৬৩-ই কি গেইলের সেরা?
উৎপল শুভ্র
২১ সেপ্টেম্বর ২০২১
টেস্টে দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরি আছে তাঁর, টি-টোয়েন্টিতে ধ্বংসাত্মক সব সেঞ্চুরিতে তো হয়ে গেছেন এই ফরম্যাটের পোস্টারবয়ই। তবে গেইলের সেরা হিসেবে কেন যেন ৬৩ রানের একটা ইনিংসকেই সেরা মনে হয়! শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যা খেলেছিলেন ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে।
প্রথম প্রকাশ: ২০ জুন ২০০৯। প্রথম আলো।
শ্রীলঙ্কা: ২০ ওভারে ১৫৮/৫ ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ১৭.৪ ওভারে ১০১ ফল: শ্রীলঙ্কা ৫৭ রানে জয়ী
১-০-১-৩!
কী এটা? অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের বোলিং বিশ্লেষণ!
কী বলছেন, এটা না টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট, বোলাররা যাতে ব্যাটসম্যানের দাসানুদাস! টি-টোয়েন্টির এই বিশ্বকাপ দেখে থাকলে এটি যে আর সত্যি নয়, তা আপনার জেনে যাওয়ার কথা।
তাই বলে প্রথম ওভারেই পড়ে যাবে ৩ উইকেট!
অবিশ্বাস্য-অভাবনীয় সেই ঘটনাই দেখল কাল ওভালের দ্বিতীয় সেমিফাইনাল। ম্যাথুসের দ্বিতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ বলে জেভিয়ার মার্শাল, লেন্ডল সিমন্স, ডোয়াইন ব্রাভো বোল্ড! ব্যাপারটাকে আরও ভূতুড়ে বানাতে কেউই সরাসরি বোল্ড নন। স্টাম্পে যাওয়ার আগে মার্শাল-ব্রাভোর ব্যাটে লাগল বল, সিমন্সের থাই প্যাডে। প্রথম ওভার শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩ উইকেটে ১ রান—ম্যাচ তো শেষ ভাই, পুরস্কার বিতরণীটা করে ফেললেই হয়!
ক্রিস গেইল তা মানবেন কেন? প্রথম বলে ১ রান নিয়ে অন্য প্রান্ত থেকে দেখলেন অ্যাঞ্জেলো ঢেউয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাইনাল স্বপ্ন বালির প্রাসাদের মতো ধসে পড়া। দেখলেন এবং নিজেকে হয়তো বললেন, আজ যদি কিছু করতে পারো, তবেই না তুমি বড় খেলোয়াড়।
কিন্তু গেইল কীভাবে কী করবেন! শ্রীলঙ্কান বোলারদের চেয়েও যে তাঁর বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সতীর্থদের সীমাহীন অক্ষমতা। প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের শূন্যের পর আর কোনো ব্যাটসম্যানের দুই অঙ্কের রানও নেই। ১৫তম ওভারে রামদিন উদানাকে পরপর দুটি চার মারার আগ পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৮ চার ও ২ ছয়ের সব কটিই গেইলের ব্যাট থেকে। এর পরও তা-ই থাকল। প্রথম ওভারে তিন উইকেট যেমন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি এর আগে দেখেনি, তেমনি দেখেনি ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে এমন নিঃসঙ্গ লড়াইও। ৫০ বলে ৮টি চার ও ২টি ছয়ে সাজানো অপরাজিত ৬৩, টি-টোয়েন্টিতে প্রথমবারের মতো ব্যাট ক্যারি করার কীর্তি—ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারলেও ক্রিস গেইল কি হারলেন?
টসটাও গেইলই জিতেছিলেন। ৭৩ রানের উদ্বোধনী জুটির পরও ১৫ ওভার পর্যন্ত শ্রীলঙ্কান ইনিংস মোটেই প্রিয়দর্শন নয়। স্কোরবোর্ডে মাত্র ৯৮। জয়াসুরিয়া চার-পাঁচবার ব্যাট বদলিয়েও স্বরূপে দেখা দিতে ব্যর্থ—৩৭ বলে ২৪। সাঙ্গাকারা দুই বল খেলে শূন্য। জয়াবর্ধনে ৩ বলে ২। এরপর শ্রীলঙ্কার আশা বলতে কি কিছু থাকে নাকি? থাকে, থাকে। টি-টোয়েন্টির এই মহাযজ্ঞকে যে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিংয়ের তিন মহাতারকার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন তিলকরত্নে দিলশান। সেমিফাইনালের আগে টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি রান ছিল তাঁর। প্রথম সেমিফাইনালে ক্যালিস ১৭ রান এগিয়ে গিয়েছিলেন, কাল দিলশান ৭৯ রান পেছনে ফেললেন তাঁকে।
অ্যাডিলেড ওভালে যেমন গাঙচিল, ওভালে তেমনি কবুতর। বাউন্ডারির দিকে বল ছুটে গেলেই উড়তে শুরু করে কবুতরের ঝাক। শ্রীলঙ্কান ইনিংসে সবচেয়ে বেশি তা ওড়ালেন দিলশান। তার কারণেই শেষ ৫ ওভারে ৬০ রান এবং ১৩০-১৩৫ মনে হতে থাকা শ্রীলঙ্কার ইনিংসটা ২০ ওভার শেষে ৫ উইকেটে ১৫৮।
৬ ম্যাচে ৩১৭ রান, সেমিফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ—তারপরও দিলশানের কি একটু মন খারাপ? সেই কবে, গত বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে ক্রিস গেইল একটা সেঞ্চুরি করে রেখেছেন, আন্তর্জাতিক টি- টোয়েন্টিতে আর কোনো সেঞ্চুরি নেই। কাল যে দিলশান তা পেতে পেতে হারালেন। ৫৭ বলে অপরাজিত ৯৬, ১২টি চার, ২টি ছয়—শেষ ওভারটা শুরু করেছিলেন ৯১ রানে, তখন তিনি নন-স্ট্রাইকার। মাঝখানে দুই বলে ৩ রান নেওয়ার পর আবার স্ট্রাইক পেলেন শেষ বলে। সেঞ্চুরি করতে ছক্কা মারতে হতো, দিলশান নিতে পারলেন মাত্র ২।
ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত দিলশান বনাম গেইল। যাতে দিলশানকে জিতিয়ে দিল অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের ওই ওভারটি! তার চেয়ে বেশি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাকি সবার ব্যাটিং ভুলে যাওয়া!