২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
এক ম্যাককালামেই সব শেষ
উৎপল শুভ্র
১ সেপ্টেম্বর ২০২১
ইনিংসের শেষ বলে আউট হওয়ার আগে ৫৮ বলে ১২৩। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সর্বোচ্চ, প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে দ্বিতীয় সেঞ্চুরিও। ম্যাককালাম যেটি খেললেন, সেটিকে শুধু ক্রিকেট বলাটা ঠিক হবে না। তাঁর হাতের ব্যাট কখনো হয়ে গেল টেনিসের র্যাকেট, কখনো বা গলফের ক্লাব। ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের সেই ম্যাচ।
প্রথম প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২। প্রথম আলো।
নিউজিল্যান্ড: ২০ ওভারে ১৯১/৩। বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৩২/৮। ফল: নিউজিল্যান্ড ৫৯ রানে জয়ী।
বাংলাদেশের একমাত্র ‘জয়’টা ম্যাচ শুরুর আধঘণ্টা আগে। টসে জিতলেন মুশফিকুর রহিম। না জিতলেই কি ভালো হতো?
মনে হয় না, তাতে কোনো ইতরবিশেষ হতো। রস টেলর টসে জিতলেও একই ঘটনা ঘটত। নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক তো আগের দিনই বলে দিয়েছেন, টি-টোয়েন্টিতে প্রথমে ব্যাটিং করাটাই তাঁর পছন্দ।
মুশফিকের কথায়ও এমন একটা সুরই পাওয়া গিয়েছিল। এসএলপিএলে খেলার সুবাদে পাল্লেকেলে মাঠের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। কৃত্রিম আলোয় এখানে বল বেশি এদিক-ওদিক করে—এ কথার অর্থ তো পরে ব্যাটিং করতে না চাওয়াই।
তারপরও মুশফিক টসে জিতে যে প্রথমে বোলিং করলেন, সেটির কারণ খুঁজে পাওয়া মোটেই কঠিন নয়। দুই অধিনায়ক যখন টস করতে নামছেন, আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে। তবে এই পরিস্থিতি বোলিংয়ে খুব কাজে লাগবে, এটা ভেবে হয়তো মুশফিকের ওই সিদ্ধান্ত নয়। বাংলাদেশের বোলিং স্পিননির্ভর আর স্পিনারদের মেঘ-বৃষ্টি কোনো কাজে আসে না। পেস বোলিং অনুকূল পরিবেশে নিউজিল্যান্ডের পেস আক্রমণকে এড়ানোটাই আসল কারণ হওয়ার কথা। একই কারণে রস টেলরও সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছিলেন। টসে জিতলে তিনিও নাকি বোলিংই করতেন।ক্রিকেটই একমাত্র খেলা, যেটিতে টসও এমন আলোচনার খোরাক। যদিও এই ম্যাচে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের আগে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করাটা রীতিমতো ‘পাপ’-এর পর্যায়ে পড়ে। টি-টোয়েন্টিতে তাঁর মারদাঙ্গা ব্যাটিং নিয়ে ম্যাককালাম সব সময় বলেন, ‘কোনো দিন হয়, কোনো দিন হয় না।’ যেদিন হয়, সেদিন আসলে আগে ব্যাট করা-পরে ব্যাট করায় কিছু আসে-যায় না। নিউজিল্যান্ড পরে ব্যাট করলে যেটা হতে পারত, হয়তো ম্যাককালামের সেঞ্চুরিটা হয় না। এর আগেই ম্যাচ শেষ হয়ে যায়।
মাশরাফি বিন মুর্তজা বাংলাদেশের ভালো কিছু করার পূর্বশর্ত হিসেবে ‘শুরুটা ভালো হতে হবে’ কথাটা বারবার বলেন। গত পরশুও বলেছিলেন। তা শুরুটা ভালোই হয়েছিল। বাংলাদেশও এখন ৬ ওভারের পাওয়ার প্লেতে ৫০ রান না হলে মন খারাপ করে। সেখানে নিউজিল্যান্ড করল ৩৪ রান। ইনিংসের চতুর্থ আর নিজের প্রথম ওভারে একটা উইকেটও তুলে নিয়েছেন রাজ্জাক। পরে মনে হলো, উইকেটটা পড়ে উল্টো বিপদই হয়েছে। তিন নম্বরে নামলেন যে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম।
ইনিংসের শেষ বলে আউট হয়েছেন। এর আগে ৫৮ বলে ১২৩। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটাও হয়ে গেল। ম্যাককালাম যেটি খেললেন, সেটিকে শুধু ক্রিকেট বলাটা ঠিক হবে না। তাঁর হাতের ব্যাট কখনো হয়ে গেল টেনিসের র্যাকেট, কখনো বা গলফের ক্লাব। মাশরাফির বলে লং অফের ওপর দিয়ে যে ছক্কাটা মারলেন, সেটি যেন ফেদেরারের ফোরহ্যান্ড। পার্থক্য একটাই—বল এখানে আরও অনেক উঁচু দিয়ে আরও অনেক দূরে গিয়ে পড়ল।
কোনো ব্যাটসম্যান এমন মার শুরু করলে বিশ্বের সেরা বোলারদেরও লাইন-লেংথ এলোমেলো হয়ে যায়। বাংলাদেশের বোলারদের ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। কিন্তু এমন জঘন্য ফিল্ডিংয়ের কী ব্যাখ্যা! সেটি কি বিষম চাপে? তিন মাস ধরে এই ম্যাচটাকেই পাখির চোখ করে এগিয়েছে বাংলাদেশ। দুপুরে হোটেল থেকে বাসে ওঠার সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিল, ‘আজ কিছু করতেই হবে’ চাপটা ঘিরে ধরেছে সবাইকে। শুরু থেকেই মিস ফিল্ডিং, ওভার থ্রো, স্লো মোশনে নড়াচড়া—টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এমন ফিল্ডিং করা আর চোখ বুজে পাহাড় থেকে লাফ দেওয়া একই কথা।
ক্যাচ পড়াটা বাদ ছিল। ১৯তম ওভারে সেটিও পড়ল। সানির বলে এক্সস্ট্রা কাভারে ম্যাককালামকে নতুন জীবন দিলেন মাশরাফি। একটা রানও। আবার স্ট্রাইক পেয়ে ৪-৪-৬। মাঝের চারটাতে সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরির পাওয়ার পর পরের ৬ বলে করলেন ২২ রান। ওই ঝড়েই শেষ ৪ ওভারে ৬৩।
প্রথম ওভারে ওয়াইড বলে বাউন্ডারি দেওয়ার পরও মাশরাফির ৪ ওভারে ২৬ রানে ১ উইকেট এই দিনে গর্ব করার মতোই। রাজ্জাকের ২৮ রানে ২ উইকেটও তো অবশ্যই। টি-টোয়েন্টিতে দলের সেরা বোলার সাকিব আল হাসানের পারফরম্যান্সটাই আসলে বাংলাদেশের দিনটির প্রতীকী প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। ৪ ওভারে ৪০ রান—টি-টোয়েন্টিতে সাকিবের সবচেয়ে খরুচে বোলিং।
নিউজিল্যান্ড ১৯১ করে ফেলার পরই ম্যাচ শেষ। সপ্তম ওভারে বাংলাদেশ ৪ উইকেটে ৩৭ হয়ে যাওয়ার পর তো টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বড় ব্যবধানের পরাজয়ের রেকর্ড ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হয়ে গেল। নাসিরের হাফ সেঞ্চুরিতে শেষ পর্যন্ত অবশ্য ব্যবধানটা খুব বেশি লজ্জাজনক হলো না।
কিন্তু যা হলো, তাতেই সুপার এইটের স্বপ্ন অনেকটাই রং হারিয়ে ফেলল!