শোকস্তব্ধ প্রেমাদাসায় ক্যারিবীয় উৎসব
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
এটাই কি সেই ম্যাচ, যাতে টসে জিতে ব্যাটিং করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তিন ওভারে ১ উইকেটে ২! সেই ম্যাচ, যেটিতে ৬ ওভারের পাওয়ার প্লে শেষে স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছিল ১৪, ১০ ওভার শেষে ২ উইকেটে ৩২! সেই ম্যাচটাই তো, যেটি দেখেছে ক্রিস গেইলের ১৮.৭৫ স্ট্রাইকরেটের (১৬ বলে ৩) এক অভাবনীয় এক ইনিংস! রাত সাড়ে দশটার দিকে স্তব্ধ প্রেমাদাসায় ঘণ্টা তিনেক আগের ওই ঘটনাগুলোকে কী অবাস্তবই না মনে হচ্ছে!
প্রথম প্রকাশ: ৮ অক্টোবর, ২০১২। প্রথম আলো।
প্রেমাদাসায় ছিল ৩৫ হাজার দর্শক। আর বাইরে লক্ষ জনতা। রাতভর উৎসবের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়। বারবাডোজ-লর্ডস-মুম্বাই থেকে স্বপ্নভঙ্গের ঝোড়ো হাওয়া গত পাঁচ বছরে তিন-তিনবার লন্ডভন্ড করে দিয়েছে উৎসবের সব আয়োজন। এবার বাড়ির উঠোনে কি আবারও এমন হতে পারে! ঈশ্বর কি এতই নিষ্ঠুর!
ঈশ্বরের কাছে নিষ্ঠুরতার হয়তো অন্য অর্থ আছে। অথবা তাঁর বিশাল কর্মপরিধির মধ্যে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতো ‘তুচ্ছ’ বিষয়ের কোনো স্থান নেই। যে কারণে উৎসব হলো ঠিকই, তবে শ্রীলঙ্কায় নয়। হাজার হাজার মাইল দূরে ক্যারিবিয়ান সাগরের বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দ্বীপগুলোতে ভরদুপুরে শুরু হয়ে গেল উদ্দাম নাচ আর গান। মহাসিন্ধুর ওপার থেকে সেই উৎসবের হাওয়া এসে বিষণ্ন থেকে বিষণ্নতর করে তুলল আরেক দ্বীপ শ্রীলঙ্কার রাত।
মাঠে তখন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের উদ্দাম উদযাপন চলছে। ক্রিস গেইল গ্যাংনাম নাচটাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ‘অফিশিয়াল ড্যান্স’ বানিয়ে ফেলেছিলেন আগেই। সেই গ্যাংনাম তো হলোই, প্রেমাদাসার দর্শক চোখ মুছতে মুছতে দেখলেন আরও বিচিত্র সব উদযাপন।
খেলা শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, প্রেমাদাসার গ্যালারিতে তখনো শোকস্তব্ধ অনেকগুলো মুখ সারি সারি দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ নিজের চোখে যা দেখলেন, সেটি যেন বিশ্বাস হতে চাইছে না! এটিই কি সেই ম্যাচ, যেটি শুরু হয়েছিল অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজের উইকেট-মেডেন দিয়ে। এটাই কি সেই ম্যাচ, যাতে টসে জিতে ব্যাটিং করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তিন ওভারে ১ উইকেটে ২! এটি কি সেই ম্যাচ, যেটিতে ৬ ওভারের পাওয়ার প্লে শেষে স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছিল ১৪, ১০ ওভার শেষে ২ উইকেটে ৩২! সেই ম্যাচটাই তো, যেটি দেখেছে ক্রিস গেইলের ১৮.৭৫ স্ট্রাইকরেটের (১৬ বলে ৩) এক অভাবনীয় এক ইনিংস! রাত সাড়ে দশটার দিকে স্তব্ধ প্রেমাদাসায় ঘণ্টা তিনেক আগের ওই ঘটনাগুলোকে কী অবাস্তবই না মনে হচ্ছে!
মাঠে তখন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের উদ্দাম উদযাপন চলছে। ক্রিস গেইল গ্যাংনাম নাচটাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ‘অফিশিয়াল ড্যান্স’ বানিয়ে ফেলেছিলেন আগেই। সেই গ্যাংনাম তো হলোই, প্রেমাদাসার দর্শক চোখ মুছতে মুছতে দেখলেন আরও বিচিত্র সব উদযাপন। শ্রীলঙ্কার ইনিংসের সময়ই একটার পর একটা উইকেট পড়েছে আর নাচের বিচিত্র সব মুদ্রায় আনন্দে মেতেছেন ব্রাভো-পোলার্ড-গেইলরা। ট্রফি নিয়ে ছবি তোলার সময় গেইল তো বন্ধু উসাইন বোল্টকে অনুকরণ করে বার কয়েক বুকডনও দিয়ে নিলেন।
স্তব্ধ প্রেমাদাসা তখন সব দেখছে আর ভাবছে, শেষ দৃশ্যটা কি এমন হওয়ার কথা ছিল! প্রথম ১০ ওভারে ৩২ করার পর পরের ১০ ওভারে না হয় ১০৫ রান করেছেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ। না হয় মারলন স্যামুয়েলস জাহাজের জ্বলন্ত ডেকে একা দাঁড়িয়ে স্বপ্নের একটি ইনিংস (৫৬ বলে ৭৮) খেলেছেনই। প্রথম ৩২ বলে ২০ রান করার পর পরের ২৩ বলে না হয় করেছেনই ৫৮। তাতেও তো স্বপ্নটা হাতের নাগালেই ছিল।
১১ ওভারে স্কোর ছিল ৩৮, পরের দুই ওভারেই আরও ৩১ রান ওই স্যামুয়েলসের সৌজন্যেই। না হয় লাসিথ মালিঙ্গা শ্রীলঙ্কানদের দুর্দান্ত বোলিংয়ের মধ্যে ‘হংসমাঝে বক যথা’ হয়ে ৪ ওভারে ৫৪ রান দিয়ে ফেলেছেনই। শেষ দিকে ড্যারেন স্যামি ১৫ বলে ২৬ রানের একটা ছোট্ট ঝড় তুলে না হয় স্কোরটা ১৩৭ রানে নিয়ে গেলেনই, কিন্তু এটা কি আর অনতিক্রম্য কিছু! বিরতির সময়ও তো উত্সবের আয়োজনে কোনো ত্রুটি থেকে গেল কি না, সেটিই শেষবারের মতো দেখে নেওয়ার ছিল।
দশম ওভারে শ্রীলঙ্কা ১ উইকেটে ৪৮, উইকেটে দুই মহিরুহ জয়াবর্ধনে-সাঙ্গাকারা, উত্সবের রং শ্রীলঙ্কাতেই ছড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায়। সাঙ্গাকারা গেলেন, পরের ওভারেই ম্যাথুজও। তাতে কি, জয়াবর্ধনে আছেন না! বিশ্বকাপের দুঃখি রাজপুত্রের দিকে এবার কি আর মুখ তুলে তাকাবেন না ক্রিকেট-বিধাতা!
হন্তারক হয়ে এল রিভার্স সুইপ। বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে একটা রিভার্স সুইপই এত দিন বিখ্যাত হয়ে ছিল। ইডেন গার্ডেনে ১৯৮৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইংল্যান্ড জয়ের পথে। বাঁহাতি স্পিনার অ্যালান বোর্ডারের প্রথম বলেই রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে মাইক গ্যাটিং কট বিহাইন্ড। হারতে হারতে ফাইনাল জিতে গেল অস্ট্রেলিয়া।
সুনীল নারাইনের বলে মাহেলা জয়াবর্ধনে যে শটটি খেললেন, সেটি রিভার্স সুইপ আর রিভার্স পুলের মাঝামাঝি। ১৯৮৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে এক অধিনায়ক আউট করেছিলেন আরেক অধিনায়ককে। এখানেও দুই অধিনায়কের একটা যুগলবন্দি থাকল। পয়েন্টে জয়াবর্ধনের ক্যাচটি নিলেন স্যামি।
শ্রীলঙ্কার শেষের শুরুও তাতেই। পাঁচ বছরে চতুর্থ ফাইনালটিও হয়ে রইল সেই দীর্ঘশ্বাসই। চার ফাইনালের দুটিতেই অধিনায়ক জয়াবর্ধনে টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণাটাও দিলেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়েই।
অন্তত এই রাতে শ্রীলঙ্কার দুঃখে কাতর হতে বয়েই গেছে ড্যারেন স্যামির। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বুকেও তো দিনে দিনে কম দুঃখ জমেনি। সর্বশেষ বিশ্বকাপ জয় সেই ১৯৭৯ সালে। এরপর ‘তেত্রিশ বছর কাটলো গেল’...পরের লাইনটা এখানে ‘কেউ কথা রাখে নি’ হবে না। বিশ্বকাপ যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে কথা দিয়ে থাকে, তেত্রিশ বছর কেটে যাওয়ার পর তা রাখল তো!