বাংলাদেশ-কেনিয়া ফাইনাল-২
সম্মিলিত প্রয়াসে পাওয়া জয়
আইসিসি ট্রফি ১৯৯৭
উৎপল শুভ্র
১২ এপ্রিল ২০২১
বৃষ্টির কারণে বাংলাদেশের ইনিংস ২৫ ওভারে সংক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু টার্গেটটা মোটেই সহজতর হয়নি। ২৫ ওভারে ১৬৬ রান, সেই সময়ের বিবেচনায় যথেষ্টই কঠিন ছিল। কিন্তু ওপেনিং নামা রফিকের ঝোড়ো ব্যাটিং সুর বেঁধে দেয় বাংলাদেশের ইনিংসের। তারপরও জিততে হয়েছিল শেষ বলে নেওয়া লেগ বাইয়ে। কেনিয়ার বিপক্ষে সেই ফাইনাল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অমর এক রূপকথা।
প্রথম প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ১৯৯৭। ভোরের কাগজ।
কেনিয়া: ৫০ ওভারে ২৪১/৭। বাংলাদেশ: ২৫ ওভারে ১৬৬/৮। ফল: বাংলাদেশ ২ উইকেটে জয়ী (বৃষ্টির জন্য টার্গেট পুনঃনির্ধারিত)
বৃষ্টির কারণে ইনিংস সংক্ষিপ্ততর হয়ে গেলে বাংলাদেশের কাজটা কিছুটা সহজ হবে বলে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু ৫০ ওভারে ২৪২ রানের তুলনায় ২৫ ওভারে ১৬৬ রানের টার্গেটটাকে সহজ বলে মানা একটু কঠিনই। আগের দিন মাঠে কাটানো বাজে সময়টার দুঃস্বপ্নের সঙ্গে সকাল থেকে খেলা শুরু হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আরেকটু ক্লান্ত করে দেওয়া জন্য যথেষ্ট ছিল। খেলা শুরুর পর অবশ্য তা বোঝা যায়নি। বাংলাদেশ দলের যে বিস্ময়কর ব্যাটিং গভীরতা, তাতে কোনো টার্গেটই অনর্জনযোগ্য বলে আগেই হাল ছেড়ে দেওয়ার কারণ নেই। কিন্তু স্লো উইকেট, ভারি আউটফিল্ড, প্রতিপক্ষ টুর্নামেন্টের সেরা ফিল্ডিং সাইড হিসেবে স্বীকৃত–এই সব কিছু মিলে ১৬৬ রানকে অনেক দূরের মনে হচ্ছিল।
সেই ১৬৬ বাংলাদেশের হাতে ধরা দিয়েছে। ৬.৬৪ আস্কিং রানরেটের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কঠিন কাজটা করার জন্য কাউকে না কাউকে জীবনের সেরা খেলাটা খেলতে হবে, এটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও ভেবেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটিং গভীরতার প্রমাণ দিতেই যেন কেউই এককভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন না। নিয়মিত ওপেনার আতহার ১১ নম্বরে ব্যাট করার প্রতীক্ষায় ছিলেন, সেমিফাইনালে পাইলট হঠাৎ করে জ্বলে ওঠার পর এটি বিস্ময়ের নতুন কারণে পরিণত হলো কাল প্রেসবক্সে উপস্থিতি বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে।
বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল দারুণ একটা শুরুর। ২৫ ওভারের ইনিংসে ত্রিশগজী বৃত্তের বাইরে মাত্র দুজন ফিল্ডার থাকতে পারার বাধ্যবাধকতা ছিল মাত্র ৭ ওভারের জন্য। আর কিলাতের আড়াআড়ি দৈর্ঘ্য এত কম যে, রফিকের জন্য এটি স্বপ্নের মাঠ। রফিক তাঁর কাজ ঠিকই করেছেন, যদিও বাংলাদেশের শুরুটা ছিল ভয়াবহ। প্রথম বলেই দুর্জয়কে বোল্ড করে দেন মার্টিন সুজি। দুর্জয়ের দ্রুত রান করার ক্ষমতা আছে, এই আউটটি ছিল তাই বিরাট এক ধাক্কা। সেই ধাক্কা সামলে বাংলাদেশকে আবার লক্ষ্যের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে রফিক-নান্নুর দ্বিতীয় উইকেট জুটি।
মুখোমুখি হওয়া তৃতীয় বলটি মিড উইকেটে পুল করে ৩ রান নেন নান্নু। বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে রান ওঠে প্রথম। পরের ওভার পুরোটাই খেলেছেন তিনি। রফিক স্ট্রাইক পান তৃতীয় ওভারের প্রথম বলে। সেটিতে সিঙ্গেল নিয়ে শুরু রফিকের। তিন বল পর আবার যখন স্ট্রাইক পেলেন, স্বমহিমায় প্রকাশিত হলেন বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার। লং অফের ওপর দিয়ে মারা ছক্কাটির পরই মিড উইকেট দিয়ে চার। মার্টিন সুজির সেই ওভারে এলো ১২, ১১-ই রফিকের ব্যাট থেকে। পরের ওভারে নান্নুও কাজে নামলেন। স্টিভ টিকোলোর তিন বলের মধ্যে মারলেন দুটি বাউন্ডারি, প্রথমটি লেগ গ্ল্যান্স ও পরেরটি কাভার ড্রাইভ করে। সে ওভারটিতে ১১ রান, ৪ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়াল ৩১ রানে। সুজির পরের ওভারে মাত্র ৩ আসায় ৫ ওভার শেষে রান ১ উইকেটে ৩৮।
টিকোলো ১২ রান দেওয়ায় তাঁর জায়গায় বোলিং করতে আসেন টমাস ওডোয়ো। তাঁকেও ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার কোনো কারণ দেখেননি রফিক। ১১ রান তুলেছেন সেই ওভার থেকে। কাভার ড্রাইভ করে মেরেছেন ১টি করে চার ও ছয়। রফিকের ব্যাটিং রীতিমতো আতঙ্কে ডুবিয়ে দিয়েছিল কেনিয়াকে, সেই আতঙ্ক থেকে তারা মুক্তি পেয়ে যায় পরের ওভারেই। ৬.৪ ওভারে বাংলাদেশের ফিফটি পূর্ণ হওয়ার পরের বলটিই উড়িয়ে মারতে গিয়ে টাইমিংয়ে সমস্যা হয় রফিকের। বল উঠে যায় মিড অনের অনেক ওপরে, মরিস ওদুম্বে দারুণ এক ক্যাচ নিয়ে সমাপ্তি টানেন রফিকের রোমাঞ্চকর ব্যাটিং প্রদর্শর্নীর। কেনিয়ানরা দারুণ ফিল্ডিং করেছে। শুধু রফিকই নন, তাঁর সঙ্গে দ্বিতীয় উইকেটে ৫০ রানের পার্টনারশিপ গড়া নান্নু, এবং এরপর আকরাম ও মনিকেও তাঁরা ফিরিয়ে দিয়েছে দারুণ ক্যাচের মাধ্যমে। দশম ওভারে ডিপ পয়েন্ট বিজাল প্যাটেল পিছলে পড়ে যাওয়ার পরও ঠিকই হাতে রাখেন নান্নুর ক্যাচটি। ৩৩ বলে ২৬ রান করা নান্নুর বিদায়ে ৬৩ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে পথ হারিয়ে ফেলার শঙ্কায় পড়ে যায় বাংলাদেশ। অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক মিলে তা থেকে টেনে তুলেছেন দলকে।
বুলবুল ও আকরামের ৫৩ রানের চতুর্থ উইকেট জুটিটি মাত্র ৫২ বলে গড়া। স্বচ্ছন্দে খেলছিলেন এঁরা দুজন, রানও আসছিল চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই। বাঁহাতি স্পিনার আসিফ করিমের প্রথম ওভারেই বিশাল এক ছক্কা হাঁকান আকরাম, লং অনের ওপর দিয়ে বল গিয়ে পড়ে মাঠের বাইরে। এর আগে অনডিয়কের করা ত্রয়োদশ ওভারের প্রথম চারটি বলে রান না নিতে পারার ঝাল মেটান বোলারস ব্যাক ড্রাইভের মাধ্যমে বাউন্ডারি মেরে। আকরামের ইনিংসে সীমানা পেরোনো শট এই দুটিই।
বুলবুলের ইনিংসেও তাই। স্টিভ টিকোলোকে এক্সট্রা কাভারের মাথার ওপর দিয়ে ড্রাইভ করে চারটি মেরেছেন তিনি, এরপর আসিফ করিমকে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে উড়িয়ে ফেলেছেন মাঠের বাইরে। এই ছক্কাটির মাধ্যমে ১৮.২ ওভারে বাংলাদেশের রান পৌঁছে যায় ১১৬-তে। ৪০ বলে ৫০ রান প্রয়োজন–হাতে ৭ উইকেট থাকায় ম্যাচ তখন বাংলাদেশের পক্ষেই কথা বলার জন্য উন্মুখ। কিন্তু ছক্কা মারার পরের বলটিতেই লাইনের আড়াআড়ি খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান বুলবুল।
সহসাই প্রবলভাবে ম্যাচে ফিরে আসে কেনিয়া। এমন অবিস্মরণীয় জয় দিয়ে শেষটা না হলে অনেক দিন ও সময় অহেতুক ওই শটটি খেলতে যাওয়ার আক্ষেপ পুড়ে মরতে হতো বুলবুলকে।
ওয়ানডেতে যা হয়, একটা উইকেটই হঠাৎ করে পাল্টে দেয় ম্যাচের রং। কাল বুলবুলের আউটটিও তাই করেছিল। পরের ওভারেই আকরাম প্রতিপক্ষ অধিনায়ক মরিস ওদুম্বের অফ স্পিনে ডিপ কভারে ক্যাচ দিলে বাংলাদেশ পরিণত হয় ৫ উইকেটে ১২১ রানে। তা ৬ উইকেটে ১২৩ হতে বেশি সময় লাগেনি। পরের ওভারেই আসিফ করিমকে স্পিনসহ মারার সুবিধা নিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন মনি, স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারিতে দাঁড়ানো সন্দীপ গুপ্ত অনেকটা লাফিয়ে দারুণ এক ক্যাচ নেন। উইকেট পড়লে রানের গতিতে ভাটা আসবেই। তাই শেষ ৫ ওভারে বাংলাদেশের যেখানে প্রয়োজন ছিল ৪৫ রানের, শেষ ৪ ওভারে তা মাত্র ৫ রান কমে। ২১তম ওভারে মনিকে হারিয়ে ৫ রান পায় বাংলাদেশ, শেষ ৪ ওভারে তাই প্রয়োজন দাঁড়ায় ৪০ রানের।
মার্টিন সুজির বল শান্তর প্যাডে লেগে শর্ট ফাইন লেগের দিকে রওনা হতে না হতেই নন স্ট্রাইকার পাইলট অন্য প্রান্তে পৌঁছে যান। অনেক দূরে থেকেও বুঝতে পারছিলাম, কিলাতের মতো পুরো বাংলাদেশও তখন ফেটে পড়েছে আনন্দে!
মরিস ওদুম্বের করা ২২তম ওভারে ৭ রান নেন সাইফুল ও পাইলট। শেষ ৩ ওভারে ৩৩ রানের কঠিন লক্ষ্যটা ২ ওভারে ১৯ রানে নেমে আসে আসিফ করিমের করা ২৩তম ওভারে সাইফুল ও পাইলটের দুটি ছক্কার কারণে। প্রথম বলটি মিড উইকেটের ওপর দিয়ে উড়িয়ে বাইরে ফেলার পর দ্বিতীয় বলেও তা করতে গিয়ে মিড অনের ফিল্ডারকে খুঁজে পান সাইফুল। ওভারের শেষ বলটিতে পাইলটের ছক্কাটিও মিড উইকেটের ওপর দিয়ে। সে ওভারে ১৪ রান শেষ ২ ওভারের লক্ষ্য দাঁড় করায় ১৯ রান।
ওদুম্বের করা ২৪তম ওভারের প্রথম বলে বাউন্ডারি মেরে ১২ বলে ১৯ রানের প্রয়োজনকে ১১ বলে ১৫-তে পরিণত করেন সুজন। পরের বলটি ডট, তৃতীয় বলটি ডাউন দ্য উইকেট খেলতে গিয়ে তিনি স্টাম্পিংয়ের শিকার। বাকি ৩ বলে ৪ রান। ১১ রানের প্রয়োজন নিয়ে অবিস্মরণীয় শেষ ওভারটি শুরু করে বাংলাদেশ। দলের অভিজ্ঞতম বোলার মার্টিন সুজির শরণাপন্ন হয়েছিলেন মরিস ওদুম্বে। কিন্তু সাহস আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে সুজির অভিজ্ঞতাকে মূল্যহীন প্রমাণ করেছেন পাইলট। প্রথম বলটিকে সোজা বোলারের মাথার ওপর দিয়ে সীমানার বাইরে ফেলে পাইলট কেনিয়াকেও ম্যাচের বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছেন বলে মনে হয়েছিল।
কিন্তু নাটকীয়তার শেষ হয়নি তখনও। দ্বিতীয় বলে রান হয়নি, তৃতীয় বলটি ওয়াইড, একটি সিঙ্গেল নিয়ে পাইলট স্ট্রাইক দেন শান্তকে। চতুর্থ বলটি খেলতে পারেননি শান্ত। পঞ্চম বলটিতেই বাংলাদেশ জিতে যেতে পারত, কিন্তু শান্তর মিড উইকেটে ড্রাইভ স্লো আউটফিল্ডের কারণে বাউন্ডারির পরিবর্তে মাত্র ২ রান আনতে পারে। শেষ বলে তাই বাংলাদেশের প্রয়োজন পড়ে ১ রান। মার্টিন সুজির বল শান্তর প্যাডে লেগে শর্ট ফাইন লেগের দিকে রওনা হতে না হতেই নন স্ট্রাইকার পাইলট অন্য প্রান্তে পৌঁছে যান। অনেক দূরে থেকেও বুঝতে পারছিলাম, কিলাতের মতো পুরো বাংলাদেশও তখন ফেটে পড়েছে আনন্দে!