর দিয়ে, এরপর তৃতীয় ছক্কাটি মারতে কাভারের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন সাইফুলকে।

বাংলাদেশের ফিল্ডিং অবশ্য সরাসরিই সাহায্য করেছে স্টিভ টিকোলোকে। আকরামের করা ইনিংসের ৪০তম ওভারে লং অফে ক্যাচ দিয়েছিলেন, শান্ত ফেলে দিয়েছেন সেই ক্যাচ। স্টিভ টিকোলোর রান তখন ৮২, কেনিয়ার ৩ উইকেটে ১৪৭। পরের বলেই আবারও টিকোলোর ক্যাচ পড়ে, এবার পয়েন্টে তা ফেলেন বুলবুল। আকরামের ওই ওভারটি ছিল ঘটনাবহুল। পরপর দুই বলে ক্যাচ দিয়েও স্টিভ টিকোলোর বেঁচে যাওয়ার আগের বলটিতেই মরিস ওদুম্বে অল্পের জন্য রক্ষা পান রান আউটের দুর্ভাগ্য থেকে। টিকোলো আউট হওয়ার আগে করেছেন আরও ৬৫ রান। ৪৯তম ওভারে সুজনের বলে লং অফে সাইফুলকে ক্যাচ দেওয়ার মাধ্যমে শেষ হয় তাঁর ১৪৭ রানের ইনিংসটি। উইকেটের চারপাশে প্রায় সব শট খেলেছেন স্টিভ টিকোলো। ১২টি বাউন্ডারি মেরেছেন, মেরেছেন ৩টি ছক্কাও। ছক্কা তিনটি দুর্জয়, রফিক ও সাইফুলের বলে। দুর্জয়কে মেরেছেন স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে। রফিকেরটি সোজা মাথার ওপর দিয়ে, এরপর তৃতীয় ছক্কাটি মারতে কাভারের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন সাইফুলকে।

এই সাইফুলই দুর্দান্ত এক ওপেনিং স্পেলের মাধ্যমে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন কেনিয়াকে। প্রথম ওভারের প্রথম চারটি বলে কোনো রান দেননি, পঞ্চম বলে বোল্ড করে দেন পিঞ্চ হিটার হিসেবে নামা আসিফ করিমকে। সপ্তম ওভারে ( তাঁর চতুর্থ) দারুণ একটি ইনকাটারে এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলেন কেনেডি ওটিয়েনোকে। ১৫ রানে ২ উইকেট পড়ার পর সন্দ্বীপ গুপ্তর সঙ্গে ৪৩ রানের জুটি গড়ে ইনিংসে কিছুটা স্থিতি দেওয়ার পথে এগোন স্টিভ টিকোলো। ৭ ওভারের প্রথম স্পেলে মাত্র ১৮ রান দিয়ে ২ উইকেট নেওয়া সাইফুলের জায়গায় বোলিং করতে আসা সুজন বিদায় করেন সন্দ্বীপ গুপ্তকে। এরপরই শুরু হয় টিকোলো-ওদুম্বে অধ্যায়। টিকোলোকে দারুণ মেজাজে দেখে ওদুম্বে খুব বেশি মারমুখো হননি, বাউন্ডারি মেরেছেন মাত্র ৩টি। তারপরও যে ৪৩ রান করতে মাত্র ৫৩ বল লেগেছে তাঁর, এর মূল কারণ দুর্দান্ত রানিং বিটুইন দ্য উইকেট। টিকোলো ও ওদুম্বের পার্টনারশিপের সময় রানিং বিটুইন দ্য উইকেট ছিল পুরোপুরি বিশ্বমানের। এ কারণে চাপের মধ্যে পড়ে আরও এলোমেলো হয়ে গেছে বাংলাদেশের ফিল্ডিং, ওভার থ্রোও হয়েছে বেশ কবার।

টুর্নামেন্টে এটি ছিল পাইলটের ২৩তম ডিসমিসাল (১২টি ক্যাচ ও ১১টি স্টাম্পিং)। যা আইসিসি ট্রফির এক আসরে সর্বোচ্চ ডিসমিসালের রেকর্ড। তবে এই রেকর্ড নিয়ে উল্লাস করার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না দলের কারও। তখন যে আগামী দিনের কঠিন কাজটির কথা ভাবছে সবাই।

স্টিভ টিকোলোর কৃতিত্বকে সামান্যও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে আকরামের বাজে একটি দিন যথেষ্ট সাহায্য করেছে তাঁকে। টিকোলো ও ওদুম্বে যখন খেলছিলেন, তখন বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল উইকেটের। ওপেনিং স্পেলে দারুণ বোলিং করা সাইফুল ও শান্তকে ফিরিয়ে আনাটাই তখন যুক্তিযুক্ত হতো। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়া বোলার রফিককেও পুরো ব্যবহার করেননি আকরাম। পরশু ম্যানেজার গাজী আশরাফ হোসেন লিপু বলেছিলেন, কেনিয়াকে কোনোভাবেই হাতে ৫/৬ উইকেট নিয়ে শেষ ১০ ওভার শুরু করতে দিতে চান না তিনি। অথচ কাল শেষ ১০ ওভারে ঢোকার আগে কেনিয়ার হাতে ছিল ৭ উইকেট। এরপর যে শেষ ১০ ওভারে ৮৮ রান তুলেছে তারা, এটিকে কম বলেই মানতে হবে। রফিক ৪৬তম ওভারটিতে উইকেট-মেডেন নেওয়ার দারুণ কৃতিত্ব দেখানোর পরও শেষ ৫ ওভারে রান উঠেছে ৪৫। শুরুর এই তিনটি উইকেট হারানোর পর স্বাভাবিকভাবেই ধীরে সুস্থে এগিয়েছে কেনিয়া। ২৫ ওভার শেষে তাদের স্কোর ছিল ৩ উইকেটে ৮৪, ১০০ এসেছে ২৯.১ ওভারে। তখন আর একটি উইকেটই ধ্বংসের পথে এগিয়ে দিতে পারত ইনিংসটিকে।

সেই উইকেটটি এসেছে অনেক পরে, ৪৬তম ওভারে রফিককে ডাউন দ্য উইকেট মারতে গিয়ে স্টাম্পিংয়ের শিকার হয়েছেন মরিস ওদুম্বে। ইনিংসের শেষ বলে রফিক তাঁর তৃতীয় উইকেটটিও নিয়েছেন পাইলটের সহায়তায়। এবারের টুর্নামেন্টে এটি ছিল পাইলটের ২৩তম ডিসমিসাল (১২টি ক্যাচ ও ১১টি স্টাম্পিং)। যা আইসিসি ট্রফির এক আসরে সর্বোচ্চ ডিসমিসালের রেকর্ড। তবে এই রেকর্ড নিয়ে উল্লাস করার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না দলের কারও। তখন যে আগামী দিনের কঠিন কাজটির কথা ভাবছে সবাই।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×