টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সর্বনিম্ন স্কোর
দুঃস্বপ্ন থেকে আরও বড় দুঃস্বপ্নে
উৎপল শুভ্র
১ সেপ্টেম্বর ২০২১
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সর্বনিম্ন রানের তালিকার প্রথম তিনটিতেই প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। এর মধ্যে সবচেয়ে কম ৭০ রান ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে। যে ম্যাচে মোস্তাফিজুর রহমানের ৫ উইকেট নেওয়ার আনন্দ মুছে গিয়েছিল ব্যাটিং ব্যর্থতায়।
প্রথম প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০১৬। প্রথম আলো।
নিউজিল্যান্ড: ২০ ওভারে ১৪৫/৮। বাংলাদেশ: ১৫.৪ ওভারে ৭০। ফল: নিউজিল্যান্ড ৭৫ রানে জয়ী।
এটি ছিল দুঃস্বপ্ন ভোলার ম্যাচ। কে জানত, সেটি আরও বড় দুঃস্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষা করছে! চিন্নাস্বামীতে শেষ তিন বলের দুঃখে প্রলেপ দেওয়ার পরিবর্তে ইডেন আরও অমানিশায় ডুবিয়ে দেবে বাংলাদেশ দলকে!
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বৃহত্তর ছবিতে এই ম্যাচের সামান্যতম গুরুত্বও ছিল না। জিতুক-হারুক, নিউজিল্যান্ডের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনাল খেলা একরকম নিশ্চিতই ছিল। বাংলাদেশ দলের ম্যাচের পরদিন সকালেই ফিরতি ফ্লাইটে চড়াও।
হ্যাঁ, পাওয়ার কিছু ছিল। শেষটা ভালো করে একটু খুশিমনে দেশে ফেরা। সেখানে কিনা টি-টোয়েন্টিতে নিজেদের সর্বনিম্ন রানে অলআউট!
বাংলাদেশ করেছে ৭০, পরাজয়ের ব্যবধান ৭৫ রান। নিজেদের স্কোরের চেয়ে পরাজয়ের ব্যবধান বেশি—বাংলাদেশের পারফরম্যান্স বোঝাতে আর কী লাগে! চিন্নাস্বামীর দুঃখ ছিল হাতের মুঠো থেকে জয় ফেলে দেওয়ার। এখানে দুঃখ-টুঃখ শব্দের কোনো স্থান নেই। হতবাক হয়ে গেলে অনুভূতি কাজ করে নাকি!
ইডেনের একটা টাওয়ারের সব বাতি হঠাৎ নিভে যাওয়ায় খেলা বন্ধ থাকল ১১ মিনিট। খেলা আর না হলেও কিছু আসত-যেত না। বাংলাদেশের ইনিংসের ‘বাতি’ যে এর আগেই নিভে গেছে। ১১ ওভার শেষে স্কোর তখন ৬ উইকেটে ৪৫। আবার খেলা শুরু হওয়ার পর কৌতূহল যদি কিছু অবশিষ্ট থেকে থাকে, তা একটাই। ছয় বছর আগে হ্যামিল্টনে এই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই ৭৮ রানের স্কোরটা কি পেরোনো যাবে?
সেটিও হলো না। চিরকাল উপমহাদেশীয় কন্ডিশনে হাবুডুবু খাওয়া নিউজিল্যান্ড এই বিশ্বকাপে উপমহাদেশের দলগুলোকেই উল্টো ক্রিকেট-পাঠ দিচ্ছে। সেই ক্রিকেট-পাঠের নাম—ধীরগতির টার্নিং উইকেটে কীভাবে খেলতে হয়। নাগপুরে ভারতকে দিয়েছে। ভারতের ওই বিখ্যাত ব্যাটিং লাইনআপ যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে মাত্র ৭৯ রানে। কলকাতায় দিল বাংলাদেশকে।
চারটি ভিন্ন মাঠে চারটি ম্যাচ। অথচ নিউজিল্যান্ড এমনভাবে খেলছে যেন, সব কটিই তাদের হোম ভেন্যু! এই উইকেট, এই ভ্যাপসা গরম সবকিছুর সঙ্গেই তাদের দীর্ঘ পরিচয়! শুধু স্কোর কাছাকাছি বলে নয়, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ভারত আর বাংলাদেশের ম্যাচ দুটির মিল আছে। উইকেটের চরিত্র বুঝে খেলাটা না বদলে স্ট্রোক খেলার চিরন্তন পথে হাঁটাটাই সর্বনাশ করেছিল ভারতের। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সেই একই ভুল করলেন।
কলিন মানরোকে দেখে শেখা উচিত ছিল। এমনিতে তাঁর ব্যাটিংয়ে মার মার-কাট কাট মেজাজ, অথচ কাল সেই মানরোই ৩৫ রান করতে ৩২ বল লাগিয়ে ফেললেন। সেটিও শেষ দিকে একটু চালিয়েছেন বলে, নইলে একসময় তো ১৯ বলে ১২। মানরো যখন ৮ রানে, সাকিবের এলবিডব্লুর আবেদনটা আম্পায়ার কেন নাকচ করে দিলেন, বারবার রিপ্লে দেখেও সেটির ব্যাখ্যা মিলল না। ম্যাচটা ক্লোজ হলে নিশ্চয়ই এটি নিয়ে অনেক শোরগোল হতো। কিন্তু ৭৫ রানে পরাজয়ের পর এসব নিয়ে কথা বলতেই তো কেমন লাগে!
বাংলাদেশের ক্রিকেটে পালাবদলের শুরু হিসেবে কেউ যদি ২০১০ সালের নিউজিল্যান্ড সিরিজের কথা বলেন, সেটি ভুল হবে না। নিউজিল্যান্ড ৪-০ হোয়াইটওয়াশ। যেটি ‘বাংলাওয়াশ’ হয়ে ঢুকে গেল বাংলাদেশের ক্রিকেট অভিধানে। তিন স্পিনার নামিয়ে দিত বাংলাদেশ আর কিউই ব্যাটসম্যানরা হাঁসফাঁস করে মরত। কাল হলো উল্টোটা। মিচেল স্যান্টনার, নাথান ম্যাককালাম ও ইস সোধির স্পিন-ত্রিফলায় ছিন্নভিন্ন বাংলাদেশ। এঁদের সঙ্গে আবার যোগ হলেন এলিয়ট। এমনিতে মিডিয়াম পেসার। কিন্তু কাল যে বোলিংটা করলেন, তা যেন পেস-স্পিনের এক যুগলবন্দী। তাতেই ১২ রানে ৩ উইকেট।
উইকেটটা খুব ভালো পড়ছেন কেন উইলিয়ামসন। মাশরাফিও যদি তা ঠিক পড়ে থাকেন, তারপরও বোধ হয় তাঁর করার কিছু ছিল না। সাকিব ছাড়া এই দলে ভালো স্পিনার কই? সেই সাকিবও ৪ ওভারে ৩৩ রান দিয়ে ফেললেন কাল। তুলনায় শুভাগত হোম বরং মিতব্যয়ী (৩ ওভারে ১৬)। পরে ব্যাটিংয়েও সর্বোচ্চ রান। সেটি মাত্র অপরাজিত ১৬—এটাই বলে দিচ্ছে, কী করুণই না দেখাচ্ছে বাংলাদেশের স্কোরকার্ড। যেটির শুরু তামিম ইকবালের রান আউট দিয়ে। আল আমিনের বোল্ড হওয়া দিয়ে যখন শেষ, ইনিংসের তখনো ২৬ বল বাকি।
ব্যাটিং নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভালো। ফিল্ডিংও ভালো-মন্দে মেশানো। শুভাগত ও মিঠুনের কল্যাণে দারুণ দুটি ক্যাচ যেমন দেখা গেছে, আবার আল আমিন ও তামিমের সৌজন্যে সহজ দুটি ক্যাচ ফেলাও। তবে বোলিংটা খুব খারাপ করেনি বাংলাদেশ।
এভাবে গড়ে বলাটা মুস্তাফিজুরের প্রতি অন্যায় হয়। ম্যাচ শেষে হাথুরুসিংহে বললেন, নিউজিল্যান্ড ২০-২৫ রান বেশি করে ফেলেছে। মুস্তাফিজ আরও একবার নিজের অসাধারণত্ব প্রমাণ না করলে তো নিউজিল্যান্ড আরও বেশি করে! বিস্মরণযোগ্য এই ম্যাচে মনে রাখার মতো শুধু তাঁর বোলিংটাই। ২২ রানে ৫ উইকেটের শেষ দুটি পরপর দুই বলে। সেটি ইনিংসের শেষ ওভার। শেষ বলটি করার সময় তাঁর সামনে হ্যাটট্রিকের সুযোগ। সেটিতে অবশ্য ম্যাকলেনাহান উল্টো ছক্কা মেরে দিয়েছেন।
এটি ছিল দুঃস্বপ্ন ভোলার ম্যাচ। তা সেটি তো কিছুটা হলোই। ৭০ রানে অলআউটে বেঙ্গালুরুতে ভারত-ম্যাচের শেষ তিন বলের ওই দুঃস্বপ্ন তো কিছুটা হলেও আড়াল!