জিমি নিশামের লর্ডস-দুঃখে একটু প্রলেপ
উৎপল শুভ্র
১১ নভেম্বর ২০২১
ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড ম্যাচে তো দেখা যাচ্ছে, প্রশ্নাতীত বলে কিছু নেই। তা খেলাটা ৫০ ওভারের হোক, বা ২০ ওভারের। লর্ডসেই হোক, বা আবুধাবিতে। সাদা বলে ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড মানেই রোমাঞ্চ আনলিমিটেড!
ইংল্যান্ড ইনিংসের শেষ বলে এউইন মরগানের ক্যাচ ফেললেন গ্লেন ফিলিপস্। আউট হওয়ার বদলে উল্টো মরগানের ২ রান। ক্রিকেটে এমন তো কতই হয়, তারপরও নোটবুকে তা লাল কালিতে লিখে রেখেছিলাম কেন?
কারণ, এই ২ রানই যদি শেষ পর্যন্ত নির্ধারক হয়ে যায়! হতেই তো পারত। এই দুই দলের খেলা মানেই তো সুক্ষ্মতম ব্যবধানে জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি। কখনো কখনো তা রানে বা উইকেটেও নয়, বাউন্ডারি কম-বেশি মারার ভিত্তিতেও।
কোন ম্যাচের কথা বলছি, এটা মনে হয় না কারোর বোঝার বাকি আছে। সোয়া দুই বছর আগের ম্যাচ, কিন্তু এমনই অবিশ্বাস্য এক ম্যাচ যে, সময় যাতে ধুলার আস্তরণ ফেলতে ব্যর্থ। যেটির স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে। এই ম্যাচের আগে তো এসেছে আরও বেশি। ম্যাচ চলার সময়েও।
সেটা ছিল ফাইনাল আর এটাতে ‘ফাইনাল’ কথাটার আগে ‘সেমি’ বসানো। তারপরও আবুধাবির শেখ জায়েদ স্টেডিয়াম কতবারই না ফিরিয়ে নিয়ে গেছে লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। সোয়া দুই বছর আগে ৫০ ওভারের সেই বিশ্বকাপ ফাইনালে। ১০০ ওভার শেষে টাই। টাই সুপার ওভার শেষেও। সুপার ওভারেও ‘টাই’য়ের সম্ভাবনার সময়ই আবিষ্কৃত টুর্নামেন্টের ওই অদ্ভুত নিয়ম। সুপার ওভারও দুই দলকে আলাদা করতে না পারলে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে দুই দলের ইনিংসের বাউন্ডারি-সংখ্যায়। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাইয়ের সেই ফাইনালের স্কোরকার্ড খুললে দেখবেন, রেজাল্ট ‘টাই’-ই লেখা আছে। কিভাবে লেখা হবে ওই অদ্ভুত মীমাংসার কথা, ইংল্যান্ড জিতেছে ২৬-১৭ বাউন্ডারিতে?
ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি, ৫০ ওভার আর ২০ ওভার, ফাইনাল আর সেমিফাইনাল...এত সব পার্থক্যের পরও আবুধাবির ম্যাচটা লর্ডসের দীর্ঘ ছায়ায় ঢেকে যাওয়ার একটাই কারণ। দল দুটির নাম ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ড। কী আশ্চর্য, লর্ডসের মতো এখানেও দুই আম্পায়ারের নাম কিনা কুমারা ধর্মসেনা ও মারাইস ইরাসমাস!
এই ম্যাচটাও সুপার ওভারে গড়ালে আদিদৈবিক কিছুতে বিশ্বাস এসে যাওয়াটা তাই মোটেই অস্বাভাবিক কিছু হতো না। শেষ পর্যন্ত তা তো হয়ইনি, বরং এক ওভার বাকি থাকতেই লর্ডসের দুঃস্বপ্নকে কবর দেওয়ার কাজটা করে ফেলেছে নিউজিল্যান্ড। লর্ডসের মতো অত নাটকীয় অবশ্যই নয়। তবে লর্ডস তো ঘটে হয়তো শতাব্দীতে একবার। লর্ডস ভুলে আলাদাভাবে বিচার করলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের এই সেমিফাইনালটাও কি নাটকীয়তার স্কেলে একেবারে কম নাম্বার পাবে নাকি!
শেষ চার ওভারে নিউজিল্যান্ডের দরকার ৫৭ রান। পুরুষদের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এর আগে কোনো দল যা করতে পারেনি। শেষ চার ওভারে সবচেয়ে বেশি রান তুলে জেতার রেকর্ড ছিল এতদিন ৫৬ রান। ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে যা করেছিল অস্ট্রেলিয়া। এ বছরই স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে যেটির পুনরাবৃত্তি করেছে জিম্বাবুয়ে।
সেন্ট লুসিয়ার সেমিফাইনালে ওই অসাধ্য সাধন করেছিলেন মাইক হাসি। আবুধাবিতে সেটিকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার কাজটা কে করলেন? ড্যারিল মিচেলের কথাই হয়তো সবচেয়ে বেশি শোনা যাবে এই প্রশ্নের উত্তরে। ৪৭ বলে অপরাজিত ৭২ রানের ইনিংসে তুলির শেষ আচড়টা দিয়েছেন এই ওপেনার। ম্যাচ-সেরার পুরস্কারও উঠেছে তাঁর হাতেই। মিচেল না থাকলেও হয়তো হতো না। তবে ইংল্যান্ডের হাতের মুঠো থেকে ম্যাচটা ছিনিয়ে নেওয়ার কাজটা তো করেছেন আসলে জিমি নিশাম। শেষ চার ওভারে ৫৭ রানের 'অসম্ভব' এমন ছেলেখেলা হয়ে গেছে ১৭তম ওভারে নিশামের প্রলয় নাচনেই। ক্রিস জর্ডানের সেই ওভার থেকেই ২৩ রান। ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে এর আগে-পরের বাকি সবকিছু মুছে দিয়েছে ওই ওভারটাই।
পরের ওভারের শেষ বলে নিশাম যখন আউট হয়ে ফিরছেন, নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন নেমে এসেছে ২ ওভারে ২০ রানে। নিশামের ১১ বলে ২৭ রানের ইনিংসে ৩টি ছক্কাতে শুধু বলই সীমানার বাইরে আছড়ে পড়েনি, ইংল্যান্ডও উড়ে গেছে ম্যাচ থেকে। সেটিও কোন উইকেটে? টু-পেসড, বল যেখানে ব্যাটে আসছিল না।
লেখাটা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে, এক ফাঁকে জিমি নিশামের টুইটার হ্যান্ডলে একটা উঁকি মেরে আসলে হতো। এমন মজার মজার সব টুইট করেন, এই জয়ের পর না জানি কী করেছেন! লর্ডস ফাইনালের কোনো রেফারেন্স কি থাকবে? সম্ভাবনা তো আছেই। বাউন্ডারি বেশি মারা-কম মারার হিসাবে বিশ্বকাপ ট্রফি হারিয়ে ফেলাটা নিউজিল্যান্ডের পুরো দলের জন্যই গভীর এক বেদনা হয়ে আছে। জিমি নিশামের জন্য বোধ হয় একটু বেশিই। সুপার ওভারে তিনিই তো নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে গিয়েছিলেন জয়ের দুয়ারে। ওই পরাজয় নিয়ে করা টুইটটাতেও মজা ছিল, যাতে লুকিয়ে ছিল কান্না, 'বাচ্চারা, আর যা-ই করো, খেলাকে জীবনের অংশ করো না। তোমরা চাইলে বরং কেক বানাও, বা অন্য কিছু করো। ৬০ বছর বয়সে মোটা এবং সুখী একজন মানুষ হিসেবে মরতে পারবে।'
লর্ডসের সেই সুপার ওভারে জোফরা আর্চারের দ্বিতীয় বলেই নিশামের ছক্কা, ওভারের প্রথম পাঁচটা বলই খেলে ১৩ রান। সঙ্গে একটা ওয়াইড যোগ হয়ে নিউজিল্যান্ডের রান হয়ে গিয়েছিল ১৪। শেষ বলটাতেই শুধু স্ট্রাইকে মার্টিন গাপটিল। যাতে দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে রান আউট। লর্ডসে অমর সেই দৃশ্যের জন্ম। হতাশায় নুয়ে পড়া গাপটিল আর নিশামকে পশ্চাৎপটে রেখে ইংলিশদের উন্মাতাল আনন্দে ভেসে যাওয়া।
এই সেমিফাইনালেও গাপটিলের ওপরই বেশি নির্ভরতা ছিল নিউজিল্যান্ডের। ইংল্যান্ডের ছুঁড়ে দেওয়া ১৬৭ রানের টার্গেট ছুঁতে চাহিদা ছিল একটা ঝোড়ো সূচনার। অথচ একটা চার মেরেই কিনা শেষ গাপটিলের সেমিফাইনাল! কিছুক্ষণের মধ্যেই নিউজিল্যান্ডকে ১৩ রানে রেখে কেন উইলিয়ামসনও যখন তাঁর অনুগামী; ম্যাচে তখন প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। পঞ্চম বোলার লিয়াম লিভিংস্টোন ৪ ওভারে মাত্র ২২ রান দিয়ে কনওয়ে ও ফিলিপসকে তুলে নেওয়ার মাধ্যমে যা আরও বেশি প্রশ্নাতীত করে দিয়েছেন বলেই মনে হয়েছিল তখন।
প্রশ্নাতীত? ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড ম্যাচে তো দেখা যাচ্ছে, প্রশ্নাতীত বলে কিছু নেই। তা খেলাটা ৫০ ওভারের হোক, বা ২০ ওভারের। লর্ডসেই হোক, বা আবুধাবিতে। সাদা বলে ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড মানেই রোমাঞ্চ আনলিমিটেড!